শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ১৯:৫৪, ১৭ জানুয়ারি ২০২১
যে সময়ে রচিত হয়নি কোনো বাঙলা সাহিত্য!
ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘যদি তুমি চোখ মেলো বাঙলা সাহিত্যের দিকে, তাহলে দেখবে জ্বলছে হাজার হাজার প্রদীপ; লাল, নীল সবুজ, আবার কালোও। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধ’রে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য।‘
বাঙলা সাহিত্য একদিনে গড়ে ওঠেনি; কিংবা জন্ম নেয়নি শুধুমাত্র একটি জাতির উদরজাত সন্তান হিশেবে। বাঙলা সাহিত্যে মিশেছে অজস্ব জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি। এর ফলে বাঙলা সাহিত্য হয়েছে সমৃদ্ধ।
বাঙলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্য হয়ে ওঠতে সময় নিয়েছে এক হাজার বছর। এই এক হাজার বছর বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন বিভিন্ন সাহিত্যিকরা। চর্যাপদ অনুযায়ী আমাদের আদি কবিরা হচ্ছেন, কাহ্নপাদ, লুইপাদ, সরহপাদ, চাটিল্লপাদ, ডোম্বিপাদ, ঢেন্টপাদন, শবরপাদ। প্রায় এক হাজার বছর আগে বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের এই আদি কবিরা।
ভাষা বিজ্ঞানীদের ধারণা চর্যাপদ রচিত হয়েছিলো ৯৫০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে। এই সময় থেকে শুরু করে আধুনিক বাঙলা সাহিত্য পর্যন্ত তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে বাঙলা সাহিত্যকে। যুগ তিনটি হলো: প্রাচীন যুগ (৯৫০ থেকে ১২০০ অব্দ পর্যন্ত), মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০ অব্দ পর্যন্ত। এই যুগটিকে বাঙলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা হয়। লেখাটি এই বিষয় ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবো।), আধুনিক যুগ (১৮০০ থেকে
চর্যাপদ রচনার পরেই বাঙলা সাহিত্যে নেমে আসে ভয়াল অন্ধকার। যা স্থায়ি হয়েছিলো প্রায় দেড়শো বছর। ১২০০ অব্দ থেকে ১৩৫০ অব্দ পর্যন্ত কোনো সাহিত্য রচনা হয়নি! এই সময়ে আমাদের কোনো সাহিত্যিক ইতিহাস নেই! যে কারণে বাঙলা সাহিত্যের এই সময়টাকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়।
কারণ, এই যুগটির দিকে তাকালে আমাদের চোখে কোনো আলো ধরা দেয় না। এই সময়টার চারদিকে ধূ ধূ অন্ধকার। কিন্তু কেন? ওই সময়ে কি আমাদের কোনো কবি বেঁচে ছিলেন না? তারা কোনো সাহিত্য রচনা করেন নি?
রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ১২০০ থেকে ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাঙলায় মুসলমানদের আগমন ঘটে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বন বখতিয়ার খলযির নেতৃত্বে। ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে নদীয়ার রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাঙলা জয় করেন।
অর্থাৎ বাঙলা সাহিত্যের এই সময়টাতে এদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। তবে কী আগত বেপরোয়া মুসলমান শাসকরা সাহিত্য রচিত হতে দেয় নি? আমাদের মনে রাখা দরকার ১৮০০ অব্দের আগ পর্যন্ত যেসব সাহিত্য কর্ম রচিত হয়েছে এর সবই গান কিংবা পুঁথি আকারে। যার উদাহরণ স্বরূপ আমরা মঙ্গলকাব্য , শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি পাই। এসব পুঁথি বা গান যারা রচনা করতেন তারা মুখে মুখেই রচনা করতেন আবার গাইতেন। লিখে রাখার কোনো প্রয়োজন মনে করেন নি তারা। তাঁদের সাথে যারা শুনতেন তারাও অনুরূপ মুখস্ত করে রাখতেন।
তাই বলা যায় মুসলিমরা যখন এই অঞ্চলে প্রবেশ করেন সে সময়ও বাঙলা সাহিত্যের লেখা চল শুরু হয়নি। সাহিত্যের ইতিহাসেও বলা হয় যে, ১৮০০ অব্দের আগে যা কিছু রচিত হয়েছে, সেসবকিছুই গাওয়ার জন্য। কিন্তু যেহেতু এই সময়ে মুসলিমরা এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে তাই অনেকের দাবি- মুসলমানরা এতো অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়েছিলো যে কারো মনে সাহিত্যের ফুল ফোটেনি। কিন্তু এ যুক্তিও মানা যায় না কারণ কোনো জায়গাতেই দেড়শো বছর রক্তারক্তি চলতে পারে না। আর রক্তারক্তি হলেও মানুষ মরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওই সময়ে তো মানুষ ছিলো, শুধু ছিলো না সাহিত্য। মানুষ থাকবে আর সাহিত্য রচিত হবে না তা হবার নয়।
তাহলে কী ঘটেছিলো বাঙলা সাহিত্যের সাথে এই অন্ধকার সময়টাতে? আগেই লিখেছি- ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যে যা কিছু রচিত হয়েছে তা শুধুমাত্র গাওয়ার উদ্দেশ্যেই। বাঙলা সাহিত্য তখনো লিখিত রূপ লাভ করেনি। তাই আর তখন তো এখনকার মতো ছাপাখানাও ছিলো না।
তাই তারা সাহিত্য রচনা করতেন মুখে মুখে। একজনের মুখে যে কবিতাটি রচিত হতো ভালো লাগলে সেটি আরও অনেকের কাছে পৌঁছে যেতো মুখে মুখেই। বই লাগতো না। এসব কবিতা বেঁচে থাকতো মানুষের স্মৃতিতে, আড্ডায়, গানের বৈঠকিতে।
বাঙলা সাহিত্যের ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হচ্ছে যে সময়কে সেই সময় সাহিত্য রচিত হয়েছে মুখে মুখে। যেহেতু লিখিত সাহিত্যিক রূপ তখনো বাঙলা সাহিত্য পায় নি তাই সেসব সাহিত্য আবার হারিয়েও গেছে। এখানে এসে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ‘তাহলে দশম শতাব্দীতে রচিত লিখিত অবস্থায় চর্যাপদ পাওয়া গেলো কীভাবে?’
আমাদেরকে মনে রাখা দরকার যে চর্যাপদ কিন্তু বাঙলাদেশে বা ভারতে পাওয়া যায়নি; পাওয়া গেছে সুদূর নেপালে। নেপালের ভাষা যেহেতু বাঙলা নয় তাহলে আমাদের চর্যাপদ সে দেশে কেন গেল? আর কীভাবেই বা গেল?
আসলে বাঙলা ভাষার ধারাবাহিক ইতিহাসকে জানার জন্য প্রয়োজন ছিল এই ভাষাটিকে লিখে রাখার। ১২০০ থেকে ১৩৫০ অব্দ পর্যন্ত অন্ধকার এই সময়ে আমাদের কোনও আদি কবি কিছুই লিখে রাখেন নি। কবিতা তখন গাওয়ার জন্য ছিলো, পড়ার জন্য নয়। আর আমাদের আদি কবিরা গাওয়ার জন্য মুখে মুখে যা রচনা করতেন তা লিখে রাখার দরকার মনে করেন নি।
তাই তো বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাটলে ১২০০ অব্দ থেকে ১৩৫০ অব্দের মধ্যকার সময়টিতে এসে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কারণ, এই সময়ে আমাদের কোনও সাহিত্য রচিত হয়নি! লুইপাদ, কাহ্নপাদ, শবরপাদ নামক বাঙলা সাহিত্যের আদি কবিরা এই সময়ে এসে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছেন!
- তথ্যসূত্র: লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী, হুমায়ুদ আজাদ, রোয়ার বাংলা, বাংলা ভাষার ইতিহাস
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা