শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ১৮:০২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
একজন পূর্ণাঙ্গ বাউল ও শোষিত মানুষের কবি : শাহ আব্দুল করিম
শাহ আব্দুল করিম
শাহ আব্দুল করিম বলেছিলেন, ‘বাউলদের সাধনা তো মানুষকে ঘিরেই। সেই মানুষই যদি ভালোভাবে বাঁচতে না পারে তাহলে কিসের সাধনা?’
ভাটির কবি শাহ আব্দুল করিমকে অনেকেই শুধুমাত্র ‘বাউল‘ ভাবেন। এই ভাবনা থেকেই হয়তো ‘বাউল সম্রাট‘ তকমাটি তার নামের আগে লাগানো হয়। এই ভাবনায় একটু সমস্যা আছে বলে আমার মনে হয়। কেননা, শাহ আব্দুল করিম শুধুমাত্রই একজন বাউল নয়। তিনি শুধুই বাউল ধারায় নিজেকে প্রবাহিত করেন নি। বরং, নিজগুণে নিজেকে নিয়ে গেছেন তারও ঊর্ধ্বে, হয়েছেন হা-ভাতা মানুষের কবি। যাকে আমরা বলি, গণমানুষের কবি।
বাউল সম্প্রদায় শুধুমাত্র দেহসাধনার বৃত্তে একটা জীবন অতিবাহিত করে দেন। অবশ্য বাউলে বাউলেও ফারাক অনেক। বীরভূম অঞ্চলের বাউল আর এই গাঙ্গেয় অববাহিকার বাউলদের দিকে তাকালেই ফারাকটা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। কেউ বৈষ্ণবপন্থী বাউল আবার কেউ মারেফতপন্থী বাউল। ধারা দুই হলেও দুইয়ের মিলনস্থল একই। আর সেটা হলো মানবের সাধনা। জগতের সকল তথ্যের আড়ালে যে নিগুঢ় তথ্য লুকায়িত বাউলরা সাধনা বলে সেই তথ্যেরই উন্মোচন করেন। সেই তথ্যের নিরিখে প্রাপ্ত পরমজ্ঞান দর্শনই বাউলদের লক্ষ্য বলে আমি জানি।
শাহ আব্দুল করিমও সাধনার শুরুতে এই ধারায় নিজেকে প্রবাহিত করে, পার্থব সাগর হতে নিগুঢ় তথ্য সিঞ্চন করে নিজেকে সিদ্ধ করেছেন। সুতরাং, তিনি বাউল এ নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই। কিন্তু শাহ্ আব্দুল করিম শুধুই কি একজন বাউল? তিনি শুধুই কি নিজেকে বাউলিয়ানায় বন্দি করে রেখেছেন বা রাখতে পেরেছেন?
আরও পড়ুন- ‘মনে করো কেউ ছিলো না’
উত্তরটা একবাক্যে না বলে দেয়া যায়। কেননা, নিজের অজান্তেই হোক আর সজ্ঞানেই হোক তিনি জড়িয়েছেন গ্রাম্য রাজনীতিতেও। সুউচ্চ কণ্ঠে ভরা মজলিশে গেয়েছেন সাধারণ মানুষের গান। সে গানে আছে সাধারণের দুঃখ, দুর্দশা, হাহাকার, পীড়নের কথা।
শাহ আব্দুল করিমের একটি গানের পদেও তিনি নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করে উল্লেখ করেছেন এভাবে: 'তথ্য গান গেয়ে গেলেন যারা মরমি কবি/আমি তোলে ধরি দেশের দুঃখ, দুর্দশার ছবি/বিপন্ন মানুষের ছবি, করিম চায় শান্তির বিধান/মন মজালে ওরে বাউলা গান।'
এখানে করিম নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন বিপন্ন মানুষের পক্ষের দলে। এরকম তার বহুগানে গণ মানুষের পক্ষের কথা বলেছেন তিনি। তাই তাকে শুধুই একজন বাউল ভেবে এই পরিসরে বেঁধে রাখার কোনও জোঁ নেই।
আরও পড়ুন- বিন্নি ধানের মাড়
সঙ্গীত সাধনার প্রথম জীবন শাহ আব্দুল করিম বাউল ধারা দিয়ে শুরু করলেও শেষ জীবনে তিনি চলে গেছেন একেবারেই সাধারণ মানুষদের পক্ষে। জীবিত অবস্থায় নেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও তিনি তার এসব ভাবনার কথা বলেছেন। করিম রাজনীতি করেন নি কথাটা যারা বলেন তারা আসলে রাজনীতি বুঝেন বলে মনে হয়না। রাজনীতি মানে শুধুই যদি রাজপথে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন হয় তবে শিল্পীদের সেখান থেকে বঞ্চিত করা হবে। কারণ, একজন শিল্পীও প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশ নেন, কিন্তু তার অস্ত্র থাকে তার শিল্প। যেমনটা ছিলো শাহ আব্দুল করিমেরও। তিনি নিজের গানকে শেষ জীবনে সাধারণ হাভাতা মানুষের ইশতেহারে পরিণত করেছিলেন।
একবার কোনও একজনকে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় করিম বলেছিলেন, ‘বাউলদের সাধনা তো মানুষকে ঘিরেই। সেই মানুষই যদি ভালোভাবে বাঁচতে না পারে তাহলে কিসের সাধনা?’
এ বক্তব্যগুলো আব্দুল করিমের জীবনের শেষ অংশের। মরণকালে মানুষের জীবন টান বেড়ে যায় বহুগুণ। সেই শেষকালে আব্দুল করিমকে টেনেছিলো অধিকার বঞ্চিত মানুষের জীবন। তাদের পক্ষের একজন হয়ে লিখেছেন একের পর এক গান। শুধু গানই নয়, লিখেছেন প্রকাশিত-অপ্রকাশিত বহু কবিতাও। তাই শাহ আব্দুল করিম কেবলই একজন বাউল নন। তিনি একধারে ভাটির কবি, এবং অধিকার বঞ্চিত সাধারণ মানুষদের পক্ষের একজন বিদ্রোহী কণ্ঠও।
শ্যামলাল গোঁসাই, ফিচার প্রতিবেদক, আইনিউজ
আইনিউজ ভিডিও
কৃষক ও ফিঙে পাখির বন্ধুত্ব (ভিডিও)
পোষ মানাতে হাতির বাচ্চাকে নির্মম প্রশিক্ষণ
হাতির আক্রমণে হাতি হত্যা মামলার আসামির মৃত্যু
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা