মোহাম্মদ আবদুল খালিক
আপডেট: ১১:৪৫, ১৮ নভেম্বর ২০২১
কবি দিলওয়ার ও উদ্ভিন্ন উল্লাস: প্রসঙ্গ প্রকৃতি (শেষ পর্ব)
কবি দিলওয়ার। ফাইল ছবি
২য় পর্বের পর...
প্রকৃতি তথা নিসর্গ মানুষের মনে দারুণ প্রভাব ফেলে এব্যাপারে আমাদের দ্বিমত পোষণ করার বা কোনোরূপ সংশয় থাকার হয়তো সুযোগ নেই। আর এটাতো সর্বজন বিধিত, প্রকৃতির শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করে, তাঁকে প্রেরণা যোগায়- উদার ও মানবিক হতে, সুশৃঙ্খল ও নৈতিক জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে এবং ত্যাগ ও সাম্যের মহিমায় উজ্জ্বীবিত হতে সহায়তা করে। কবিদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তাঁরা গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। সব সময় জীবন ও জগৎকে কেবল সাদামাটা দৃষ্টিতেই দেখেন না। বরং বলা যায় প্রতিটা বিষয়-বস্তুকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, উল্টে পাল্টে দেখেন এবং উপলব্ধিতে নিয়ে আসেন এর গভীরে আলো ফেলে।
দিলওয়ারের কবিতায় বিশেষ করে তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় এসবের উপস্থিতি লক্ষণীয়। শৈশব কৈশোরের সুখ দুঃখকে কবি প্রকৃতি তথা নৈসর্গিক আলো-ছায়ায় কুড়ানোর এক দুর্লভ আবেগ ও অনুভূতি আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলেন। তাঁর বর্ণনায়-
ঝোপে-ঝাড়ে খানাখন্দে ছিটকে পড়া
মানবীয় সুখ দুঃখ গুলি
এখানে কুড়োচ্ছি আমি
যেমন করে দিনান্তে তপন
নিঃশব্দে কুড়িয়ে নেয়
ছড়ানো ছিটানো তার
সবগুলো দ্যুতির কণিকা
(আমার সম্মুখে ঐ: উদ্ভিন্ন উল্লাস)
কবির চেতনায় ‘যোদ্ধা জনতা’র অন্ধকার বিশ্বকে জয় করে ‘আলোর রশ্মির সিংহদ্বার’ উন্মোচিত করার আকাক্সক্ষাও যেন প্রতিফলিত হয়। প্রকৃতি কখনো কখনো একীভূত হয়ে যায় ‘মানবীয় সুখ দুঃখের’ আলোড়নে আলোড়িত শাখা প্রশাখায়। বৃক্ষ ও মানুষের জীবন যেন পরিপূরক। পরস্পর নির্ভরশীল হিসেবেই কাজ করে। বৃক্ষশোভিত নৈশর্গিক অবস্থা থেকেই মানুষ তার জীবনের মহৎ পাঠ গ্রহণ করতে পারে। তাই গাছের সুশীতল ছায়াতলে দাঁড়াতে কবির আহ্বান, আহ্বান বৃক্ষের সুহৃদ হওয়ার-
ভুলো না বিবেকীমন,বৃক্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাস
অমোঘ বাঁধনে আছে বিপুল মানবপ্রাণ বাঁধা
কত মান-অভিমান কত কোটি হাসা আর কাঁদা,
যখন সজীব তুমি, বাঁধো তারে প্রীতি পাশে।
যে জীবন তরুহীন, মরুর নির্মম মরীচিকা
আমৃত্যু জ্বালায় তাকেঃ হয় সে সৃষ্টির বিভীষিকা।
(বৃক্ষের শীতল ছায়াতলে: উদ্ভিন্ন উল্লাস)
প্রকৃতির ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে থেকে তার লালন ও সম্প্রসারণ এবং এ থেকে মানবিক ঔদার্যের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনকে আরো প্রসারিত করার আহ্বানই কী সৃষ্টির বিভীষিকা মুক্তির আহ্বান? প্রকৃতি সংলগ্ন থেকে মানুষের মানবিক সত্ত্বা বিকশিত করার ও আয়ুষ্মান হওয়ার এ এক অমোঘ ডাক নয় কী? সম্ভবত কবিই প্রকৃতিকে ভেঙ্গেছুড়ে সাজিয়ে গুছিয়ে তাঁর সৃজনশীলতার অহংবোধ দিয়ে নতুনভাবে নির্মাণ করেন প্রকৃতি বা নিসর্গকে। ‘তাই বাইরের নিসর্গ মানুষের কাছে যথাযথ নিসর্গ থাকেনি। হয়ে উঠেছে মানবসৃষ্ট নিসর্গ বা মানবিক নিসর্গ, মার্কস যাকে বলেছেন humanised nature. মার্কস কথিত humanised nature অবশ্যই নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে নতুনতর অর্থবহ ইঙ্গিত।’ [মার্কসীয় সাহিত্যতত্ব -ড.বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা ২০০৬, পৃ.১৯] আমাদের মনে হতে পারে কবি দিলওয়ারও এই বোধটুকু নিজের মধ্যে লালন করতেন এবং সে অনুযায়ী তাঁর সৃষ্ট ‘শিল্প সাহিত্যে’ এর আলো ফেলার চেষ্টাও করেছেন। বৃক্ষের সংবেদনশীল জীবন নিয়ে কবির মানবিক, নান্দনিক এবং দার্শনিক উপলব্ধি-
আমিতো কাঠুরে নই, আমিতো চাইনে কেটে নিতে
ফুলের ফলের উৎসঃ গাছের সবুঝ বাহুগুলি,
চুলোর নারকী ক্ষুধা নেইতো ইচ্ছের চারিভিতে
নির্বিকার বহ্নিমান পোড়াতে বাসনা শতমূলী।
ফুলের গন্ধের নদী ফলের নৌকার খোলে হাল
বৃক্ষের বাহুতে বসে পাখীরা সংগীতে তোলে তাল।
(একটি কামনা: উদ্ভিন্ন উল্লাস)
‘এখন একটি পথ’ কবিতায় মনে হয় ফুল ও ফসলের বিপুল সম্ভাবনার মানে-গতিময় জীবনের ব্যাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আকুলতারই যেন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কবির উচ্চারণ-
আমার বাগান নেই, অথচ তোমার চাই ফুল
অজস্র ফুলের সাথে তোমার হৃদয় ভরপুর
এখন একটি পথ সমগ্র সবুজ পৃথিবীকে
প্রেয়সীর প্রাণপত্রে সংগ্রামে দিতেই হবে লিখে
(এখন একটি পথ: উদ্ভিন্ন উল্লাস)
গণমানুষের কবি দিলওয়ারের কবি হয়ে উঠার পেছনে যে প্রকৃতি বিরাট প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে এ কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। ‘যে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে আমার জন্ম তার মধ্যে বহু মানুষের জীবন চাঞ্চল্য থাকলেও চিত্তের প্রসাধন স্বরূপ সাহিত্য সংস্কৃতির তেমন উলেখযোগ্য কোনো তাড়না ছিল না। ছিল না আমার রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো সাহিত্যিক উত্তরাধিকার- ছিলেন না কোনো সাব্যস্ত পথ নির্দেশক। আমার কাব্যচর্চার ইন্ধন যুগিয়েছে যে শক্তি তার নাম প্রকৃতি।’ (মুখবন্ধ: জিঞ্জাসা) তাই তাঁর কবিতার বিষয় বস্তুতে প্রকৃতি বা নিসর্গ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে একথা বলাই বাহুল্য। উদ্ভিন্ন উল্লাস কাব্যের অনেক কবিতায় শব্দে শব্দে আঁকা এক একটা চিত্র যা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠে নানান বর্ণ ও রূপের এক একটি ছবি, কানে ধ্বনিত হয় মৃদুমন্দ আওয়াজ এবং শরীরে অনুভূত হয় শীতল, কোমল জল-হাওয়ার স্পর্শ।
তৃণময় কোমল উপত্যকা? লতাগুল্ম?
আমলকী বন?
লাস্যময়ী ঝর্ণাধারা? অথবা সে
ঝর্ণার নিক্কন?
ছায়াময় ঝোপঝাড়? সমীরণে
মর্মরিত শাখা?
বনান্তরে পথ আঁকা বাঁকা?
(হরিণের শিং: উদ্ভিন্ন উল্লাস)
সাতটি লাইনে আটটি জিঞ্জাসা চিহ্ন দিয়ে যে দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে তা এক অন্য রকমের ছবি বটে। এছাড়াও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এসব জিঞ্জাসার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে প্রকৃতির সম্ভাবনাময় কোনো স্বপ্নের ইঙ্গিত? অন্যত্র-
এবং অনেকদিন এই সব জীবন্ত ঊর্মিরা
ঘুরেছে বনান্তরে, ছিড়েছে ক্লান্তির মৃগশিরা
ঝরা পাতা মরা ডাল ক্ষুরের আঘাতে
গেছে সরে-
অন্য এক কান্নার সাগরে।
(পূর্বোক্ত: উদ্ভিন্ন উল্লাস)
এখানে কি নিসর্গের আবরণে কোনো অপূর্ণতার ছবি আঁকা হয়েছে, হারিয়ে যাওয়া বেদনাময় করুণ আবহের? হঠাৎ করে এ কবিতাংশে হালকাভাবে হলেও মনে হতে পারে জীবনানন্দীয় আলো-ছায়া যেন খেলা করে দিলওয়ারের কবিতায়। কিন্তু আসলে কবি তাঁর মতো করেই হয়তো এ কবিতায় প্রকৃতিকে, নিসর্গকে মানবীকরণের মাধ্যমে গণজাগরণাকাক্সক্ষায় রূপায়িত করতে চেয়েছেন নিজস্ব পদ্ধতিতে, ভাবে, বিষয়-বৈচিত্র্যে ও নানাবিধ শব্দের অনুষঙ্গে।
কজন ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গ্ল্যামার-কন্যা মেরিলিন মনরোর অন্তর্গত বিষাদ, তখন বাংলার এক সংবেদনশীল কবি হয়েছিলেন সেই বেদনার রূপকার এবং সেই সুবাদে মেরিলিন-সুহৃদ লেখক নরম্যান রস্টেনের সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব। একজন বড় মাপের মানুষ ও কবি হিসেবে এই কাহিনি ফেরি করে বেড়াননি কবি দিলওয়ার, আজ তাঁর প্রয়াণে সেই কথাগুলো মেলে ধরতে হলো এ কারণে যে, মেরিলিন মনরোকে বুঝতে মার্কিন সমাজের লেগেছিল কয়েক দশক, দিলওয়ারকে বুঝতেও আমাদের প্রয়োজন হবে তেমনি সাধনার। সে জন্য প্রয়োজন মাটির ঘর, যার অনেক কটা জানালা খোলা।’’ (কবি দিলওয়ার ও তাঁর মাটির ঘর- মফিদুল হক : প্রথম আলো, মঙ্গলবার- ২৯ অক্টোবর ২০১৩)। আমরাও কবি দিলওয়ারের প্রকৃত মূল্যায়নের অপেক্ষায় রইলাম।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর প্রায় ৭৭ বছর বয়সে কবি দিলওয়ারের জীবনাবসান ঘটে।
মোহাম্মদ আবদুল খালিক, সাবেক অধ্যক্ষ, মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজ।
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা