জসীম উদ্দীন মাসুদ
আপডেট: ১৭:৪৭, ১৭ অক্টোবর ২০২১
মুজিববর্ষে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের এক অনন্য প্রয়াস
‘খুঁজে পাই চেতনার বাতিঘর’
‘খুঁজে পাই চেতনার বাতিঘর’- বইয়ের প্রচ্ছদ
‘খুঁজে পাই চেতনার বাতিঘর’- জেলা প্রশাসন, মৌলভীবাজার কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত একটি অনবদ্য স্মারকগ্রন্থ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের আহবানে সম্পাদনা পরিষদের সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সর্বপর্যায় থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও অনুপ্রেরণার কারণে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শ সম্বলিত এমন একটি সৃজনশীল কর্ম আলোর পথ খুঁজে পেয়েছে।
বাংলা তথা বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতা এবং মুক্তির সংগ্রামে মানুষের মহাকালের এক মহানায়কের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু, তিনিই বাঙালি জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির চেতনার বাতিঘর হিসেবে নতুন করে প্রমাণের প্রয়োজন নেই। তবে স্মারকগ্রন্থটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে বাঙালিত্বের চেতনায় এগিয়ে যাবার জন্যে প্রকাশনার ইতিহাসে যুগান্তরে দ্যুতি ছড়ানো ৪৮৮ পৃষ্টার মলাটবদ্ধ নতুন একটি পালক যুক্ত হলো। গ্রন্থটির ৪টি বাণীসহ ৭০টি লেখা, প্রচ্ছদ, ডিজাইন, ছবির সম্ভার সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের অনবদ্য জীবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। ৫৬টি প্রবন্ধ ও ১৪টি কবিতা যেন বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার প্রতিচ্ছবি হয়ে আমাদের সামনে উঠে এসেছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। অর্থনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে তিনি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি দেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা ছিল তাঁর ব্রত। বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে মাতৃভাষায় ভাষণ দিয়ে বাংলাভাষার চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বব্যাপী। বাঙালির দুঃখী মানুষের দাবী আদায়ে তিনি কখনোই আপোস করেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল তাঁর হৃদয়জুড়ে বহমান- ছয়দফা ও ৭ই মার্চের ভাষণে যার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বাঙালির অগ্রযাত্রার প্রশ্নে চেতনার বাতিঘর হিসেবে তাই আজও আমরা বারবার বঙ্গবন্ধুকেই খুঁজে পাই।
‘খুঁজে পাই চেতনার বাতিঘর’-বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান
এই মহান নেতাকে নিয়ে দেশ এবং বিদেশে অগণিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদিত হয়ে আলোর মুখ দেখেছে বঙ্গবন্ধুর লিখা তিনটি কালজয়ী গ্রন্থ- অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শের ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণাও হচ্ছে। বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি জনপদ চষে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তাই এলাকাভেদে বঙ্গবন্ধুর আগমন ও প্রেক্ষাপট নিয়েও অঞ্চলভিত্তিক গ্রন্থও প্রকাশিত হচ্ছে।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, গত আগস্ট মাসে সরকারী রেজিস্টার্ড অনলাইন নিউজপেপার আইনিউজ.নিউজের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসন, মৌলভীবাজার কর্তৃক ‘খুঁজে ফিরি পিতার পদচিহ্ন’ নামে নির্মিত একটি চমৎকার ডকুমেন্টারীর মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার জন্যে সোনার মানুষ চেয়েছিলেন। আমাদের আজকের শিশু-কিশোররাই তো সেই আদর্শ সোনার মানুষ হতে পারে, যারা সরকারে ১৯৪১ সালের সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নপূরণে নেতৃত্ব দেবে। হয়তো এজন্যে স্মারকগ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে- ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী আগামী প্রজন্মকে- যারা এই বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বাঙালির হাজার বছরের গৌরবের ইতিহাস তুলে ধরবে বিশ্বপানে’।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠাননে অতিথিরা
প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে স্বাধীনতা পুরস্কার ও ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা নাইট উপাধিপ্রাপ্ত বরেণ্য চিত্রশিল্পী বীরমুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদের শিল্পকর্ম। প্রচ্ছদ করেছেন দেশের প্রখ্যাত শিল্পী ধ্রুব এষ।
বাঙালির আত্মপরিচয় হিসেবেই বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে বারবার আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর চেতনা ও আদর্শ ও বাঙালির প্রতি গভীর মমত্ববোধ নিয়ে। তাই বঙ্গবন্ধু নিয়ে প্রকাশনার উদ্যোগ নেয়াটাই একদিকে যেমন বাঙালিত্বের চেতনারই একটি অংশ অপরদিকে ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির চেতনার বাতিঘর’- এই বাক্যটিকে মূলমন্ত্র ধরে এই গ্রন্থটি প্রকাশের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা সর্বেব সফল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু একজন আদর্শ বাঙালি হিসেবে যে আদর্শ ধারণ ও লালন করতেন সেই চেতনা তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন বাঙালি জাতির মননে। সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নিজের জীবন বাজী রেখে বাঙালি খালি হাতে নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে এক অসম যুদ্ধে। বহু বছর ধরে শোষণ-বঞ্চণার শিকার বাঙালিকে মুক্ত করতে এর আগে বহু প্রজ্ঞাবান ও বিপ্লবী নেতার এই বঙ্গদেশে আবির্ভাব হয়েছে সত্যি, কিন্তু এমন করে বাঙালিকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে উজ্জীবিত করতে পারেননি আর কেউই।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন, আর্য, শক, হুন, পাঠান, মোঘল, ব্রিটিশ বেনিয়া, পাকিস্তান শাসনামল কখনোই বাঙালি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। ‘ঐতরেয় অরণ্যক’ কিংবা ‘চর্যাপদ’ সর্বত্রই বাঙালির দুর্দশার চিত্রই ফুটে উঠেছে, কোথাও কোথাও বাঙালিকে ইতর প্রাণীর সঙ্গে পর্যন্ত তুলনা করা হয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের এই চরম অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর এই যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেতনা সে বিষয়ে স্মারকগ্রন্থের অধিকাংশ লেখাতেই স্পষ্ট ঈঙ্গিত রয়েছে।
ইতিহাসের কালো অধ্যায় পনের আগস্ট নিয়ে লিখেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, কথা সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা নাসের মাহমুদ। একজন আমলার সাদা চোখে বঙ্গবন্ধুকে চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও সিভিল সার্ভিসের সাবেক সদস্য আবুল মাল আবদুল মুহিত।
একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে কেমন করে বঙ্গবন্ধু উন্নয়নের সোপানে শামিল করেছিলেন তা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। গ্রন্থটিতে স্থানীয় ৪ জন সংসদ সদস্য বন. পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এমপি, উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ এমপি, সৈয়দ নেছার আহমদ এমপি ও সৈয়দা জোহরা আলাউদ্দিন এমপির বঙ্গবন্ধুর জীবনঘনিষ্ঠ লেখাও স্থান পেয়েছে। এছাড়াও উপাধ্যক্ষ রেমন্ড আরেং, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান. হাশেম খান, সেলিনা হোসেন, মফিদুল হক, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুছ, ড. আফসার আহমদ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মিনার মনসুর ও কানাই চক্রবর্তীর মতো কীর্তিমান লেখকগণের লেখায় সমৃদ্ধ করেছে এ গ্রন্থটিকে। জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের বঙ্গবন্ধুর অনুশাসনের আলোকে গণমুখী জনপ্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে চমৎকার একটি লেখা রয়েছে।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর শিশুভাবনা, বঙ্গবন্ধু ও নাট্যচর্চা, বঙ্গবন্ধু ও নজরুল, বঙ্গবন্ধু ও জনপ্রশাসন, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, বঙ্গবন্ধু ও সাহিত্যচর্চা, বঙ্গবন্ধু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু ও চা জনগোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাউলগান, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তা, সিলেটে বঙ্গবন্ধু, মৌলভীবাজারে বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অপূর্ব কান্তি ধর, সাইয়িদ মুজিবুর রহমান, রসময় মোহান্ত, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, নন্দলাল শর্মা, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মোসাহিদ আহমেদ চুন্নু, ড. সেলু বাসিত, মো. আবদুল আজিজ, আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, আব্দুল মতিন, তাজুল মোহাম্মদ, আহমেদ সিরাজ, ড. রনজিত সিংহ, অধ্যাপক ড. মো. ফজলুল আলী, রজত গোস্বামী, স্বপন নাথ, জসীম উদ্দীন মাসুদ, দীপংকর মোহান্ত, অধ্যাপক ড. আশফাক হোসেন, ড. মোস্তাক আহমেদ দীন, ড. শ্যামল কান্তি দত্ত, মামুন সিদ্দিকী, তপন পালিত, জয়দীপ দে, হাসান মোরশেদ, মহিদুর রহমান, আজিজুল পারভেজ, জয়নাল আবেদীন শিবু, সুমন কুমার দাশ এবং হাসানাত কামালের গবেষণাধর্মী নিবন্ধ অলংকৃত করেছে স্মারকগ্রন্থটিকে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চমৎকার ১৪টি কবিতা স্থান পেয়েছে স্মারকগ্রন্থটিতে। কবিতাগুলো লিখেছেন ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, রুবী রহমান, মুহম্মদ নুরুল হুদা, মুহাম্মদ সামাদ, ড. মোহাম্মদ সাদিক, কামাল চৌধুরী, আ ফ ম ইয়াহিয়া চৌধুরী, আসাদ মান্নান, তারিক সুজাত, হাসনাত লোকমান, উম্মে সালমা তানজিয়া, কাজী শাহজাহান, নাসের মাহমুদ এবং সাবরীনা রহমান বাঁধন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে এর চেয়ে বড় প্রয়াস আর হতে পারেনা। স্মারকগ্রন্থটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অথবা সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার কতটা উদ্যোগ নেয়া হবে জানিনা। তবে কাজটি সূচারুরূপে করতে পারলে এটি যে সর্বস্তরে পাঠকপ্রিয় ও সমাদৃত হওয়ার পাশাপাশি গবেষণার তথ্য প্রাপ্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
জসীম উদ্দীন মাসুদ, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা, মৌলভীবাজার
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা