শিল্প ও সাহিত্য ডেস্ক
আপডেট: ১৭:০৫, ১৭ নভেম্বর ২০২০
জীবনানন্দের জীবনে বুদ্ধদেব বসু
বিংশ শতাব্দীর নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি বুদ্ধদেব বসু
জীবনানন্দ দাশকে আজ আমরা যত ভাবে চিনি, তার প্রথম পরিচয়টি করিয়ে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এটি সাহিত্যের ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের বিখ্যাত ওয়েস্টল্যান্ড কবিতাটি কিছুটা ঘষামাজা করে এজরা পাউন্ড ছাপার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন; তার আগে অবশ্য প্রুফকের ভালবাসার গানেও হাত লাগিয়েছিলেন তিনি। এলিয়ট ওয়েস্টল্যান্ডের উৎসর্গ পত্রে পাউন্ডকে উস্তাদ কারিগর হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, অথচ এই দুই কবির বয়সের পার্থক্য ছিল খুব সামান্য; পাউন্ড ছিলেন এলিয়টের চেয়ে মাত্র বছর তিনেকের বড়; কিন্তু কবি হিসেবে এলিয়টের আগেই তিনি মান্যতা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ আর বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটেছিল ঠিক উল্টো। বুদ্ধদেব বসু যদিও জীবনানন্দ দাশের উস্তাদ নন, কিন্তু তাঁর উস্তাদিগুণের কারণে তৎকালীন আত্মরতিময় সাহিত্যের জগতে জীবনানন্দেরও কিছুটা ঠাঁই হতে শুরু করেছিল। জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে পাউন্ড-এলিয়টের তুলনায় বয়সের বিস্তর পার্থক্য ছিল। জীবনানন্দ দাশের চেয়ে বুদ্ধদেব বসু প্রায় বছর দশেকের কনিষ্ঠ হলেও দুজনই তিরিশের দশকের শক্তিশালী কাব্যনির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তবে বয়সের বিস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসুর কবিখ্যাতি বাংলা কবিতার পাঠকদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এ কথা আজ সত্যিই গভীরভাবে ভাবার দরকার আছে; বুদ্ধদেব ছাড়া জীবনানন্দের কী দশাই না হত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন সমকালীন কবিদের প্রতি আশার বাণী বর্ষণ করে চলছেন, তখনও জীবনানন্দ দাশের জন্য তা অবারিত ছিল না। ভালো কবিতা লেখা যেমন একটা ক্ষমতার পরিচায়ক, তেমনি ভালো কবিতা পাঠের রুচি তৈরিও সাহিত্যে একটি ঘটনা। জীবনানন্দ যদি সত্যিই ভালো কবিতা লিখে থাকতেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা কাব্যপাঠককে আকৃষ্ট করতে পারল না কেন? এই প্রশ্নটির মধ্যেই নিহিত আছে বুদ্ধদেব বসুর মতো উস্তাদ কারিগরের কারিশমা। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশের পরপরই বুদ্ধদেব বসু একটি নাতিদীর্ঘ সমালোচনা লিখে এই কবিকে পাঠ করার জন্য পাঠককে রীতিমতো জবরদস্তি করতে থাকেন। তাঁর মতে, এমন লেখা বাংলা কবিতায় এর আগে কখনো দেখা যায়নি; আর এখানেই বুদ্ধদেব বসুর মহত্ত্বের জুরি মেলা ভার। কেননা বুদ্ধদেব ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত আত্মমুগ্ধ একজন লেখক, যিনি চাইলেই জীবনানন্দ দাশের বিষয়-শৈলীর মৌলিকত্ব তুলে তার বারোটা বাজাতে পারতেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু সারাজীবন তাঁর পূর্বসূরি রবীন্দ্র-নজরুলের মতো সাহিত্যে সম্ভাবনাময় সবকিছুকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় দুই দশকে বুদ্ধদেব বসু জীবননানন্দ দাশকে নিয়ে তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই গ্রন্থ প্রকাশের একই বছরে তার রচিত ‘জীবনানন্দ দাশ : ধূসর পাণ্ডুলিপি’ শীর্ষক রচনায় কবি সম্বন্ধে যেসব মন্তব্য করেছিলেন, দুর্ভাগ্য সৌভাগ্যবশত সেগুলোই কবির নামের সঙ্গে মার্কা মেরে গেছে। আমি ঠিক জানি না, ধূসর পাণ্ডুলিপির কবিকে ‘প্রকৃতির কবি’ বলা যায় কিনা। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তাকে সেদিন প্রকৃতির কবি বলেই উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ওর্ডসওয়ার্থ ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রকৃতির বিপুল সম্ভার সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশকেই প্রকৃত প্রকৃতির কবি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। যদিও প্রকৃতির কবি শুনতে অনেকটা গ্রামীণজীবনের কাব্যনির্মাতা মনে হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু জীবনানন্দ দাশের চেতনার মধ্যে মোটেও গ্রামীণজীবনের সাদামাটা জীবনচিত্র ছিল না। তবে আমার মনে হয়, বুদ্ধদেব বসুর সেদিনের এই আবিষ্কারটি যে যথার্থ ছিল, শেষ পর্যন্ত কবির ‘রূপসী বাংলা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার পরিণতি পেয়েছে; যদিও এই কাব্যগ্রন্থটি কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর এ আলোচনায় জীবনানন্দ দাশকে গভীর থেকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন। এমনকি তখনও তাঁর নামটি এমনই অপরিচয়ের আবরণে ঢাকা ছিল যে, তাঁর নামটি পর্যন্ত অধিকাংশ লোক শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে পারতেন না, শ্রীমান বসুর ভাষ্যানুসারে লোকে বলতেন, ‘জীবানন্দ’। যদিও বুদ্ধদেব এটা উল্লেখ করতে ভোলেননি, ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়লে অনেকেরই তরুণ ইয়েটস কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এলিয়টকে মনে পড়তে পারে; তবু তিনি যা করেছেন তা বাংলা কবিতার জন্য সম্পূর্ণ নতুন। তার বিষয় আঙ্গিক ভাষা পরিবেশনা তার পূর্ববর্তী সবার চেয়ে আলাদা; এমনকি দুরূহ ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের থেকেও তিনি আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। বুদ্ধদেব বসুর পর্যবেক্ষণ হল, রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র ছন্দটিকে তিনি অবলম্বন করেছেন বটে কিন্তু তার চলনের ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। অথচ মাত্র বছর আটেক আগে এই কবিই তাঁর পূর্বসূরিদের পথ ধরে কাব্যাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের স্বভাব এবং তার কাব্যের নতুনত্ব দেখে বুদ্ধদেব বসু এ আশঙ্কা করতেও ভোলেননি যে, তিনি বাঙালি কাব্য সমাজে অপরিচিত থেকে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কারণ থাকবে না। কিন্তু সে পথের কাঁটা বুদ্ধদেব বসু কিছুটা দূর করে দিয়েছিলেন এই স্বীকৃতি তাকে দিতেই হবে। বনলতা সেন লেখার ফলে জীবনানন্দ দাশকে সাধারণ কাব্যপাঠকরা প্রেমের কবি হিসেবে উল্লেখ করলেও বুদ্ধদেব বসু টের পেয়েছিলেন, প্রেমের কবিতা লেখা এই কবির ধাতে নেই; দু-একটা চরণ কখনো নর-নারীর প্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে ঝলসে উঠলেও পরক্ষণেই জীবনের গহীন-গহন অন্ধকারে তা হারিয়ে গেছে। আমার মনে হয়, জীবনানন্দ দাশের কাব্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে চিত্রকল্পময়তার অনুযোগ তুলেছিলেন, সেটিও মনে হয় বুদ্ধদেব বসু থেকে ধার করা; কারণ বুদ্ধদেব বসু ধূসর পাণ্ডুলিপি-র পরপরই বলেন, ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যে দেখা যায় যে চিত্ররচনার অজস্রতা, তার বিশেষত্বও উল্লেখযোগ্য। যত উপমায়, যত ইঙ্গিতে তিনি কল্পনাকে প্রকাশ করেন, সেগুলো ভাবাত্মক নয়, রূপাত্মক; চিন্তাপ্রসূত নয়, অনুভূতিপ্রসূত।’
জীবনানন্দ দাশের কবিতার কৌশল নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, এই কবির কান অত্যন্ত সজাগ। ছন্দকে ইচ্ছেমতো বেকিয়ে-চুরিয়ে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। যেখানে বাধা পেয়েছেন সেখানে বাধাটাই যেন কবির অভিপ্রেত। ইংরেজি শব্দগুলোকেও তিনি এমনভাবে বাংলার সঙ্গে মিশেল দিয়েছেন, যাতে মনে হয় এই শব্দগুলো যেন এই ধরনের সম্পর্কের জন্য অপেক্ষা করেছিল। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য এটি দেখাতে ভোলেননি যে, কোথায় তিনি শেলি, কীটস, সুইনবার্গ, এলিয়ট বা ইয়েটসের শরণাপন্ন হয়েছেন। তবে তিনি একবারও বলেননি, এসব গ্রহণ ও আত্তীকরণ বাংলা কবিতার জন্য কিংবা জীবনানন্দ দাশের জন্য মন্দ হয়েছে; বরং এটি যে কবির জন্য দুর্বার ক্ষমতার প্রশ্ন এটিই স্বীকার করেছেন। কারণ তিরিশের প্রায় সব কবিই ইংরেজি সাহিত্য ভালো করে পাঠ করেছেন বলে প্রমাণ মেলে; কিন্তু জীবনানন্দ দাশ যে ক্ষমতা ও নতুনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা আর কারো জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।
বনলতা সেন প্রকাশের পরও বুদ্ধদেব বসু ১৯৪৩ সালে তাকে নিয়ে একইভাবে আলোচনা করেন। এ সময়ে জীবনানন্দ দাশ যথেষ্ট পরিণত হলেও কবিখ্যাতি তাঁর জন্য খুব একটা বিস্তার লাভ করেনি; ফলে বুদ্ধদেবের প্রচারের দায়িত্বটি তাঁর জন্য জরুরি ছিল এটি বলাই যায়। তিনি টের পেয়েছিলেন যে, তাঁর কবিতা পড়লে যেভাবে কানে লেগে থাকে সে অনুপাতে পাঠক তাঁকে তখন পর্যন্ত নিতে পারেননি; বরং কবিসমাজ ভেতরে ভেতরে তাঁর অনুকরণের লোভ সংবরণ করতে পারছেন না। তবে বুদ্ধদেব বসুদের মতে, তিরিশের দশকটি বাংলা কবিতা মূলত ঐতিহ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় অতিক্রম করছে; সেদিক দিয়ে জীবনানন্দ দাশ তখন পর্যন্ত কবিতার প্রতি অনুরক্ত রয়েছেন; যদিও বুদ্ধদেব বসু বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখেছেন, তবু এটি জীবনানন্দ দাশের জন্য এটি একটি শ্লেষাকারে উপস্থিত ছিল। জীবনানন্দ দাশ প্রয়াত হওয়ার পরপরই বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৫ সালে ‘জীবনানন্দ দাশের স্মরণে’ নামে একটি বড়সড় প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধে একজন কবি জীবনানন্দ দাশ ও মানুষ জীবনানন্দ দাশকে যেভাবে তিনি অঙ্কন করেছেন, আমি গভীরভাবে লক্ষ করেছি যে, পরবর্তী জীবনানন্দ ব্যাখ্যাতাদের জন্য খুব বেশি নতুন কিছু বলার রাখেননি; তথ্য ও টীকাটিপ্পনি ছাড়া। যদিও তার অনেক মতের পক্ষ-বিপক্ষ যুক্তির অভাব নেই; তবু সেগুলোকে আবর্তন করেই মূলত জীবনানন্দ দাশের কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এখনো এগিয়ে চলছে।
সূত্র: বঙ্গদর্শন
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা