আই নিউজ ডেস্ক
বিলুপ্তির পথে হাওরের সুপরিচিত উদ্ভিদ বিন্না ঘাস
সময়ের সাথে সাথে হাওর এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিন্না ঘাস।ছবি- সংগৃহীত
বিন্না ঘাস, নাম বললে কেউ না চিনলেও হাওরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর এই ঘাস চোখে পড়েনি তা অসম্ভব। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে এই জাতের ঘাসের দেখা মিলে। স্থানীয়দের কাছে যা ছন নামে পরিচিত। আগে হাওরাঞ্চলে প্রায় সকল মাটির ঘরে বিন্না ঘাস বা ছনের ছাউনি ব্যবহৃত হতো। এখন আর আগের মতো ছন ব্যবহার করা হয় না। তাছাড়া, সময়ের সাথে সাথে হাওর এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিন্না ঘাস ( (Vetiver Grass)।
এক সময় টাঙ্গুয়ার হাওরের কান্দায় (উঁচু পতিত জমি) বিভিন্ন রাস্তার ধারে বনবাদাড়ে এই ঘাস প্রকৃতিতে শোভাবর্ধন করত। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ইটপাথর ও ঢেউটিনের দাপটে মানুষ উন্নয়নের পথে ধাবিত হয়ে ঘর নির্মাণে ইটপাথর ও ঢেউটিন ব্যবহারের ফলে এই ঘাস বা ছনের কদর কমে গেছে। হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে কান্দা কাটার মহোৎসব চলতে থাকায় বিন্না ঘাস অস্থিত্ব বিলুপ্তির পথে। এছাড়া অযত্ন অবহেলার কারণেও ঘাসগুলো আর হাওরাঞ্চলের রাস্তার ধারে এবং বনবাদাড়ে সচরাচর চোখে পড়ে না।
প্রাচীন তামিল পুঁথিতে বিন্না ঘাসের ঔষধি গুণের কথা বলা আছে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ বইতে খসখসের শরবত পানের উল্লেখ আছে। জনপ্রিয় পানীয় রুহ আফজার একটি উপাদানও বিন্না ঘাস। বিন্না ঘাসের নির্যাসযুক্ত চা খায় অনেক দেশের লোক। আজও এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু এলাকায় ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিন্না ঘাস বা খসখস। ভারতে ব্যবহৃত হয় ঘর ঠাণ্ডা রাখার উদ্দেশ্যে। একটি রকম এমন—ভেটিভারের শিকড় দিয়ে মাদুর বানিয়ে গ্রীষ্মকালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সদর দরজায়। নিয়মিত বিরতিতে পানি ছিটিয়ে মাদুরটি ভিজিয়ে রাখা হয়। বাতাস বইলে ঘর তো ঠাণ্ডা হয়ই, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধ।
এছাড়া ভেটিভার কাগজ ও পার্টিক্যাল বোর্ড তৈরির কাঁচামাল। এর শক্ত শিকড় দড়ি, টুপি, ঝুড়ি, মাদুর, চেয়ারেও লাগে। আবার জৈব সার তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। বিন্না ঘাস একদিকে যেমন গবাদি পশুর খাদ্য, আবার এর পাতা দিয়ে জুতা, ব্যাগ, ঘরের চালা, ট্রে, কুশন ও বালিশের কভার, বিছানার চাদর, শৌখিন কার্ড, টেবিলের রানারসহ অনেক আকর্ষণীয় হস্তশিল্প বানানো হয় বাণিজ্যিকভাবে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ বিন্না ঘাস দিয়ে বানানো সামগ্রী রপ্তানিও করছে।
বিন্না ঘাস নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার তথ্যসূত্রে জানাযায়, বিন্না ঘাস (Vetiver Grass) হলো একটি জৈব—প্রকৌশল সমাধান। পৃথিবীর অনেক দেশে এই বিন্না ঘাস নিয়ে গবেষণা চলছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ বিন্না ঘাস কে পাহাড় রক্ষার ‘জাদুর ঘাস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, পাহাড়ের পার্শ্বঢাল রক্ষায় বিন্না ঘাসের জুড়ি নেই। তাই প্রকৃতিতে অনেকটা অনাদরে জন্ম নিলেও এই ঘাসের খ্যাতি ও কদর বিশ্বজোড়া। বিভিন্ন দেশে পাহাড়ের ক্ষয়রোধ ও পাহাড়ধস বন্ধে পার্শ্বঢালে এই জাদুকরী ঘাস লাগানো হয়। কারণ বিন্না ঘাসের মূল গভীরে চলে গিয়ে মাটিকে শক্ত করে আঁকড়ে রাখে। এর লম্বা শিকড় অল্প দিনেই মাটির নিচে জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় শিকড় চলে যায় ১০ থেকে ১৪ ফুট পর্যন্ত গভীরে।
জানা যায়, চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে মাটিতে বোনা ঘাস ঢাল রক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। আবার শীত বা গ্রীষ্ম সব মৌসুমে টিকে থাকতে পারে এই ঘাস। পানি পরিস্কার করতে এবং পানি থেকে আর্সেনিক দূর করে দূষণ কমাতেও এ ঘাস কার্যকর ভূমিকা রাখে। এই ঘাস দিয়ে নদীর তীর, পাহাড়ি ঢাল, রাস্তাঘাট সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা রক্ষা করা সম্ভব। বিন্না ঘাসের লম্বা মূল বা শেকড় খুব দ্রুত মাটির গভীরে ঢুকে মাটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে। এই ঘাসের সহনশক্তি ইস্পাতের ছয় ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ছয়টি শেকড় একসঙ্গে জোড়া দিলে সেটি একটি ইস্পাতের মতোই শক্তিশালী হয়ে যায়। ঘাসগুলো প্রচন্ড ঠান্ডা তীব্র গরমে অর্থাৎ প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। এমনকি লবণাক্ত পানিতেও।
বাংলাদেশেরও বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরিত্যক্ত জমিতে ভূমিহীন নারীরা এই ঘাসের চাষ করছে। তা ছাড়া স্থানীয় সরকারের অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে নির্মিত সড়ক ঢালে ব্লকের পরিবর্তে এখন থেকে বিন্না ঘাসের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মধ্যনগর উপজেলায় এলজিইডির কর্মরত উপ—সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম।
স্থানীয়রা জানান, একসময় আমাদের এই হাওরাঞ্চলের রাস্তাঘাট, কান্দা ও বনবাদাড়ে ছন (বিন্না ঘাস) সচরাচর দেখা যেতো। লোকজন এলাকাভিত্তিক ওই ছনগুলো সংরক্ষণ করে রাখতো। এখন সবাই ঘরের ছাউনিতে ঢেউটিন ব্যবহার করে। তাই ওই ছনের কদর কমে গেছে। তারা জানান ওই বিন্না ছন এর মূল সহ উপরে তুলে ঢেউয়ের আঘাত থেকে বাড়িঘর রক্ষার জন্য বাঁধ দেওয়া হতো।
টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান মিয়া জানান, আমরা আগে ঘরের ছাউনি দিতাম বিন্না ছন দিয়ে। কেউ বা আবার হুগল এর ছন, কেউ আবার ধানের খড় দিয়ে ঘরের ছাউনি দিতো। তবে বিন্নার ছন অনেকটাই টেকসই ছিল একবার ছাউনি দিলে চার পাঁচ বছর চলে যেতো। এখন আর এসব ছন ব্যবহার করা হয় না। ইদানীং হাওর এসব বিন্নার ছন তেমনটা দেখা যায় না। আগে আমরা যার যার এলাকাভিত্তিক ওই ছন সংরক্ষণ করে রাখতাম।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও পশু বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম এ আওয়াল বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের জরিপে বাংলাদেশের অনেক জেলায় এ ঘাসের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশে পাওয়া প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম ভেটিভারিয়া জাইজানিওডিস। তবে এই ঘাস কাজে লাগানোর আগে এখানকার মাটি এবং জলবায়ুর সঙ্গে ভেটিভার বা বিন্নাঘাসের আচার—আচরণের খুঁটিনাটি জানা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিচিত্র ধাতের জলবায়ুতে ভেটিভার বা বিন্না ঘাস খাপ খাওয়াতে পারছে কি না সেটাও দেখা দরকার। প্রতিনিয়ত পরিষ্কার হচ্ছে ভেটিভারের নানা বৈশিষ্ট্য। শিকড় মাটিতে পোক্তভাবে জন্মানোর পর ওপরের দিকে বেড়ে ওঠা ঘাস নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। এভাবে ছেঁটে ফেলা ভেটিভারও ফেলনা নয়। রেক কাজে ছাঁটা ঘাসও কাজে লাগানো যায়।
দেশে বিন্না ঘাস নিয়ে সেভাবে এখনো শিল্প গড়ে না উঠলেও কাঁচামাল হিসেবে ভেটিভার রপ্তানি করা যেতে পারে। ড়ুামাঞ্চলে মাটির ঘরে আগে খড়ের ছাউনি ব্যবহৃত হতো। বন উজাড় করার ফলে ক্রমে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাওয়ায় সে জায়গা নিয়েছে টালির ছাদ। মাটির টালি বসিয়ে তৈরি ছাদ দারুণ ঠুনকো, ভূমিকম্প বা ঘূর্ণিঝড়ে ধসে পড়লে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাতে পারে। আর ঘরের ছাদে ব্যবহৃত হতে পারে খসখস বা বিন্না ঘাস। এছাড়া বিন্না ঘাসের শিকড় দিয়ে তৈরি হয় পারফিউম, সাবান, হারবাল পানীয় আর ঘাসের শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি করা যায় পাটি। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের জনপ্রিয় পানীয় রুহ আফজার অন্যতম উপাদান এই বিন্না ঘাস।
আই নিউজ/এইচএ
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ