শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১৯:০৭, ৩০ জুলাই ২০২২
যাত্রাপালার যাত্রাপথ (দ্বিতীয় পর্ব)
যাত্রাপালার শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতা : অতীত থেকে বর্তমান
![](https://www.eyenews.news/media/imgAll/2021April/zatrapala-bangladesh-culture-eyenews-feature-eyenews-shyamlalgoshai-eyenews-2207301638.jpg)
সামাজিক শিক্ষা বা লোকশিক্ষার ক্ষেত্রেও যাত্রাপালার আছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। আদি যাত্রাপালার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় শুরুর দিকের যাত্রাপালাগুলো মূলত কাহিনী নির্ভর, আর সেসব কাহিনী জুড়ে আছে ধর্মীয় সব চরিত্র। সেসব চরিত্রের কেউ ন্যায় করছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ আবার অন্যায়ের পক্ষ নিচ্ছে। কিন্তু সবশেষে বিজয় হচ্ছে ন্যায়ের এবং পরাজিত হচ্ছে অন্যায়। এসবই আমাদের শুরুর দিকের যাত্রাপালার বিষয়বস্তু। তাই সেসময় যাত্রাপালা নেহাতই বিনোদনের মাধ্যম ছিলো, ছিলো লোকশিক্ষার্জনেরও এক সাংস্কৃতিক পাঠশালা।
যশোরের মণিরামপুর এলাকার জনৈক লংকেশ্বর গাইনের কথা বলি। লংকেশ্বরের ভূমিকা এলো মঞ্চে আজান দেবার। পেশায় কৃষক এই ছেলেটি ছুটতে লাগলো গ্রামের বিভিন্ন মসজিদের মোয়াজ্জিমদের কাছে। রাত-বিরেতে তাদের কাছে ঘুরে মোয়াজ্জিমদের মাথা নষ্ট করে দিচ্ছিলো সনাতন লংকেশ্বর। কারণ, লংকেশ্বর আজান শিখে সে আজান নিজের কণ্ঠে তুলতে চায়। পালায় তাকে এটা গাইতে হবে। সারাদিন কৃষিমাঠে কাজ শেষ করে লংকেশ্বর ছুটে আসতো মোয়াজ্জিমদের কাছে আজান শেখানোর জন্য।
সেসময়কার সমাজব্যবস্থা ছিলো অন্যরকম। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা যে ছিলো না তা নয়। কিন্তু এখনকার মতো অবস্থা ছিলো না। মোয়াজ্জিমরাও লংকেশ্বরকে আজান শেখালেন। লংকেশ্বর সেই আজান শিখলো, মাঠে খালি জায়গা পেলেই দুই হাত কানে রেখে আজান দিতো। লংকেশ্বরের সেই আজান ধ্বনি পরবর্তীতে ব্রজেন দে রচিত ঐতিহাসিক যাত্রাপালা 'বাঙালী'র শেষ দৃশ্যেও ব্যবহার করা হয়েছিলো। লংকেশ্বরের সেই আজান শুনে অনেকে মন্তব্য করছিলেন- এ কোন হিন্দু ছেলের আজান হতেই পারে না। এমনই সুন্দর করে আজান দিতে পেরেছিলো লংকেশ্বর।
যাত্রাপালার তৎকালীন পরিবেশও ছিলো সেরকম। যারা যাত্রাশিল্পী ছিলেন সবটুকু দরদ দিয়ে চাইতেন নিজের অংশটুকু মঞ্চে পরিবেশন করতে। লংকেশ্বরের আজানের ঘটনা সেসব গালগপ্পের প্রমাণ। যাত্রার প্রতি লংকেশ্বরের মতো প্রেম-প্রীতি আর একাত্মতা এখনকার শিল্পীদের মাঝে কতোখানি আছে তা বিবেচনার বিষয়। অবশ্য বিভিন্ন মঞ্চে আজও দুই একজন ভালো অভিনেতার দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু তা একেবারেই হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র।
আজকের দিনের যাত্রাশিল্পীরা অভিনয়ের চেয়ে অর্থের দিকেই বেশি মনযোগী। একটি চরিত্রকে রূপায়নের ক্ষেত্রে তারা যতোনা চেষ্টা করেন তারচেয়ে বেশি তাদের চেষ্টা থাকে অর্থের ব্যাপারে। তাই আজকের দিনের যাত্রার মান নিয়েও যথেষ্ট আলোচনার দরকার আছে।
তবে এও স্বীকার্য যে যাত্রাপালা 'সিজনাল' শিল্প হওয়ায় যাত্রার মৌসুমের পরে বাধ্য হয়েই যাত্রাশিল্পীদের রুটি-রুজির জন্য ভিন্ন পেশা অবলম্বন করতে হয়। ফলে একজন যাত্রাশিল্পীর পক্ষে যাত্রায় অখণ্ড মনযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। জৈবিক বাস্তবতায় যাত্রাশিল্পীরা এখন মৃতপ্রায়। যাত্রাপালার অবস্থায় সেরকমই। মানসম্মত পালা আজকাল আর দেখা যায় না, পালার নামে যাকিছুই অবশিষ্ট আছে তা কেবলই সংস্কৃতির নামে সামাজিক অপসংস্কৃতির এক আয়োজন বলা যেতে পারে।
অথচ সামাজিক শিক্ষা বা লোকশিক্ষার ক্ষেত্রেও যাত্রাপালার আছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। আদি যাত্রাপালার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় শুরুর দিকের যাত্রাপালাগুলো মূলত কাহিনী নির্ভর, আর সেসব কাহিনী জুড়ে আছে ধর্মীয় সব চরিত্র। সেসব চরিত্রের কেউ ন্যায় করছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ আবার অন্যায়ের পক্ষ নিচ্ছে। কিন্তু সবশেষে বিজয় হচ্ছে ন্যায়ের এবং পরাজিত হচ্ছে অন্যায়। এসবই আমাদের শুরুর দিকের যাত্রাপালার বিষয়বস্তু। তাই সেসময় যাত্রাপালা নেহাতই বিনোদনের মাধ্যম ছিলো, ছিলো লোকশিক্ষার্জনেরও এক সাংস্কৃতিক পাঠশালা।
আধুনিককালে এসে যাত্রাপালার কথিত যে আধুনিক সংস্করণ বর্তমানে দেখা যায় সেসব দেখা অনেকটা গুল দিয়ে দুধের সাধ মেটানোর মতো ব্যাপার। ভালো কোনো গল্প নেই, নেই পালার আমেজ। ডিজে বাজিয়ে পালার আসরে নারী-পুরুষের যৌথ উশৃঙ্খলতাই আজকাল যাত্রার উপজীব্য বিষয়।
লেখক: শ্যামলাল গোসাঁই
সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও কবি
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা