মো. রওশান উজ্জামান রনি
ইন্ডিয়া নাকি ভারত- দেশের নাম পরিবর্তন করা নিয়ে তুমুল বিতর্ক
ইন্ডিয়ার বদলে ভারত । ছবি লিখক
ভারতের নাম পরিবর্তন করা নিয়ে দেশটিতে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দেশটির ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ার বদলে ভারত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে নানান মতামত। দেশের নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা এবার ভারতেরই প্রথম নয়। রাজনৈতিক সামাজিক ভৌগোলিক এবং জাতিগত পরিচয় আরো ভালোভাবে প্রকাশ করার জন্য অতীতেও বেশ কিছু দেশ তাদের নাম পরিবর্তন করেছে।
যেমন পারস্যের নাম বদলে করা হয়েছে ইরান, থাইল্যান্ডের নাম আগে ছিল সিয়াম, ক্যাম্পাসিয়া হয়েছে ক্যাম্বোগিয়া, বার্মা হয়েছে মিয়ানমার, হল্যান্ডের নাম হয়েছে নেদারল্যান্ড, সিংহ থেকে হয়েছে শ্রীলংকা, রোডেশিয়ার নতুন নাম জিম্বাবুয়ে, সোয়াজিল্যান্ডের নাম হয়েছে ইসোয়াতিনি, চেকরিপাবলিক হয়েছে চিজিয়া, তুরস্কের নতুন নাম তুর্কিয়ে, এভাবে নাম পরিবর্তন করা আরো বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে। ভারতের ইংরেজি নাম ইন্ডিয়া বদলে ফেলার পক্ষে বিপক্ষে কি কি যুক্তি রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে আই নিউজের আজকের প্রতিবেদনে।
ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর পাঠানো এক চিঠিকে কেন্দ্র করে দেশটির নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। g20 সম্মেলনে বিদেশি অতিথিদের রাষ্ট্রপতি ভবনের নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানানো চিঠিতে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর পরিচয় হিসেবে প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়ার বদলে লেখা হয়েছিল (The President of Bharat) প্রেসিডেন্ট অফ ভারত। সাধারণত ভারতের আন্তর্জাতিক পরিচয় ইন্ডিয়া হিসেবে। দেশটির দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত নথিপত্রেও ইন্ডিয়া লেখার প্রচলন রয়েছে।
অন্যদিকে ২০ তম আসিয়ান ভারত শীর্ষ সম্মেলন এবং ১৮ তম পূর্ব এশিয়ার শীর্ষ সম্মেলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির ইন্দোনেশিয়া সফরের একটি নোটে প্রাইম মিনিস্টার অফ (INDIA) ইন্ডিয়ার পরিবর্তে প্রাইম মিনিস্টার অফ (Bharat) ভারত শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সামাজিক মাধ্যমে এই নোটের ছবি প্রকাশ করার পর থেকে কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু করে। যদিও এখনো পর্যন্ত ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে ভারতের নাম পরিবর্তনের বিতর্ক এখানেই শেষ হয় না বরং সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া আরেকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক দেশের সীমা অতিক্রম করে। সাউথ এশিয়ান ইন্ডেক্স নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা একটি পোস্টে বলা হয়, জাতিসংঘের স্বীকৃতি সাপেক্ষে ভারত যদি ইন্ডিয়া নাম ত্যাগ করে তাহলে পাকিস্তান এই নামটি নিজেদের জন্য দাবি করতে পারে। কারণ পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদীরা বহুদিন ধরে সিন্ধ প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে ইন্ডিয়া রাখার দাবি জানিয়ে আসছে। এই প্রদেশের প্রাচীন নাম ছিল ইন্দুস। ভাইরাল এই পোস্ট ঘিরে দুই দেশের নেটিজেনদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। দিল্লির জিটুয়েন্টি সম্মেলনে অংশ নিতে আসা জাতিসংঘ মহাসচিব এর মুখপাত্র বলেন, ভারত নাম পরিবর্তনের সব আনুষ্ঠানিকতার শেষ করার পর জাতিসংঘ তাদের নথিপত্রে ইন্ডিয়ার পরিবর্তে ভারত করে দিবে।
অতীতে সবসময় এই অঞ্চল ভারত হিসেবে পরিচিত ছিল না। বিভিন্ন সময়ে ভারতের নাম বিভিন্নভাবে বদলেছে। ৪৫০০ বছর আগে প্রাচীন পারস্যের রাজা এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিল মেলুহা। দুই হাজার ৫০০ বছর আগে পারস্যের সম্রাট দারিয়ুস এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিল হিন্দ। এর মাধ্যমে আসলে সিন্ধু নদের ওপারে বসবাসকারী জনগণকে বোঝানো হতো। ২৩০০ বছর আগে গ্রীক ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিস ইন্ডাসরিবার বা ইন্দুস নদী থেকে এই অঞ্চলের নাম দেন ইন্ডিকা বা ইন্ডিয়া। ২২০০ বছর আগে সম্রাট অশোক ভারতের নাম দিয়েছিলেন জাম্বুদ্বীপ। এই নামের মাধ্যমে বৃহত্তর ভারতের সম্রাট অশোকের রাজত্ব বোঝানো হতো। ২১০০ বছর আগে কলিঙ্গের রাজা কারাভেলা এই অঞ্চলের নাম রাখেন ভারতবর্ষ। ২০০০ বছর আগে হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে এই অঞ্চলকে আরিয়া দেশা বা আর্যদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সকল নাম দ্বারা প্রধানত উত্তর ভারতের এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করা হতো। তাছাড়া তৎকালীন সময়ের সুনির্দিষ্ট কোন ভৌগোলিক মানচিত্র ছিল না। বর্তমানে নতুন করে বিতর্ক শুরু হবার পর ভারতের নাম কি ইন্ডিয়া, ভারতবর্ষ নাকি হিন্দুস্তান হওয়া উচিত তা নিয়ে দেশবাসী একমাত্র হতে পারছে না।
ভারত সরকার যেহেতু এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলেনি তাই নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি গুলো কি কি হতে পারে তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছুই জানা যাচ্ছে না। তবে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা বলছেন ইন্ডিয়া নামটি ভারতের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেকে মনে করেন ইন্ডিয়ান নামটি ব্রিটিশরা দিয়েছিল। সে কারণে উপনিবেশিক এই নাম ভারতের মুছে ফেলা উচিত। যদিও বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। ব্রিটিশদের আসার আগে থেকেই এই অঞ্চলের নাম ছিল ইন্ডিয়া। সেই ইন্ডিয়ার খোঁজেই মূলত পর্তুগিজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো আরো বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ ভারতে এসে পৌঁছে ছিল। ব্রিটিশরা ভারতে পাকাপোক্তভাবে তাদের আস্তানা গড়ে তোলার পর এর নাম দেয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া। উপমহাদেশ স্বাধীন হবার পর ভারতের ইন্ডিয়া নাম প্রাপ্তি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পছন্দ ছিল না। এর কারণ হলো স্বাধীনতার আগে ভারত পাকিস্তান সম্মিলিতভাবে ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই জিন্না মনে করত মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান এবং হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান নামে আলাদা দেশ হওয়া উচিত। কারণ ইন্ডিয়া নামটির একটি বিশাল ব্র্যান্ড ভ্যালু রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত তাদের ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ভ্যালুর সুফল ভোগ করতে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানকে ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করার জন্য শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। ভারত স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ান আর্মি, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান এর কিছুই পায়নি। ভারতের ব্র্যান্ড নেম এর সবচেয়ে বড় আরেকটি দিক হলো ইন্ডিয়ান ওশান। ইন্ডিয়ার মত একটি দেশের নামে একটি মহাসাগরের নাম হওয়ায় চীনারা এই নামটি মোটেও পছন্দ করেনা। কিছুদিন আগে ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট বা ইন্ডিয়ান এলাইন্স বা ( I.N.D.I.A) নামে ২৬ দলের একটি জোট গড়ে তোলা হয়। বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ নির্বাচনী জোট ইন্ডিয়াকে খাটো করতেই দেশের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার।
ভারত যদি তাদের নাম বদলে ফেলে তাহলে দেশটির বেশ কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ও নাম বদলে ফেলতে হবে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স বদলে হবে ভারত ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা (ISRO) ইসরো হবে ভারত স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা (BSRO) বিসরো। নাম বদলের সাথে সাথে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্জন ও কিছুটা ম্লান হয়ে যাবে। সেই সাথে ভারত তার বহুমূল্যবান ব্র্যান্ড ভ্যালু হারাবে। যার কারণে রপ্তানি বাজারসহ আন্তর্জাতিক মহলের দেশটিকে পদে পদে ভুগতে হবে। ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ওয়ান এ বলা হয়েছে ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত। তার মানে ইন্ডিয়াই ভারত। সেদিক থেকে সংবিধান অনুযায়ী ভারত আর ইন্ডিয়া নিয়ে কোন বিতর্কই হওয়া উচিত নয়। সাধারণত একটি দেশ তখনই তাদের নাম বদলায় যখন এসেই দেশের জনগণের সাথে অনেক বড় কোন ঘটনা ঘটে। হতে পারে তারা কোন উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করছে। অথবা দেশটিতে কোন বিপ্লব সাধিত হয়েছে। অথবা দেশের সাংবিধানিক কোনো বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে। অথবা দেশটি তাদের নামের কারণে কোন না কোন ভাবে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনটি ঘটেনি। অতীতে আমাদের দেশের নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান। পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমরা বাংলাদেশ হয়েছি। শ্রীলংকা তাদের বহু সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ করার জন্য এবং উপনিবেশিক উত্তরাধিকার ছিন্ন করার জন্য সিলন থেকে শ্রীলংকা নাম ধারণ করেছে। সাধারণত যেসব দেশ তাদের উপনিবেশিক উত্তরাধিকারের কারণে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকে তারাই এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে উপনিবেশিক উত্তরাধিকার একাধিক সুবিধা হিসেবে যোগ হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের শাসনকে দেশের জন্য নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করে বার্মা থেকে মিয়ানমার নাম রেখেছে। থাইল্যান্ডে পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে উপেক্ষা করার জন্য প্রাচীর নাম সিয়াম থেকে থাইনেন্ড রাখা হয়েছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে নাম বদল করেছে তুরস্ক। ইংরেজিতে একে বলা হতো টার্কি কিন্তু টার্কি দ্বারা ইংরেজি ভাষায় এক ধরনের বিশেষ মুরগিকে বোঝানো হতো। সে কারণে তুরস্ক নাম বদলে তুরকিয়ে নাম ধারণ করেছে। তুরস্কের নাম বদলের পেছনে আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
আই নিউজ/আর
আরও পড়ুন
- আইয়ুব খানের পদত্যাগের দিন আজ
- টাই পরা বাদ দিয়ে জ্বালানি সাশ্রয় করতে চান স্পেনের প্রধানমন্ত্রী
- যুদ্ধবন্দী কারাগারে বোমা হামলা, পরস্পরকে দোষছে রাশিয়া-ইউক্রেন
- মাঙ্কিপক্স ঠেকাতে পুরুষদের সেক্স পার্টনার কমানোর পরামর্শ
- আবারও মক্কায় কালো পাথর স্পর্শ-চুম্বনের সুযোগ পাচ্ছেন মুসল্লিরা
- ভারতের স্বাধীনতা দিবস শনিবার
- সুখবর! অক্সফোর্ডের তৃতীয় ট্রায়ালও সফল, ভ্যাকসিন আসছে জুলাইতেই
- চীনা ভূখণ্ডে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশ
- মালিতে সন্ত্রাসী হামলায় ৪২ সেনার মৃত্যু
- টাইমস স্কোয়ারে ‘ট্রাম্প ডেথ ক্লক’