সুমাইয়া সিরাজী
আপডেট: ১৭:৫৪, ২৪ জুলাই ২০২১
শিশুর জন্য গরুর মাংস নিরাপদ কি?
নিউট্রিশনিস্ট সুমাইয়া সিরাজী, বামে, শিশুকে খাওয়াচ্ছেন মা (প্রতীকী ছবি), ডানে
অনেকেই বলেন গরুর মাংস খাওয়া যাবে আবার কেউ বলেন, না যাবে না! এটা নিয়ে বেশ তর্ক বিতর্ক আছে। কিছু গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও পেশাগত কাজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখাটা দিচ্ছি।
বিশেষ শিশুরা ( সিপি, অটিজম, এডিএইসডি, ডাউন্স) গরুর মাংস খেতে পারবে কিনা! এই প্রশ্ন অনেকেই করেন আমাকে। অনেকেই জানান যে তার বাচ্চা খুব হাইপার তাই গরুর মাংস দিচ্ছেন না। কেউ বলেন যে কেউ নিষেধ করেছিলো বা কোথাও পড়েছেন তাই দিচ্ছেন না। কোরবানির ঈদ মুসলিমদের জন্য অন্যতম উৎসব! এই ঈদে মোটামুটি সবারই কম বেশি মাংস খাওয়া পড়ে। অনেকে পারিবারিক একটা চাপেও থাকেন যে কোরবানির মাংস ১/২ দিন বেশি খেলে কিছু হয় না! অনেকে সারা বছর নিয়ন্ত্রণ করেন বাচ্চাকে দেন না হাইপার হয়ে যাবে, কিন্তু এই ঈদে দিতেই হয়।
প্রথমে বলে নেই, একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা হলো ৮৫ গ্রাম বা ৩ আউন্স। যদি কোন বস্তুর সাথে তুলনা করে বোঝাই তা হলো একটা তাসের বান্ডিল এর সমান টুকরো (চর্বি, হাড় বাদে শুধু সলিড মাংস)।
১ বছর থেকে ৪ বছর পর্যন্ত শিশুদের দৈনিক ২ আউন্সের মতো দেয়া যাবে। (১ আউন্স= ২৮- ৩৫ গ্রাম)
৫ বছর থেকে ১০ বছর চাহিদা অনুযায়ী কমপক্ষে ৩ আউন্স দেয়া যাবে।
**শিশু অপুষ্টিতে ভুগলে, প্রোটিনের অভাব হলে, এই পরিমাণটা বাড়বে।
এই নির্দেশনা টা আমাদের বিশেষ শিশুর জন্যও প্রযোজ্য ( তবে কিছু সতর্কতা আছে নিচে এড করা হবে)
এখন যদি দৈনিক শিশুর প্রোটিনের চাহিদা রয়েছে তার পুরোটা নিশ্চয়ই আমরা এই মাংস থেকে দিবো না। মাছ থাকে এক বেলা বা দুধ থাকে বা ডিম থাকে। মানে সব মিলিয়ে কিন্তু প্রোটিন এর চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। তাই সপ্তাহে যদি আপনি আপনার শিশুকে ৩-৪ পিস সলিড মাংস দেন, তাহলেও কিন্তু ব্যালান্স হয়ে যায়।
এখন যদি প্রশ্ন করেন যে এই ৮৫ গ্রাম মাংস খাওয়াবো গরুর মাংসে তো অনেক কোলেস্টেরল বেশি শুনি?
- যদি ৮৫ গ্রাম ওজনের একটা মাংস ধরি তবে গরুর যে রাউন্ড অঞ্চলের মাংস আছে সেখানে ৫৩ মি. গ্রাম কোলেস্টেরল ও সিরলোইন ( sirloin) অঞ্চলে কোলেস্টেরল ৪৭ মি. গ্রাম। অন্যদিকে ১ টা মাঝারি সাইজের ডিমের কুসুমে থাকে ২১২ মি. গ্রাম কোলেস্টেরল। তাহলে কিন্তু দোষ শুধু গরুর মাংসে নয়।
এবার আসি কি কি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাবেন গরুর মাংস থেকে-
*প্রোটিন
* জিংক
* ভিটামিন বি১২
* সেলেনিয়াম
* ফসফরাস
* নায়ামিন
* ভিটামিন বি ৬
* আয়রন
* রিবোফ্লাভিন
আমাদের বিশেষ শিশুদের প্রায় ৮৫-৯০ ভাগ এরই জিংকের ঘাটতি থাকে। এর অন্যতম কারণ তারা "পিকি ইটার"। বেছে বেছে খুব নির্দিষ্ট কিছু খাবার খায়। যার কারণে অনেকেরই ভিটামিন ও মিনারেলসের ঘাটতি থাকে। এই জিংকের একটা ভালো উৎস গরুর মাংস।
জিংকের অভাবে শিশুর মনোযোগ এর ঘাটতি দেখা দেয়, অনেক বেশি অস্থির থাকে ও নিজেকে আঘাত করার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
এখন এই ৮৫ গ্রাম মাংস থেকে যে পরিমান জিংক পাবেন তা যদি টুনা ফিস থেকে নিতে চান তাহলে ১১ টুকরো টুনা ফিস খেতে হবে বা ৭ টুকরো মুরগীর বুকের মাংস। তাহলে বুঝতেই পারছেন সমস্যা খাবারে নয় সমস্যা হলো আমাদের খাবার নির্বাচন, রান্নার পদ্ধতি ও পরিমিত না খাওয়া।
এছাড়াও যে সকল শিশুদের আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এর অভাব আছে তাদের জন্য ও কিন্তু গরুর মাংস একটা ভালো সোর্স।
যুক্তরাষ্ট্রের একটা হেলথ জার্নাল থেকে জানা গেছে, গরুর শরীরের ২ টি অংশের চর্বির পরিমাণ কম থাকে। নিচে ছবিতে সেই অংশ দেখানো হলো
১. Round
2. Sirloin
এই দুই অংশের ব্যাপারে উপরে অলরেডি লিখেছি।
আমাদের বিশেষ শিশুদের আরেকটা সমস্যা হলো হাত খায়, হাত মুখে দেয়, বিভিন্ন জিনিস ধরে মুখে বা জিভে লাগায়। এই জন্য প্রায় ওদের ডায়রিয়া, পেট খারাপ থাকে। কিছু দিন পর পর ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে লবণ, জিংক এর মতো আর ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বেরিয়ে যায়। এই সময় কিছুদিন খাবারে এই মাংস দিতে পারেন। কিমা করে চালের আটা দিয়ে পিঠা, বা বেকড করে কাবাব, বা অলিভ অয়েল দিয়ে গ্রীল করে দিতে পারেন।
আমাদের এঞ্জেলদের immune system অনেক দুর্বল থাকে। গরুর মাংসে থাকা carnosine নামক উপাদান কিন্তু এই immune system কে boost up করে ও সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
গরুর মাংসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো glutatheone, যাকে master anti-oxident বলা হয়। গবেষণা বলছে, অধিকাংশ autistic ও হাইপার এক্টিভ বাচ্চার শরীরে glutatheone এর পরিমাণ কম থাকে। আর এই গ্লুটাথায়োন এর কাজ হলো শিশুর দেহ থেকে toxic metal বের করে দেয়। তাই এই উপাদানের ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করা প্রয়োজন। তাই বুঝতেই পারছেন কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম উপকারি উপাদান থাকে আমাদের খাবারে।
এখন আসি আপনি আপনার বিশেষ শিশুর খাবারে এই মাংস রাখতে পারবেন কিনা?
- হ্যাঁ, সীমিত পরিমাণে খাওয়াতে পারবেন তার চাহিদা অনুসারে।
তবে সতর্কতা
১. যদি সে অতিরিক্ত হাইপার এক্টিভ না হয়।
২. যদি তার টয়লেট অতিরিক্ত কষা না হয়।
৩. যদি মাংসে এলার্জি না থাকে।
৪. যদি সে বয়স অনুযায়ী অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী না হয়।
৫. যদি চিবাতে বা গিলতে কোন সমস্যা না থাকে
৬. হজমে সমস্যা না থাকলে
আমাদের দেশে অটিজম আক্রান্ত শিশু, এডিএইসডি শিশু, ডাউন্স এমনকি সিপি শিশুকে ও অনেকেই গরুর মাংস খেতে নিষেধ করেন। অনেক শিশুর এলার্জি সমস্যা থাকায় কেউ রিস্ক নিতে চায় না তাই গৎবাধা ট্রিটমেন্ট বলে দেন। আমি এতে বিশ্বাসী নই। এটা সত্যি অনেক শিশুর হাইপার এক্টিভিটি কমে গেছে এই রেড মিট অফ করে কিন্তু এই দেশের ১০ লাখ অটিজম শিশুর ই যে এই মাংস অফ করলেই কমে যাবে এটা কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। তাই সবার জন্য অফ নয় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অফ। আর দিবেন কিনা দিলেও কতটুকু দিবেন এই ব্যাপারে কেবলমাত্র একজন রেজিস্টার্ড নিউট্রিশনিস্ট আপনাকে গাইড করতে পারেন অন্য কোন নন প্রফেশনাল ব্যাক্তি নন।
এবার আসি কিভাবে আপনার শিশু কে এই মাংস সপ্তাহে ১ বার দিয়ে দেখবেন। কোন সমস্যা না হলে ১ মাস পর সপ্তাহে ২ দিন দিবেন। এটাই যথেষ্ট বাড়ন্ত একটা শিশুর জন্য।
কিভাবে রান্না করবেন
১. দৃশ্যমান চর্বি ফেলে দিবেন। ছোট টুকরো করে কেটে রান্না করবেন।
২. অলিভ অয়েল, সরিষার তেল, সয়াবিন যেটাই দেন না কেনো একবারে সব মশলা দিয়ে মাখিয়ে ১ চা চামচ তেল দিয়ে দিবেন। গরুর মাংসের নিজস্ব তেল আছে সেই তেল রাম্নার সময় বের হয়ে আসবে।
৩. রান্নার তাপ একি রকম রাখবেন।
৪. টক দই বা কাচা পেপে দিয়ে রান্না করবেন বা যেই সবজি খেতে বাচ্চা পছন্দ করে তার সাথে টুকরো করে দিয়ে রান্না করতে পারেন।
৫. রান্না না খেলে অল্প ডাল অল্প মাংস যোগে কাবাব করে দিতে পারেন। ১-২ পিস খাবে। তেল ব্রাশ করে বেকড করবেন আর চুলায় দিলে অল্প তেলে ভেজে নিবেন।
৬. মিহি করে মাংস বেটে পিঠা করে দিবেন। চালের আটা দিয়ে বানানো পিঠা হলে সংরক্ষন করে খাওয়াবেন না। বানিয়ে সাথে সাথে দিবেন।১ - ২ পিস যাই খাবে।
হজমে সমস্যা থাকলে মাংস না দেয়াই উত্তম কারণ বেশিরভাগ এই হজম হয় না বিধায় খুব অস্থির বা একা একা কান্না করে দেখা যায়। খেয়াল রাখুন, রেকর্ড রাখুন খেলে কি হয়। সমস্যা হলে বাদ দিতে হবে। আবার কিছু শিশু খাবারের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে থাকে। কেউ কেউ গন্ধ নিয়ে তারপর খাবার মুখের কাছে আনে, আবার কেউ গন্ধ দূর থেকে পেলেই চিৎকার দেয়া শুরু করে। অনেক বাচ্চার কাছে গরুর মাংসের গন্ধটা ভালো লাগে আবার অনেকের আছে লাগে না তখন খাবার আশে পাশে দেখলেই কোন না কোন নেগেটিভ আচরণ দেখায়। এটা ভিন্ন বিষয়, সেন্সরি সমস্যা। এমন কিছু দেখলে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করে সমস্যা বলে সমাধান নিবেন।
শিশুর এলার্জি সমস্যা থাকে অনেক কারণেই। গরুর দুধে ও মাংস খেলেও অনেকের হয়। কোন বয়স নাই যেকোন বয়সে হতে পারে। কি কি এলার্জিক রিয়াকশন হয়- বমি, পেট ব্যাথা, ডায়রিয়া, স্কিনে রাশ লালচে, ঘাম হওয়া,পালস কমে যাওয়া। এই লক্ষন দেখা যেতে পারে এলারজি হলে। গুরুতর অবস্থা হলে ডাক্তার এর পরামর্শ লাগবে। আর গরুর মাংস বাদ দিলে মাছ, মুরগি, ডিম, ডাল থেকে প্রাথমিকভাবে প্রোটিন নিবে।
গরুর মাংস চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত খাওয়ালে কিন্তু উল্টো চিত্র হবে। খেয়াল রাখবেন সপ্তাহে কত টুকু দিচ্ছেন। বেশি পানি খাওয়া ও ক্ষতিকর। অতিরিক্ত মাংস খাওয়া মানে অতিরিক্ত প্রোটিন আর বেশি প্রোটিন মানে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। মানে শিশু আরো হাইপার এক্টিভ। আবার শাক সবজি নাই খাবারে একদম ই শুধু মাংস। তাহলে টয়লেট এর প্রেশার থাকবে কিন্তু বের হবে না কষ্ট পাবে বিশেষ শিশুরা এই কষ্ট বলতে পারবে না বুঝাতে পারবে না, কারণ তার যোগাযোগ এ সীমাবদ্ধতা আছে এরপর কান্না করবে চিল্লাবে। তখন আপনার মনে হবে অযথাই কান্না করছে।
মনে রাখবেন আপনার নেয়া একটা পদক্ষেপ কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হোক খাদ্য নির্বাচন বা চিকিৎসা সেবা। এমনিতেই আমাদের বাচ্চা গুলো "পিকি ইটার"। খাবার বাছাই করে অল্প সংখ্যক খাবার খায়। তার উপর আপনি যদি বাছাই করে ওকে খাবার দেন কোন পরামর্শ ছাড়াই তবে কিন্তু সিভিয়ার বা মারাত্মক অভাবজনিত রোগে শিশু ভুগতে পারে। এটা কিন্তু গবেষকরাই বলছেন।
গরুর মাংস নিয়ে লিখেছি তার মানে এটা খাওয়াতেই হবে তা নয়। অন্তত জানা উচিত কি খাওয়াচ্ছি ঠিক আছে কিনা। চেষ্টা করেছি যতো সহজ করে বুঝানো যায় আপনাদেরকে। বিস্তারিত বলার জন্য লেখাটা বেশ বড় হওয়া তে আমি দু:খিত। সময় করে পড়ে নিবেন।
আমার এই লেখা টা বিশেষ শিশুদের উদ্দেশ্য করে হলেও আমি এমন আঙ্গিকে লিখেছি যাতে আপনার অন্য শিশুর ক্ষেত্রে, আপনার জন্য ও পরিবারের সুস্থ ব্যাক্তির জন্য কিন্তু পরোক্ষভাবে পরামর্শ গুলো প্রযোজ্য।
সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন ও আপনাদের দোয়া তে আমার নামটি রাখতে ভুলবেন না।
সুমাইয়া সিরাজী, নিউট্রিশনিস্ট এন্ড স্পেশাল এডুকেটর প্রয়াস, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
- জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটি ভালো?
- দামী নাকি কমদামী কোন সিগারেটে ক্ষতি বেশি?
- ডিম ভাজি না সেদ্ধ, কোনটা বেশি উপকারী?
- প্রোটিন জাতীয় খাবার কোন খাদ্যে বেশি-কোন খাদ্যে কম?
- হার্টের ব্লক খোলার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় রিং বা স্ট্যান্ট
- বডিবিল্ডিং: সাপ্লিমেন্টের গুরুত্ব এবং যেভাবে শুরু করবেন
- কানের ভেতর হঠাৎ পোকা বা কিছু ঢুকে গেলে
- ওসিডি কী? জেনে নিন লক্ষণ
- বাচ্চাদের গুড়াকৃমি প্রতিরোধে কী খাওয়াবেন?
- ফার্মেসি রাত ১২টায় বন্ধের সিদ্ধান্তে বিস্ময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর