তাইমুন পিয়া
আপডেট: ১৬:২০, ৬ অক্টোবর ২০২১
প্রেম ও পোকা
তাইমুন পিয়া
রহস্যময় গলায় ছেলেটা বলে, ভাই সেই পোকাটাও আসতে পারে। এতো নগন্য ভাববেন না এদের। আমার গার্লফ্রেন্ড পোকা পোষে। মানে ওর হবি। ওর সংগ্রহে ভেরিয়াস কাইন্ড অফ স্পেশিস! আপনি অবাক হবেন।
কানে গোঁজা ইয়ার ফোনের চারদিকে আমি বিজিবিজ না করার চেষ্টা করি। গান শুনতে শুনতে ও অফিসে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল কানে ঢুকবার। নাক, চোখ দিয়ে ঢোকা যেতো বা মুখ দিয়ে কিন্তু সাহস হচ্ছে না। ও কোনো ভাবে সুযোগ দেবে না। ওর যন্ত্রণা হবে, অস্বস্তি হবে তাই আগেই আমাকে চপেটাঘাত করে ধরাশায়ী করবে। বা টোকা দিয়ে ফেলে দেবে।
ওর শার্টের কলার কামড়ে থাকলাম। বাইরের দিকে অবশ্য। ভেতরে থাকলে তার গায়ে লেগে গেলে কখন খামচে আবার বের করে আনে। কাল বসেছিলাম মাথায়। চুলের ভেতর। চুপ করেই ছিলাম। কিন্তু অফিসের এসি এতো ঠাণ্ডা করে দিয়েছিল ঘর যে অবশ হয়ে আমি চুল থেকে গড়িয়ে কানের খাঁজে পড়ে যাই। আর খপ করে আমাকে মুঠির মধ্যে এনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই প্রথম দিনের ঘটনার পর পুনরায় তখন ও আমাকে দেখে। আমার চোখের দিকে তাকায়। আমার চোখ দেখতে পাবার কথা নয়। আমি সামনের দুই হাত, মানুষ যেটাকে বলে পা বা ঠ্যাং, জড়ো করে ঘষে ঘষে ক্ষমা চাইছিলাম। ও কী ভাবছিল তখন তা আমি ধরতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার ভাবনা ওর মাথায় প্রবেশ করানোর কোন পদ্ধতি এখনো প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। তাহলে ঢুকতে হবে।
ভদ্র ভাষায় আমি একটা লেডিবাড বিটলস। যার লাল টুকটুকে পাখায় কালো ছোপ ছোপ। গুটি গুটি পায়ে যখন চলি বাচ্চারা মনোযোগ দিয়ে দেখে, চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকে। বড়রা প্রায়ই টোকা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। চিত হয়ে পড়ে গেলে কয়েক পাক বাঁইবাঁই করে ঘুরে নিতে হয় চিত হবার জন্য। তা খুব আনন্দ দেয় তাদের! নিষ্ঠুর।
কিন্তু ও তেমন নয়। ওর হাতের উপর আমি। ঠিক তখন রুমে এলো একটা ছেলে। হাতে ফাইল। নক না করেই ঢুকে পরে রুমে। ঢুকে গমগম করে বলে, কী হইছে জামি ভাই? আপনার হাতে কী?
জামি বলে, একটা পোকা কানের কাছে ঘুরছিল।
বলেন কী! বলে আঁতকে ওঠে ছেলেটা।
সত্যি কানে ঢুকে যেতে পারলে ওর মস্তিষ্কের মধ্যভাগে, যেখান থেকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়, সেখানে বসে আমার লালা ও পাখার রেণু একটু একটু মিশিয়ে দিতে পারলে আমার কথা গুলো ওর ব্রেণ সেন্সরে ক্যাচ করতে পারতো। আমাকে ঠিকঠাক দেখতে পেতো। পদ্ধতিটি আমাকে কেউ শেখায়নি নিজেই আবিষ্কার করেছি। যদিও ওর কষ্ট হবে তাতে। আমারও প্রাণ বিপন্ন হতে পারে। আর বেরিয়ে আসতে না পারি যদি তবে দুজনের'ই জীবন লীলা সাঙ্গ হবে। কিন্তু আমি যে ওর সাথে বাঁচতে চাই।
জামি রোজ সকালে বাড়ির কাছের লেকের পাড়ে জগিং করতে যায়। একটা নির্দিষ্ট বিল্ডিংয়ের নির্দিষ্ট জানালার সামনে এলে সে নিচু হয়ে কেডসের ফিতা বাঁধে। আর একটা জানালার দিকে তাকায়। একটি মেয়ে দাঁড়ানো থাকে জানালায়। তারা পরস্পর চোখাচোখি করে, হাসি বিনিময় করে। তারা দুজন একই অফিসে কাজ করতো। সম্পর্ক হবার পর পর জামি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি থেকে অফার পায়। তাই সকালে এই দেখাদেখ টা তাদের মাস্ট। ছুটির সময় দুজনের ভিন্ন। কিন্তু ছুটির দিন দেখা করতে বাঁধা থাকে না।
লাস্ট থ্রি ডেজ আমি দেখেছি সে কোথা থেকে উড়ে উড়ে এসে শত শত লোকের মাঝে তোমার উপর বসে। আবার ওড়ে আবার বসে। আমার ধারে কাছে তো আসে না! হোয়াট হ্যাপেনিং উইদ ইউ! এই পোকা তোমার প্রেমে পড়েছে?
সেদিন জানালায় মেয়েটি ছিলো না। জামি রাস্তা থেকে সরে লেকের ধারে দাঁড়ায়। যে গাছটি ধরে দাঁড়ায় সেটা ছিলো পলাশ গাছ। আমার আবাসস্থল। রোজ জামি কে দেখতাম, অনেক লোককেই দেখতাম।
সেই সময় পলাশের একটা ভারী হলুদ পাতায় আমি দাঁত বসিয়ে গোল গোল করে কেটে নিচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ এলোমেলো একটা ঝড়ো বাতাস ওঠে, পাতাটি বৃন্তচ্যুত হয়ে লেকের পানিতে পড়ে। পাতাটির সাথে আমিও।
আনমনা থাকলেও জামি আমাকে ঠিক খেয়াল করে আর শুকনো কাঠি দিয়ে তুলে আনে। তখন থেকে আমি জামির সাথে আছি। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেছে। মানুষের দিন, বার আর সময়ের হিসাব আমরা বুঝিনা। আমাদের হিসেব হয় ঋতুতে। প্রাণ ক্ষুদ্র কিন্তু হিসাব বড়।
জামির সেই কলিগ অবশ্য গমগম করে আরো যা বলেছিল তাতে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া তখন। আমি জামির হাতের তালুতে চুপ করে বসে ছিলাম । সেই ছেলেটা কাছে এসে বলে, একে মারবেন না জামি ভাই। একটা গ্লাস দিয়ে ঢেকে রাখেন।
জামি বললো, কী আশ্চর্য মারবো কেন? আর গ্লাস দিয়ে ঢাকবো কেন? এরকম একটা পোকা সেদিন আমি পানি থেকে তুলছিলাম, কিন্তু সেইটা নিশ্চয় এখানে আসেনি।
রহস্যময় গলায় ছেলেটা বলে, ভাই সেই পোকাটাও আসতে পারে। এতো নগন্য ভাববেন না এদের। আমার গার্লফ্রেন্ড পোকা পোষে। মানে ওর হবি। ওর সংগ্রহে ভেরিয়াস কাইন্ড অফ স্পেশিস! আপনি অবাক হবেন। কতকিছু যে সে জানে এদের ব্যাপারে! এটা ওর জন্য নিয়ে গেলে খুব খুশি হবে। একটা নামও রেখে দেবে।
জামি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, পোকা পোষে! পৃথিবীতে এতো কিছু থাকতে!
ছেলেটা বলে, হ ভাই। আমারও কিকরম গা ঘিনঘিন করতো। এমন মেয়ে আমি জীবনে দেখি নাই। বলে, সব পোকাদের নিজস্ব ক্ষমতা আছে। ওরা ক্ষুদ্র বলে মানুষ ওদের গনায় ধরেনা। না হলে নাকি... এই ধরেন মটরশুঁটির পোকা হয় মটরশুঁটির মতো তারপর...
জামি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ফাইলটা রাখেন টেবিলে আর এই পোকা নিয়া যান ফিয়ন্সেরে দেন,
আমি হতবাক! জামি একথা কি করে বললো! ডানা মেলে দিয়ে তখনই উড়ে যাই। ওদের দুজনের দৃষ্টি আমাকে অনুসরণ করে।
আমি কখনো বেল্টে কখনো শার্টে, বেশিরভাগ সময় ল্যাপটপের ব্যাগে করে জামির অফিসে যাই, বাড়ি ফিরি, মেয়েটার সাথে দেখা করে জামি। আমি থাকি। সুযোগ পেলে দুজনের চার জোড়া ঠোঁট এক হয় আমি দেখি। জামির হাত মেয়েটির কাঁধে কোমরে ঘোরে দেখি। মেয়েটাও কম যায় না। আমার কষ্ট হয়। তবুও জামি'র সাথে থাকি। আজ ওরা সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখবে। আগে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলো। আমি খেয়াল করিনি কখন কিভাবে মেয়েটার চোখে পড়ে গেলাম। মেয়েটার কথায় চমকে উঠলাম - জামি, শেষ পর্যন্ত এই লেডিবাড বিটলসের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে আমায়?
জামি অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে, কী বলছ এসব সোনা! কার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে? আমি কিছু বুঝছিনা। বুঝিয়ে বলো তো বাবু...
জামির কন্ঠে প্রেম উপচে পড়ছে। একটু পর অন্ধকার সিনেমাহলে ঢুকবে। এখনই গলা ভারী হয়ে উঠেছে। কোনোভাবে মেয়েটাকে সে চটতে দেবে না এখন।
সোনা, বাবু এসবে মেয়েটির ঝাঁজ কমে না। বরং জামির অবস্থা বুঝে সে মজা নিতে থাকে। বলে -
লাস্ট থ্রি ডেজ আমি দেখেছি সে কোথা থেকে উড়ে উড়ে এসে শত শত লোকের মাঝে তোমার উপর বসে। আবার ওড়ে আবার বসে। আমার ধারে কাছে তো আসে না! হোয়াট হ্যাপেনিং উইদ ইউ! এই পোকা তোমার প্রেমে পড়েছে?
জামি হতবাক এবং নিশ্চুপ। সেও খেয়াল করেছে ঘুম থেকে জেগে প্রতিদিন সকালে দেখে ছোটো রঙিন ঝলমলে লাল পাখা ওয়ালা পোকাটি তার বালিশের এক কোণে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়, অফিসে পেপারওয়েটের উপর এমনকি ওয়াশরুমেও! জামি প্রথম প্রথম অবাক লাগতো। বিস্মিত ভাব কেটে গিয়ে অস্বস্তিতেও ভুগলো কয়দিন। আমি কিছু করতে পারিনি, বোঝাতে পারিনি। তবে বুঝতে পারি আমার প্রতি তার মায়া পড়েছে।
সিনেমা হলে ঢোকে দুজন। দুইহাতের দশ আঙুল একে অপরকে আঠা ছাড়াই চিপকে আছে। দুজন বসলো। লাইট নেভার অপেক্ষা। আমি তখন ধীরে ধীরে জামির বুক পকেটে প্রবেশ করি।
তাইমুন পিয়া,কবি, গল্পকার , কলাম লেখক
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা