মোহাম্মদ আবদুল খালিক
আপডেট: ২৩:০৪, ১৮ অক্টোবর ২০২১
কবি দিলওয়ার ও উদ্ভিন্ন উল্লাস: প্রসঙ্গ প্রকৃতি (পর্ব ১)
কবি দিলওয়ার। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে কবি দিলওয়ার (জ. ১৯৩৭-মৃ. ২০১৩) এক অবিস্মরণীয় নাম। আমৃত্যু আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, মানবিক ধর্ম ও দর্শন এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক নানাবিধ বিষয়-আশয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন গভীরভাবে এবং তা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। কবি দিলওয়ারের জানার পরিধি ছিল ব্যাপক, স্মৃতি শক্তি ছিল অসাধারণ। গণমানুষের কবি হিসেবে খ্যাত দিলওয়ার ছিলেন পঞ্চাশের দশকের একজন খ্যাতিমান কবি।
আর শুধু কি কবিতা? গল্প, নাটক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ছড়া, সঙ্গীত, সাংবাদিকতাসহ নানা অঙ্গনে তাঁর পদচারণা ছিল। তবে ব্যাপক পরিচিতি ছিল কবি ও গীতিকার হিসেবেই। একান্ত নিজস্ব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় তিনি সফলতার সঙ্গে বর্ণাঢ্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। আর এর মূলে কাজ করেছে মাটিসংলগ্ন মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও তাদের প্রতি গভীর ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর গভীর পাঠ ও অধ্যবসায়।
কবি দিলওয়ার যাঁর পুরো নাম ছিলো দিলওয়ার খান। সাধারণ মানুষের কাতারে নিজেকে একীভূত করতেই নাকি বংশানুক্রমিক পদবি খান শব্দটি বাদ দিয়ে দিলেন এবং কবিতায় গণমানুষের কথা বলার শুরুটাও হয়তো তখন থেকেই। মানবমুক্তির প্রক্রিয়ায় যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন, অবদান রেখেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন-তাঁরাও ব্যাপক ভাবে স্থান করে নিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিতে- কবিতা ও ছড়ায়। জাতীয় ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে নিপীড়িত মানবের মুক্তি ও কল্যাণ চিন্তায় সোচ্চার ছিলেন এবং বোধ জাগ্রত রাখতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তিনি গণমানুষের কবি হয়ে উঠেছিলেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতে ‘নিজের কবিতায় তিনি গণমানুষকে এতটা জায়গা কেন দিয়েছেন? সে প্রশ্নের উত্তরও তাঁর আধুনিকতার বোধেই পাওয়া যাবে। এই কবির আধুনিকতা শহুরে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, জনবিচ্ছিন্নতা অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটকে বিবেচনায় আনেনি, এনেছে সভ্যতার সংকটকে, মানুষের সংগ্রাম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে।’ (গণমানুষের কবি - সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দৈনিক প্রথম আলো, শুক্রবার ২৫ অক্টোবর ২০১৩)
বৃটিশ শাসনামলের প্রায় শেষের দিকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি সিলেটের সুরমা নদী তীরবর্তী ভার্থখলা গ্রামে তাঁর জন্ম। ১২ বছর বয়সে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’ ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। তৎকালীন সাপ্তাহিক যুগভেরীতে যা ছাপা হয়। অনেকেই তাঁর মধ্যে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যিক এবং আদর্শিক প্রভাবের আলামত খোঁজে পান। কিন্তু আমরা মনে করি শুরুতে যাই থাকুক, অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময় ধরে তাঁর কাব্যচর্চায় নিজস্ব একটা ধারা নির্মাণ করে গিয়েছেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতা কিংবা হতে পারে অন্য কোনো কারণে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। কিন্তু পৃথিবীর পাঠশালায় তিনি আজীবন এক মনোযোগী ছাত্র ছিলেন। দু-মাসের স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে কর্মময় জীবন শুরু হলেও পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার দৈনিক সংবাদ এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে এ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সিলেটে ফিরে যান। এখানে ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’ গঠন করেন। ১৯৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার ঢাকাস্থ রুশ সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক উদয়ন পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক হিসেবেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরপরে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন সাহিত্যচর্চার পরিমন্ডল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সিলেটে থেকেই কবিতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং আমৃত্যু সিলেটের ভার্থখলার খান মঞ্জিলের কবি ভবনকে কেন্দ্রে রেখেই এসব কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে।
প্রকাশিত গ্রন্থ-
১. জিঞ্জাসা (১৯৫৩)
২. ঐকতান (১৯৬৪)
৩. পূবাল হাওয়া (১৯৬৫)
৪. উদ্ভিন্ন উল্লাস (১৯৬৯)
৫. বাংলা তোমার আমার (১৯৭২)
৬. স্বনিষ্ট সনেট (১৯৭৯)
৭. রক্তে আমার অনাদি অস্থি (১৯৮১)
৮. বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (১৯৮৩)
৯. দিলওয়ারের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৭)
১০. শত ছড়া (১৯৮৯)
১১. দিলওয়ারের একুশের কবিতা, দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (১৯৯৩)
১২. ছড়ায় অ আ ক খ (১৯৯৪)
১৩. দিলওয়ার রচনা সমগ্র ১ম খন্ড (১৯৯৮)
১৪. দিলওয়ার রচনা সমগ্র ২য় খন্ড (২০০০)
১৫. সপৃথিবী রইবো সবুজ (২০০৪),
১৬. দুই মেরু দুই ডানা (২০০৯)
১৭. অনতীত পঙক্তিমালা, বঙ্গবন্ধু আমি তোমার পেশাদার মিত্র নই (২০১০)
১৮. রবীন্দ্রনাথ কি সাম্প্রদায়িক (২০১২) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন সময় তাঁর সম্পাদনায় বেশকিছু সাহিত্য সাময়িকী ও সংকলন প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সমস্বর (১৯৬৯-’৭৪) উল্লাস (ফেব্রুয়ারি ১৯৭২), মৌমাছি (জুন ১৯৭৫), গ্রাম সুরমার ছড়া (১৯৭৬), মরুদ্যান (জানুয়ারি ১৯৮১), সময়ের ডাক (১৯৮৫) এবং সিলেট পরিদর্শক (প্রধান সম্পাদক ১৯৮৬) ইত্যাদি।
একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে তিনি স্থানীয়, জাতীয়, উপমহাদেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বাংলাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। আমরা জানি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান সিলেট কেন্দ্রটি কবি দিলওয়ার রচিত ‘তুমি রহমতের নদিয়া’ গানটি দিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছিল। এছাড়াও ‘মুর্শিদ আমি খুঁজবো নাগো’, ‘মন আমার কেমন করে’, ‘নদীর ঘাটে জল আনিতে গিয়া’সহ তাঁর জনপ্রিয় বেশকিছু গান রয়েছে যার কথা ও সুর আমাদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
নরমান রোস্টেনের সঙ্গে কবি দিলওয়ারের পরিচয়ের সূত্রপাত এবং সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হয় মেরিলিন মনরোকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে। এ প্রসঙ্গে দিলওয়ার সম্পর্কে মফিদুল হকের মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেন- ‘যখন আমেরিকাতেও খুব সামান্য কজন ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গø্যামার-কন্যা মেরিলিন মনরোর অন্তর্গত বিষাদ, তখন বাংলার এক সংবেদনশীল কবি হয়েছিলেন সেই বেদনার রূপকার এবং সেই সুবাদে মেরিলিন-সুহৃদ লেখক নরম্যান রস্টেনের সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব। একজন বড় মাপের মানুষ ও কবি হিসেবে এই কাহিনি ফেরি করে বেড়াননি কবি দিলওয়ার, আজ তাঁর প্রয়াণে সেই কথাগুলো মেলে ধরতে হলো এ কারণে যে, মেরিলিন মনরোকে বুঝতে মার্কিন সমাজের লেগেছিল কয়েক দশক, দিলওয়ারকে বুঝতেও আমাদের প্রয়োজন হবে তেমনি সাধনার। সে জন্য প্রয়োজন মাটির ঘর, যার অনেক কটা জানালা খোলা।’ (কবি দিলওয়ার ও তাঁর মাটির ঘর- মফিদুল হক : প্রথম আলো, মঙ্গলবার- ২৯ অক্টোবর ২০১৩)। আমরাও কবি দিলওয়ারের প্রকৃত মূল্যায়নের অপেক্ষায় রইলাম।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর প্রায় ৭৭ বছর বয়সে কবি দিলওয়ারের জীবনাবসান ঘটে।
[আইনিউজে এই আলোচনাটি ধারাবাহিকভাবে চলবে...]
মোহাম্মদ আবদুল খালিক, সাবেক অধ্যক্ষ, মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজ।
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা