ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফি
লক্ষণহীন রোগ : নীরব ঘাতক
ক্যান্সারের বিভিন্ন লক্ষণ ও উপসর্গ আছে। এর মধ্যে স্তনে বা শরীরের কোথাও কোন চাকা বা পিন্ড দেখা দিলে, শরীরের যে কোন বহিঃনির্গমনের পথ দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, অনেক দিন যাবৎ খুশখুশে কাশি/গলাভাঙ্গা থাকলে, গিলতে অসুবিধা বা হজমের গন্ডগোল হলে, সহজে কমছে না এমন কোন ক্ষত হলে, মল ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন হলে, শরীরের যে কোন তিল বা আচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দিলে। উপরের এসব লক্ষণ ক্যান্সারের প্রাথমিক বিপদ সংকেত।
অনেকে মনে করেন তাদের কোন শারীরিক অসুবিধা অথবা কোন রোগ নেই। এই ভাবনা সবসময় ঠিক নাও হতে পারে। কারণ কিছু কিছু রোগ প্রাথমিক অবস্থায় কোন লক্ষণ তৈরী করে না বরং ভেতরে ভেতরে বাড়তে থাকে। অনেক সময় জটিল পর্যায়ে চলে যায়। এরূপ কিছু গুরুত্বপুর্ণ রোগের কথা আজ বলছি :
উচ্চ রক্তচাপ/হাইপারটেনশন : এ রোগ অনেকেরই কোন লক্ষণ তৈরি করে না। শুধুমাত্র মাপতে গিয়ে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেকে মাথাধরা, মাথাঘোরা, ঘাড়ব্যাথা ইত্যাদি উপসর্গে ভুগেন। আবার কেউ কেউ জটিলতা হিসাবে হৃদরোগ, কিডনী রোগ, বা প্যরালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তখন উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে।
দেখা যায় বাংলাদেশ ছাড়া অনেক উন্নত দেশেও এ রোগে আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকেই জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রোগ আছে। যারা জানেন তাদের অর্ধেক আবার লক্ষণ নেই বলে অবহেলাবশত পর্যাপ্ত চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। কোন লক্ষণ টের পাই না, তাই ঔষধ খাই না; একথা ভুল। যে ঔষধ খেয়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসে; সে ঔষধ নিয়মিত খেতে হবে। রক্তচাপকে রাখতে হবে ১২০/৮০ এর আশেপাশে। উচ্চ রক্তচাপ থেকে মুক্ত থাকতে হলে ধুমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ বর্জন করতে হবে এবং অতিরিক্ত চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলা করতে হবে। জটিলতা দেখা দিলে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আসলে অবশ্যই ঔষধ খেতে হবে।
ডায়াবেটিস : দিন দিন খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে/ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ হজমশক্তি বেড় গেল নাকি? কিন্তু এত খাবার যাচ্ছে কোথায়, চেহারা হচ্ছে শুকিয়ে তালপাতার সেপাইয়ের মতো। ডায়াবেটিসের অন্যতম লক্ষণ অনেকটা এ রকমই। তাছাড়া আছে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, দুর্বলতা বোধ করা, ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া ইত্যাদি। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে খিদে ও জল তেষ্টা বেড়ে যায়। আর বহুবার মুত্রালয়ে দৌড়াতে হয়। এ জন্য এ সমস্যাকে অনেকে বহুমুত্র রোগ বলে থাকেন। কারো কারো দুর্বলতা এত বেশি হয় যে, কোন ভারী কাজকর্ম ছাড়াই যখন তখন হাফিয়ে উঠে যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে আবার এসব লক্ষণ থাকে না। অনেকের বংশগত হয়ে থাকে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে।
এই রোগের জটিলতাসমুহের মধ্যে রয়েছে সহজে ঘা বা কাটাস্থান না শুকানো; পায়ে ঘা এমনকি পঁচে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস; কিডনী অকেজো হয়ে যাওয়া; স্নায়বিক দুর্বলতা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। প্রতিকার হিসেবে বলা যায়, লক্ষণ নেই বলে অবহেলা না করে নিয়মিত অথবা মাঝে মাঝে রক্ত ও প্রস্রাবে গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করা। ডাক্তারের পরামর্শমত খাদ্য ও ঔষধ গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিৎ। মনে রাখবেন ডায়াবেটিস একটি প্রতিরোধমূলক রোগ।
ক্যান্সার : শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গেই এ রোগ হতে পারে যার প্রাথমিক অবস্থায় কোন লক্ষণ থাকে না। ক্যান্সারের বিভিন্ন লক্ষণ ও উপসর্গ আছে। এর মধ্যে স্তনে বা শরীরের কোথাও কোন চাকা বা পিন্ড দেখা দিলে, শরীরের যে কোন বহিঃনির্গমনের পথ দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, অনেক দিন যাবৎ খুশখুশে কাশি/গলাভাঙ্গা থাকলে, গিলতে অসুবিধা বা হজমের গন্ডগোল হলে, সহজে কমছে না এমন কোন ক্ষত হলে, মল ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন হলে, শরীরের যে কোন তিল বা আচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দিলে। উপরের এসব লক্ষণ ক্যান্সারের প্রাথমিক বিপদ সংকেত। তবে মনে রাখতে হবে অনেক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কোন লক্ষণ বা উপসর্গ নাও থাকতে পারে। তাই বয়স ৪০ এর কাছাকাছি আসলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ৬ মাস অন্তর বছরে দুই বার অবশ্যই প্রয়োজনীয় চেকআপ করানো উচিৎ।
হাইপার লিপিডেমিয়া : কোলেস্টেরল হলো রক্তের চর্বি। রক্তের চর্বির রয়েছে নানান রকমভেদ। যেমন এইচডিএল, এলডিএল, ট্রাই গ্লিসারাইড, টোটাল কোলেস্টেরল ইত্যাদি। এইচডিএল কোলেস্টেরল শরীরের জন্য ভালো। সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিজ্জ তেলে এইচডিএল কোলেস্টেরল থাকে। আর এলডিএল কোলেস্টেরল শরীরের জন্য খারাপ।
যারা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করেন বা বংশে স্থুলতা আছে বা ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী তাদের রক্তে চর্বির মাত্রা বেশী থাকে, যাকে হাইপারলিপিডেমিয়া বলে। এ রোগেরও কোন লক্ষণ থাকে না। কোলেস্টেরল শরীরের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি বেড়ে গেলে তা ধীরে ধীরে রক্তনালীর ভেতরে জমে রক্ত নালীতে ব্লক তৈরী করে রক্ত চলাচল ব্যাহত করে। সেই অতিরিক্ত চর্বি নীরবে শরীরে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও মস্তিস্কে (Brain) স্ট্রোকের মত কঠিন রোগের জন্ম দিতে পারে।
শরীরে অতিরিক্ত চর্বি আছে কিনা তা জানার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যে পরীক্ষা করা হয় তার নাম Fasting lipid profile। এছাড়া যাদের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি আছে তারা দিনে ৩০ মিনিট হাঁটলে স্ট্রোক রোগের ঝুঁকি অর্ধেক কমে আসে। নিয়ন্ত্রিত সুষম খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম করার পরও যাদের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাদেরকে ঔষধ খেতে হবে। এক একজনের জন্য এক এক ধরনের ঔষধ উপযোগী। সেটা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে।
সবশেষে বলব উপরের লেখা পড়ে ভয় পাবেন না। অহেতুক আতংকে না ভুগে সচেতন হতে হবে। মনে রাখবেন রোগ যতো প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে, চিকিৎসার ফল ততই ভালো হয়। আর জানেনই তো প্রতিরোধই হলো সর্বোত্তম চিকিৎসা। সচেতন থাকি; সচেতন রাখি।
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ (শাফী), বিসিএস (স্বাস্থ্য), নাক-কান-গলা বিভাগ, বিএসএমএমইউ (প্রেষণে), ঢাকা। প্রাক্তন সহকারী রেজিস্ট্রার, সিওমেক হাসপাতাল। [email protected]
- জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটি ভালো?
- দামী নাকি কমদামী কোন সিগারেটে ক্ষতি বেশি?
- ডিম ভাজি না সেদ্ধ, কোনটা বেশি উপকারী?
- প্রোটিন জাতীয় খাবার কোন খাদ্যে বেশি-কোন খাদ্যে কম?
- হার্টের ব্লক খোলার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় রিং বা স্ট্যান্ট
- বডিবিল্ডিং: সাপ্লিমেন্টের গুরুত্ব এবং যেভাবে শুরু করবেন
- কানের ভেতর হঠাৎ পোকা বা কিছু ঢুকে গেলে
- ওসিডি কী? জেনে নিন লক্ষণ
- বাচ্চাদের গুড়াকৃমি প্রতিরোধে কী খাওয়াবেন?
- ফার্মেসি রাত ১২টায় বন্ধের সিদ্ধান্তে বিস্ময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর