শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ১২:৪৯, ১০ আগস্ট ২০২১
খ্যাতিমান বাঙালি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্মদিন আজ
আমাদের বঙ্গদেশীয় শিল্প সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গর্বের নাম চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। নড়াইলে বহমান চিত্রা নদীর পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা মাছিমদিয়া গ্রামে উনিশশো তেইশ সালের আজকের দিনে (১০ আগস্ট) একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেন এস এম সুলতান।
বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রী, একজন শিল্পীও বটে। তৎকালীন জমিদার বাড়ির অনেক নকশাই নাকি সুলতানের বাবার করা ছিলো। সেই শিল্পী বাবার চিত্রকর্ম দেখে দেখে চিত্রার সাথে বেড়ে উঠেছেন সুলতান। সুলতান তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক নাম, চিত্রা পাড়ের বাসীন্দাদের কাছে লাল মিয়া নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। বাবাও ডাকতেন লাল মিয়া নামে।
লাল মিয়ার শিল্প ভাবনার উৎস তাঁর বাবার করা বিভিন্ন নকশার কাজ। বাবার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, তার কাজ দেখতেন। আর এভাবেই দেখতে দেখতে একসময় শিল্পের সুকুমার সুপ্ত বীজটি লাল মিয়ার ভেতরে অঙ্কুরিত হয়। যা পরবর্তীতে লাল মিয়াকে বিশ্ব দরবারে হাজির করেছে এক মহামুনির ন্যায়।
তবে সকলের নজরে আসতে লাল মিয়া সময় নিয়েছেন বেশি। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি থেকে গেছেন প্রকৃতির কাছে তাঁর গ্রামীণ জীবনে। শৈশব কাটে বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে। বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ালেখার প্রতি লাল মিয়ার আগ্রহ ছিলো না। তাঁর আগ্রহ জুড়ে ছিলো চিত্রা নদী, চিত্রা পাড়ের বাসীন্দা, গ্রামের অবহেলিত রুগ্ন মানুষ, যারা তাদের শ্রমে ঘামে গড়ে তোলেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি।
কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়ার সুবাদে তাঁর নাম লাল মিয়া থেকে শেখ মোহাম্মদ সুলতান হয়। কিছুদিন পড়াশোনা করলেও বেশিদিন এখানে মন টেকেনি, ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। কাশ্মীরেও ছিলেন কিছুদিন। শোনা যায়, কোন এক ভিনদেশী নারীর সহযোগিতায় সিমলায় লাল মিয়ার চিত্রকর্ম নিয়ে একটি এক্সিবিশন হয়েছিলো। সেটিই বোধয় সুলতানের চিত্রমালা নিয়ে প্রথম প্রদর্শনী।
শিল্পী হিশেবে সুলতান সবসময় আশ্রয় নিয়েছেন প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতির চোখে তিনি দেখেছেন জনজীবন ও তার গল্প। পণ্ডিতরা বলেন, এস এম সুলতান আধুনিক চিত্রশিল্প চর্চা করেন নি। তাঁর ছিলো এক স্বতন্ত্র ধারা। তিনি সে ধারায় ভেসে নিজের মতো এঁকেছেন এবং বাংলার নব্য আঁকিয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি ছবি এঁকে প্রশ্ন করেছেন। সুলতানের আঁকা ছবির গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য ছবিতে মাঠে কাজ করা পুরুষগুলোর স্বাভাবিকের চাইতে বড়, বলিষ্ঠ হাত, মহিলাগুলোর উন্মুক্ত স্বাভাবিকের চাইতে আকারে বড় স্তন, শৌর্যশালী লোকজন। কিন্তু ছবির মানুষগুলোর বাস্তবের চিত্র ছিলো রুগ্ন, নির্যাতিত, পুষ্টিহীন।
এসব ছবির ব্যাপারে তিনি বলতেন- 'আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃশকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো- সেগুলোও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার কল্পনার ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিল। দেশের অর্থবিত্ত এরাই যোগান দেয়। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিত।'
উনিশশো সাতচল্লিশে লাহোরে শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মের আরেকটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তাঁর চিত্রকর্মগুলো অনেকেরই নজর কাড়ে। এর প্রায় ছয় বছর পর তিপ্পান্ন সালে ইউরোপে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলে সেখানে পিকাসো, সালভাদর ও এস এম সুলতানের ছবির প্রদর্শনী হয়।
বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রিক জাতীয় সাহিত্য মহলে এস এম সুলতানের আগমণ ঘটে বেশ পরে। কিন্তু তেমন সাড়া না পাওয়ায় তিনি কিছুদিন পরপরই নড়াইলে তার গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন। বিলাসবহুল নাগরিক জীবন তাকে টানেনি কখনোই। টেনেছে চিত্রা, টেনেছে মাটির গন্ধ, পানির গন্ধ নির্যাতিত রুগ্ন মানুষের জীবন।
চিত্রকর্মের বাইরে সুলতান বাঁশি বাজাতে পারতেন। তার গ্রামের বাড়িতে তার সাথে বহু বিড়াল থাকতো। তিনি এদের সঙ্গে সময় কাটাতেন; বাউলদের সাথেও ঘুরে বেড়িয়েছেন। গানবাজনা ছিলো চিত্রশিল্পী লাল মিয়ার শিল্প চর্চার আরেকটি জায়গা। এখানেও নিজেকে উজার করে দিতেন সুলতান। এদেশের আরেক জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্যার বলেছিলেন, 'সুলতান আপনভোলা মানুষ।' কেমন আপনভোলা সে সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়া যায় আহমদ ছফার 'যদ্যপি আমার গুরু' বইটিতে। সেখানে একদিনের ঘটনা বর্ননা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ''গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা দাড়িঅলা একটা মানুষ একতারা হাতে হাজির হলো। সুলতান দাঁড়িয়ে সুলতানের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। তারপর দুজনে গাঁজা টানতে বসে গেলেন। গাঁজার কল্কিকে দম দিয়ে সুলতান মাথা দোলাচ্ছেন আর বুড়ো লোকটি শুরু করেছেন একতারা বাজিয়ে গান। সুলতানকে কিছুতেই উঠানো যায় না। আমি পড়ে গেলাম মহামুশকিলে। কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটার সময় ট্রাক ইডেন বিল্ডিংসে ফেরত দিতে হবে। সুলতানকে যতোই বুঝাই তাঁর একই জবাব- ম্যায় সুলতান হ্যাঁয়। কিসিকা হুকুমদে কোয়ি কাম নেহি করতা! হাম আপনা মর্জিসে কাম করতা!
দোসরা লোকটি সায় দিয়ে বলল, বিলকুল ঠিক৷ আপ তো সুলতান হ্যাঁয়।''
সুলতান তার শিল্পকর্ম এবং জীবন দুটোর ক্ষেত্রেই ছিলেন উদাসীন এক বোহেমিয়ান আগুন্তকের মতো। যেখানে গেছেন চোখে যা ধরা দিয়েছে তা এঁকেছেন আবার আসার সময় ফেলে এসেছেন সেখানেই। সেগুলো আর সংগ্রহ করেন নি। এভাবে তাঁর বহু চিত্রকর্মই হারিয়ে গেছে। যেখানে এঁকেছেন সেখানেই ফেলে এসেছেন। এমনি আপনভোলা চিত্রমুনি সুলতান।
তাঁর ভাবনায় ছিলো শিশুরাও। তিনি শেষদিকে এসে শিশুদের জন্য কাজ করতে উদ্যোগী হন এবং শিশুদের ছবি আঁকা শেখানোর জন্য বিভিন্নভাবে কাজ শুরু করেন। শিশুদের ব্যাপারে সুলতান বলেছিলেন- ''যে শিশু সুন্দর ছবি আঁকে, তার গ্রামের ছবি আঁকে, সে সুন্দর ফুলের ছবি আঁকে, তার জীবজন্তুর ছবি আঁকে, গাছপালার ছবি আঁকে, সে কোনোদিন অপরাধ করতে পারে না, সে কোনোদিন কাউকে ব্যথা দিতে পারে না।”
আজ ১০ আগস্ট, সুলতানের জন্মদিন। সুলতান বারবার যে রুক্ষ শেকড়কে সজীব করার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন সে শেকড় বর্তমান সময়ে আরও বেশি রুক্ষ, আরও বেশি মৃতপ্রায়। সুলতান কল্পনায় ভেবেছিলেন, এদেশের কিষাণ কিষাণীদের থাকবে সুঠামদেহ, তাদের হালের বলদগুলো পরিপুষ্ট হবে, তাদের অন্ন বস্ত্রের অভাব হবে না। সুলতানের প্রশ্ন: যারা এদেশের লাখো মানুষের খাবারের যোগান দেয় তারা খাবার পায় না কেন? তারা রুগ্ন কেন? তাদের হালের বলদগুলোর এমন দশা কেন? আমার মাঝেমাঝে মনে হয় সুলতানের চিত্রকর্মগুলো তৎকালীন সময়ের মতো আজও ততোটাই প্রাসঙ্গিক।
[এস এম সুলতান: কৃষি আর কিষাণের শিল্পী]
আইনিউজ/এসডি
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা