অরুণ কুমার দাশ
আপডেট: ২৩:১০, ১৫ জুন ২০২১
‘কবির বর্ষা, রবির বর্ষা’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহুর্তকে লেখায় রূপ দিয়েছেন সহজ, সরল এবং সাবলীলভাবে সাধারণের করে। লেখা পড়ে মনে হয় আহা এটা তো আমার মনেরই ভাবনা! গান শুনে মনে হয় এই যে আমার জন্যই গাওয়া। ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতিটি বর্ষাও কবির কাছে এসেছে তাই নতুন প্রাণ, নতুন গান হয়ে।
আমরা যারা কবিকে টুকটাক চিনি তারা সবাই জানি সব ঋতুর মধ্যে ‘বর্ষা’ ঋতু ছিলো কবির প্রিয় ঋতু। তাইতো কবি বর্ষাকে আকর দিয়ে সবুজ করেছেন, সতেজ করেছেন, প্রাণ চঞ্চল করে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন।
বর্ষার ভিতরের যে রূপ, বৈচিত্র্য, ছন্দ, বহে যাওয়ার চলন এসব কবিকে আপ্লুত করে দেওয়ার মুহুর্তগুলো আমরা পাই কবির গান, কবির কবিতায়।
কবি তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থের ‘বর্ষা ও শরৎ’ নিবন্ধে বালক-বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছেন...
‘বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া তখনকার বর্ষার দিনগুলি। বাতাসের বেড়ো জলের ছাঁটে বারান্দা একেবারে ভাসিয়া যাইতেছে, সারি সারি ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ হইয়াছে, প্যারীবুড়ি কক্ষে একটি বড় ঝুড়িতে তরিতরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জলকাপা ভাঙিয়া আসিতেছে আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় ছুটিয়া বেড়াইতেছি। আর মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি, দরমায় ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাস বসিয়াছে; অপরাহ্নে ঘর ঘোর মেঘের স্তূপে স্তূপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে। দেখিতে দেখিতে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি নামিয়া আসিল; থাকিয়া থাকিয়া দীর্ঘ একটানা মেঘ ডাকার শব্দ; আকাশটাকে যেন বিদ্যুতের নখ দিয়া এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত কোন পাগলী ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া ফেলিতেছে; বাতাসের দমকায় দরমার বেড়া ভাঙিয়া পড়িতে চায়; অন্ধকারে ভালো করিয়া বাইরের অক্ষর দেখা যায় না- পণ্ডিত মশায় পড়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন; বাইরের ঝড়-বাদলটার উপরেই ছুটাছুটি, মাতামাতির বরাত দিয়া বন্ধ ছুটিতে বেঞ্চির উপরে বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে মনটাকে তেপান্তরের মাঠ পার করিয়া দৌড় করাইতেছি। আরো মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্য দিয়া ঘন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে; একটু যেই ঘুম ভাঙিতেছে মনে মনে প্রার্থনা করিতেছি, সকালেও যেন বৃষ্টির বিরাম না হয় এবং বাহিরে গিয়া যেন দেখিতে পাই, আমাদের গলিতেই জল দাঁড়াইয়াছে এবং পুকুর ঘাটের একটি ধাপও আর জাগিয়া নাই।
অরুণ কুমার দাশ
‘বসন্ত ও বর্ষার’ নিবন্ধে বর্ষার চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বসন্ত এবং বর্ষার তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ এইভাবে...
'বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বর্ষা সংসারী, গৃহী। বসন্ত আমাদের মনকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, বর্ষা তাহাকে এক স্থানে ঘনিভূত করিয়া রাখে। বসন্তে আমাদের মন অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যায়, বাতাসের উপর ভাসিতে থাকে, ফুলের গন্ধ মাতাল হইয়া জোৎস্নার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ে; আমাদের মন বাতাসের মতো, ফুলের গন্ধের মতো, জ্যোৎস্নার মতো লঘু হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। বসন্তেত বহির্জগৎ গৃহদ্বার উদ্ঘাটন করিয়া আমাদের মনকে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যায়। বর্ষায় আমাদের মনের চারিদিকে বৃষ্টিজলের যবনিকা টানিয়া দেয় মাথার উপরে মেঘের চাঁদোয়া খাটইয়া দেয়। মন চারিদিক হইতে ফিরিয়া আসিয়া এই যবনিকার মধ্যে এই চাঁদোয়ার তলে একত্র হয়। পাখির গানে আমাদের মন উড়াইয়া লইয়া যায়, কিন্তু বর্ষার বজ্রসংগীতে আমাদের মনকে মনের মধ্যে স্তম্ভিত করিয়া রাখে। পাখির গানের মতো এই গান লঘু, তরঙ্গময় বৈচিত্র্যময় নহে, ইহাতে স্তব্ধ করিয়া দেয়, উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলে না। অতএব দেখা যাইতেছে বর্ষাকালে আমাদের ‘আমি’ গাঢ়তর হয় আর বসন্তকালে সে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে।'
কবির বর্ষার অনেক জনপ্রিয় গানের মাঝে এই গানগুলো উল্লেখযোগ্য..
‘বাদল বাউল বাজায়রে একতারা'
‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে’
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’
‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে ’
‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে'
‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’
'আবার এসেছে আষাঢ় '
'মন মোর মেঘের সঙ্গী'
'বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল''
'মোর ভাবনারে কী হাওয়ায়'
'এসো শ্যামল সুন্দর'
শান্তিনিকেতনে প্রতিবছর রবীন্দ্রজয়ন্তী, বসন্ত উৎসব, বর্ষামঙ্গল, শরতউৎসব, নন্দনমেলা , পৌষমেলা, মাঘমেলা ‘হলকর্ষণ উৎসব’ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। কবিগুরু এসব অনুষ্ঠানকে উদ্দেশ্য করে আনুষ্ঠানিক গানও লিখেছেন।
এখন ঋতুগুলোর রূপ পাল্টেছে আগের মতো সময় সময় সে রূপ দেখা যায় না তবুও বর্ষা কচি পাতায় প্রাণ নিয়ে আসে, গান নিয়ে আসে আমাদের প্রাণে।
অরুণ কুমার দাশ, সংস্কৃতিকর্মী, মৌলভীবাজার
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা