শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ২০:৫০, ১৯ জানুয়ারি ২০২২
বিন্নি ধানের মাড়
প্রতীকী ছবি
মাড় নিয়ে আমার এমন ন্যাকা কান্না দেখে আম্মার মেজাজ গেলো চড়ে। ব্যাস, হাতের কাঠের চামচ দিয়েই লাগিয়ে দিলেন দুই ঘাঁ। আমার কান্না তখন সপ্তমে চড়েছে। পাশের ঘরের বদরু, ওই ঘরের নাসিমা, মতল্লী বাড়ির জয়নাল এসে আমার কান্না দেখছে। যেন কোন ওপেরার উপভোগ্য তামাশা চলছে। আমার কান্না থামেনা। এদিকে আওয়াজ হলেই আম্মা ধুমধাম মারতেছেন।
ভাতের 'মাড়' দেখলে বিন্নি চালের ভাতের 'মাড়ে'র কথা মনে পড়ে। এই বিন্নিকে সিলেট অঞ্চলে বিরইন ধান বলে ডাকা হয়। বিরইন চালের মাড়ের একটা সুঘ্রাণ আছে। সব ভাতের মাড়েই ঘ্রাণ থাকলেও বিরইন চালের মাড়ের গন্ধটা আলাদা। যেন ঘ্রাণেই এ চালের পরিচয়।
আমার ছেলেবেলার শুরুর কিছু অংশ কেটেছে সুনামগঞ্জের সেই হাওর ঘেরা গ্রামে। সেখানে কৃষিই ছিলো আব্বার প্রধান পেশা। এওতার সময় নৌকা নিয়ে দূর গ্রামে বাণিজ্যেও যেতেন আব্বা। কখনো চাল, ডাল, মশলা নিয়ে; তো কখনো বাঁশ নিয়ে।
ধান রোপনের সময় অন্য ধানের সাথে আব্বা কিছু বিরইন ধানও রোপন করতেন। কেননা, এই চাল ছিলো আম্মার ভীষণ প্রিয়। আর আমার ভালো লাগতো বিরইন চালের মাড়। বিরইনের মাড় দিয়ে ভাত খাওয়া আমাদের অঞ্চলে প্রচলিত একটা বিষয়। এটা অনেকেরই প্রিয়।
আব্বা কিছু জায়গায় বিরইন চাষ করতেন। সেই বিরইনের ধান মাড়াই করে চাল ঘরে এলে আম্মা ভাত রান্না করতেন। অন্য ভাতের মাড় গরুর জন্য রেখে দেওয়া বা ফেলে দেওয়া হলেও বিরইনের মাড় রাখা হতো আমার জন্য। এ মাড় দিয়েই আমি কতো পেট ভরে ভাত খেয়েছি। সেসব এখন শুধু স্মৃতিতেই ঘুরপাক খায়।
একবার ঘটলো এক কাণ্ড; আমার তখনো পাঠশালা যাওয়া শুরু হয়নি। আসলে আমাদের গ্রামে পাঠশালা বলতে তখন কিছুই ছিলোনা। ভাটি এলাকার শিক্ষার অবস্থা অনেকেই জানেন। যেকারণে আমি পাঠশালায় যাওয়া শুরু করি অনেক পরে।
আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ হবে। একদিন দুপুরবেলা আম্মা বিরইন চালের ভাত রান্না করার পর মাড়টা কোনো কারণে ফেলে দিলেন। ওদিকে আমিও বসে আছি ভাতের মাড় নিংড়ানো শেষ হলে সে মাড় দিয়ে ভাত খাবো এই আশায়। কিন্তু আম্মা আমাকে হতাশ করে বললেন, 'আজকে মাড় নাই। তরকারি দিয়া ভাত খা। মাড় ফালাই দিছি।' আমার তো মাথা নষ্ট। আম্মা বলে কী! আমি বসে আছি মাড় দিয়ে ভাত খাবো বলে আর তিনি এসে আমায় শুধাচ্ছেন 'মাড় নেই, ফেলে দিছি!'
শুরু করলাম কান্না। সে কী কান্নারে। এখনো ছোট ঝি আমাদের বাড়িতে আসলে সে কান্নার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হাসাহাসি করেন।
আব্বা সেদিন বাড়িতে নাই। দূর কোন গাঁয়ে বাণিজ্যে গেছে। এইদিকে আমার কান্না থামার কোন লক্ষণ নাই। মাড় নিয়ে আমার এমন ন্যাকা কান্না দেখে আম্মার মেজাজ গেলো চড়ে। ব্যাস, হাতের কাঠের চামচ দিয়েই লাগিয়ে দিলেন দুই ঘাঁ। আমার কান্না তখন সপ্তমে চড়েছে। পাশের ঘরের বদরু, ওই ঘরের নাসিমা, মতল্লী বাড়ির জয়নাল এসে আমার কান্না দেখছে। যেন কোন ওপেরার উপভোগ্য তামাশা চলছে। আমার কান্না থামেনা। এদিকে আওয়াজ হলেই আম্মা ধুমধাম মারতেছেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ততোক্ষণে কান্নার আওয়াজ কমে এলেও আমি তখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছি। আব্বা আসলেন সন্ধ্যায়! এসে আমাকে ফুপাতে দেখে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'হইছে কি শেফালী? এয় কান্দে কেনে?'
আম্মা বিরইন ধানের মাড় ফেলে দেয়ার কথা বললেন। আব্বা আমার কাছে এসে হেসে হেসে বহুকিছু বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার ফুপানো বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। বাণিজ্য থেকে ফেরার পথে কটকটি নিয়ে আসছিলেন তাও আমার হাতে দিলেন। আমাদের ঘরে তখন আমিই আব্বা-আম্মার একমাত্র ছেলে। আমার অন্য ভাইরা তখনো দুনিয়ার আলো দেখে নাই। একারণে আব্বা আদরও করতেন বেশি।
আব্বার আদরে আমার ফুপানো কমলো, কটকটি খেয়ে বেতের পাটিতে আব্বার কোলে কখন ঘুমিয়েছি বলতে পারিনা। মাঝরাতে আমার জ্বর এলো। যেনো তেনো জ্বর না! একেবারে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর। আমাকে মারার জন্য আব্বা আম্মাকে গালাগাল করলেন। দুজনেই যেন তখন দিশেহারা, হতাশ এক দম্পতি। মাঝরাতে আর কোথায়ই বা যাওয়া যায়?
ভাইটল রাতে আমার অবস্থা আরও খারাপ হলো। গ্রামে ডাক্তার বলতে একজন, কিন্তু এখন তাকে পাওয়া যাবে না। আব্বা ডাক দিলেন ফুলেছা নানীকে। গ্রামে হাকিমগিরীতে তার পরিচয় ছিলো ভালো। ফুলেছা নানী আমার কপালে, গলায় হাত দিয়ে বললেন, 'সকাল অইলেই তারে রজনীগঞ্জে নিয়া যারে। অবস্থা ভালো না।'
আমাদের তখন কোনও নৌকা নাই। আব্বা অনেক দৌড়াদৌড়ি করে মতল্লীর নৌকা জোগাড় করলেন। মজিদ কাকারে নিলেন নৌকা চালানোর জন্য। রজনীগঞ্জের ছোট্ট হাসপাতালে আমারে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার অনেকক্ষণ দেখেশুনে জানালেন আমার নিউমোনিয়া। সারতে সময় লাগবে।
- আরও পড়ুন- শ্যামলাল গোঁসাইর কবিতা
সময় লেগেছিলো সত্যই, আমি সুস্থও হয়েছিলাম। কিন্তু শুকিয়ে গেলাম অনেক। দেখতে নাদুসনুদুস আমি মড়া কাঠের মতো হয়ে গেলাম, আমার শ্বাসকষ্ট হলো। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে অনেকদিন আম্মা আর আমাকে মারধোর করেন নি। আব্বা অনেকদিন বাণিজ্যে যান নি। দিনরাত আমার পাশে শুয়ে বসে কাটিয়েছেন। এভাবেই একদিন আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলাম। আবার উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু শ্বাসকষ্ট রয়ে গেলো!
- আরও পড়ুন - ‘মনে করো কেউ ছিলো না’
এসব ঘটনা বড় হবার পর ফুলেছা নানি, ছোট ঝিয়ের মুখে শোনা। গ্রামে গেলে এসব শুনেও গালগপ্প হয়। গ্রামের বাড়িতে গেলে ছোট ঝি আমারে এখনো বিরইন ভাতের মাড় দিয়ে ভাত বেড়ে দেন। এটি এখনো আমার কাছে সমান প্রিয়।
- আরও পড়ুন - বাঙালি আদমির জাদুর শহর ভ্রমণ
দুবাই আসার পর নিজে নিজেই ভাত রাঁধি। অনেককিছু শিখেছি এই কয়দিনে। ভাতের মাড় যখন ফুলেফেঁপে আগ্রাসী হয়ে উঠে আসতে চায়, সে মাড় দেখে আমার সেসব দিনের কথা মনে পড়ে যায়। ভাতের গরম বায়ু এসে চোখ ঝাপসা করে দেয়। আরও কতোকিছু, কতো গল্প মনে পড়ে আমার। কিন্তু গল্প করার মানুষ পাইনা। এসব গালগল্প শুনবে এমন অবসর কই এখানে?
শ্যামলাল গোঁসাই, ফিচার প্রতিবেদক, আইনিউজ
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা