হেলাল আহমেদ, আই নিউজ
মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি, হেরে যাচ্ছে জান্তা?
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে কড়াভাবে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য। বিপরীতে মিয়ানমারেও নিজেদের শাসনের সবচেয়ে খারাপ সময় অতিবাহিত করছে জান্তা সরকার। বিদ্রোহীদের তীব্র প্রতিরোধ আর হামলায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তাঁরা। সবশেষ, রাখাইনে শুরু হওয়া সংঘাতেও বিদ্রোহীদের কাছে পিছু হটছে জান্তা বাহিনীর সদস্যরা।
মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি পরিস্থিতির সবশেষ ঘটনা হলো সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশে একজন বাঙালী নারী ও রোহিঙ্গা পুরুষসহ দুই জনের মৃত্যু।
বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউপিটি মিয়ানমার সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি। মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর থেকে এই উপজেলার কয়েকটি এলাকার মানুষ আছেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। গত রোববার নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু এলাকায় বেশ কয়েকটি মর্টারশেল এসে পড়ে। এতে ঐ এলাকার যুধিষ্ঠির ধরের ছেলে প্রবীর ধর আহত হন।
এসব এ ঘটনায় ঢাকায় অবস্থানরত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে কড়াভাবে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) ও সেনাবাহিনীকে ধৈর্য রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের পরিস্তিতি আরও পর্যবেক্ষণ করতে চাইছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটা আলোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই আলোচনার জন্য এবং তাদের (বিজিপি সদস্যদের) ফেরত পাঠানো বা ফেরত পাঠানো না গেলে অন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সেটা নিয়ে কথা বলছি। গতকাল (রোববার) যেটা হয়েছিল, মর্টারশেলে আমাদের একজন মারা গেছে। ওদেরও একজন মারা গেছে। চলমান এ পরিস্থিতি বাংলাদেশ খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এ বিষয়ে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সীমান্তে উত্তেজনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বা প্যারামিলিটারি বাহিনীর (বিজিবি) সদস্যদের ধৈর্য ধারণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বর্ডারের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে, আজকে পর্যন্ত মোট ২২৯ জন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষে না পেরে বাধ্য হয়েই তাঁরা বাংলাদেশ সীমান্তে এসে ঢুকে বিজিবির কাছে আশ্রয় চেয়েছেন।
মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতেও মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া একটি মর্টার শেল এসে পড়েছে। এতে করে ওই মুক্তিযোদ্ধার কেউ হতাহত না হলেও বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বাড়িতে এসে পড়ে মর্টারশেলটি।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত হয়ে মর্টারশেলের অংশ নমুনা হিসেবে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন।
সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে জান্তা
মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি শুরুর অনেকদিন আগ থেকেই মিয়ানমারে বাজে সময় শুরু হয়েছে জান্তা সরকারের। দেশটির একাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে মতানৈক্যর ফলে শুরু হয় সংঘাত। যা এখন গৃহযুদ্ধের মতো চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জান্তা সরকারের শাসনের ৩ বছর সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় এখন পার করছে তাঁরা।
বিগত কয়েকদিনের সংঘাতে বেশ কয়েকটি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার। তাছাড়া, অনেক এলাকা থেকে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন জান্তা সদস্যরা। তাঁদের কেউ কেউ চীন সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে গেছেন। যাদের একাংশ বাংলাদেশ সীমান্তেও প্রবেশ করেছেন।
ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের বিরোধী সশস্ত্র দলে জাতিগত ২০টি গোষ্ঠীর এক লাখ ৩৫ হাজার সদস্য, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এনইউজি এর আওতায় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের ৬৫ হাজার সদস্য, এবং সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্ট মুভমেন্ট-এর অধীনে প্রায় দুই লাখের মতো কর্মী রয়েছে।
এনইউজি-র আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক উপমন্ত্রী ডেভিড গাম অং এর আগে ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, "স্বায়ত্ব শাসনের জন্য লড়ছে এমন কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠীর সাথে ২০২২ সালে জোট গঠন করেছে এনইউজি। এদের এর প্রায় দুই লাখ সেনার একটি বাহিনী রয়েছে যা আরো বাড়তে থাকবে। এটি জেনারেল মিন অং লাইংয়ের বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট।"
অন্য দিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় চার লাখ সেনা রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট ফর পিস-এর তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় দেড় লাখের মতো সেনা রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বা 'কমব্যাট রেডি' ৭০ হাজার সেনাও অন্তর্ভুক্ত।
মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের একটি দল যারা 'স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার' নামে পরিচিত, তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির জান্তা সরকারের “পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ” রয়েছে মাত্র ১৭% ভূখণ্ডের উপর, ২৩% শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে রয়েছে ৫২ শতাংশের মতো ভূখণ্ড। তবে এ তথ্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মিয়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যালায়েন্স-এমএনডিএএ, আরাকান আর্মি এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি যারা যৌথভাবে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত, তারা জানুয়ারিতে উত্তরাঞ্চলের শান রাজ্য থেকে সামরিক বাহিনীকে বিতাড়িত করেছে। ধারণা করা হয়েছিল যে, এর পাল্টা অভিযান চালানো হবে। কিন্তু সেটি এখনো হয়নি। এই রাজ্যে বেশ কয়েকজন জেনারেল-সহ সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে এবং বর্তমানে একটি ভঙ্গুর অস্ত্রবিরতি চলছে।
আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সামরিক বাহিনীর জন্য এটা শুধু এখন একটি পরাজয় নয়, বরং এটা ইঙ্গিত যে, জনপ্রিয়তা হারিয়ে সামরিক বাহিনীর দিন ফুরিয়ে আসছে।
থাইল্যান্ডের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক থিটিনান পংসুধিরাক বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, “মিয়ানমারের এই গৃহযুদ্ধ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের জন্য জেতা অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং এতে পরাজয় এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।”
তিনি বলেন, “সংখ্যার দিক থেকে দেখতে গেলেও এটা বোঝা যায়। তারা প্রতিদিন সেনা হারাচ্ছে, কিন্তু নতুন সেনা ভর্তি হচ্ছে না, শক্তিবৃদ্ধি করা হচ্ছে না, রসদ পুনঃসরবরাহ করা হচ্ছে না, কোনও সেনা আর টহল দিতেও ইচ্ছুক নয় এবং প্রতিনিয়ত তারা আক্রমণের মুখে পড়ছে।” যুদ্ধে টিকে থাকতে তারা বিমান হামলার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনি সেনাবাহিনীর পরাজয় সম্পর্কে বলা যাচ্ছে না। কারণ শান রাজ্যে সমস্যার মুখে পড়লেও অন্যান্য স্থানে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সামরিক বাহিনী।
মানবাধিকার সংস্থা ফ্রি বার্মা রেঞ্জার্স গত সপ্তাহে কারেন রাজ্যের যে চিত্র তুলে এনেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, বিদ্রোহীদের সেখানে সামরিক বাহিনীর কাছে মূল্য দিতে হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে সেখানে সাতজন নিহত হয়েছে এবং ৪০ জন বিদ্রোহী আহত হয়েছে।
মিয়ানমারের একটি ক্রাইসিস গ্রুপের অ্যাডভাইজার রিচার্ড হরসি বলেন, “মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা জান্তা সরকারের জন্য পরাজয় অনিবার্য নয়। তবে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারা জানে যে এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র পথ হচ্ছে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। আর তারা সেটাই করবে। তাই পরাজয় অবশ্যম্ভাবী নয়। তবে এটি গত বেশ কয়েক দশকের তুলনায় এখন কিছুটা বেশি সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছে।”
মিয়ানমারের অভ্যুত্থান-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট
বার্মিজ গণমাদ্যম দ্য ইরাবতী এক প্রতিবেদনে বলছেন, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান হয় ২০২১ সালে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারীতে অভ্যুত্থানের পর থেকে তিন বছরের সময়কালে মিয়ানমারের জনগণ প্রায় সমস্ত পণ্যে ক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির শিকার হয়েছেন। চাল এবং ভোজ্য তেল থেকে শুরু করে জনগনের প্রায় সকল চাহিদা মেটাতে মিয়ানমারের জনগণকে হিমশিম খেতে হয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে মিয়ানমারে ভালো মানের চালের দাম প্রতি বস্তা প্রতি সাড়ে ১৬ ইউএস ডলার ছিল। কিন্তু, ২০২৪ সালে এসে সেই দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪.২০ ডলারে। তিন বছরে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬০ শতাংশের বেশি। একই অবস্থা নিম্নমানের চালের দামেও। ২০২১ সালে এক বস্তা নিম্নমানের চাল যেখানে ছিল ৮.৪০ ডলার ২০২৪ সালে সেই বস্তার দাম বেড়ে অয়েছে ২৭ ডলার। যা তিন বছর আগের থেকে ২২০ শতাংশ বেশি।
জান্তা সরকার মিয়ানমারের শাসনভার নেয়ার পর থেকে বলা যায়, ভোক্তার সেবা লাভের ক্ষেত্রে নাকানিচুবানি খাচ্ছেন মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা এই কারণেও বিদ্রোহীদের জনপ্রিয়তা মিয়ানমারে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। কারণ, সাধারণ মানুষ জান্তা সরকারের উপর আর আস্থা রাখতে চাইছেন না!
তাছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সাধারণের উপর জান্তা বাহিনীর নিপীড়নেও অতিষ্ঠ বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দারা। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি যখন চলছে ঠিক একই সময়ে দেশটির রাজ্যের ডেমোসো টাউনশিপের একটি স্কুলে বিমান হামলা চালায় জান্তার যুদ্ধবিমান। এ হামলায় অন্তত ৪ শিশু শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন।
এসব ঘটনা মিয়ানমারের মানুষকে জান্তা সরকারের প্রতি আরও বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তোলছে ক্রমশ। যদিও, দেশটির বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি বড় অংশ জান্তা সরকারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে শুরু থেকেই।
আই নিউজ/এইচএ
- আইয়ুব খানের পদত্যাগের দিন আজ
- টাই পরা বাদ দিয়ে জ্বালানি সাশ্রয় করতে চান স্পেনের প্রধানমন্ত্রী
- যুদ্ধবন্দী কারাগারে বোমা হামলা, পরস্পরকে দোষছে রাশিয়া-ইউক্রেন
- মাঙ্কিপক্স ঠেকাতে পুরুষদের সেক্স পার্টনার কমানোর পরামর্শ
- আবারও মক্কায় কালো পাথর স্পর্শ-চুম্বনের সুযোগ পাচ্ছেন মুসল্লিরা
- ভারতের স্বাধীনতা দিবস শনিবার
- সুখবর! অক্সফোর্ডের তৃতীয় ট্রায়ালও সফল, ভ্যাকসিন আসছে জুলাইতেই
- চীনা ভূখণ্ডে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশ
- মালিতে সন্ত্রাসী হামলায় ৪২ সেনার মৃত্যু
- টাইমস স্কোয়ারে ‘ট্রাম্প ডেথ ক্লক’