মুজাহিদ আহমদ
আপডেট: ১৭:৪৩, ১৯ মার্চ ২০২২
বাংলা সাহিত্যের ভেতরবাড়ির দেয়ালে অঙ্কিত টেরাকোটা অথবা শিলালিপি
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিও
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিও।
হেলাল হাফিজ কবিতার রাজকুমার। বয়স ২৩ থেকে ৩৩ বছরের মধ্যে কে যেনো পেরেক মেরে আটকে রেখেছে! প্রকৃত বয়স ৭৪ বছর। শুধু শুধু কন্ঠ শুনে বুঝে ওঠাও শতভাগ কঠিন, কণ্ঠে বারুদের পরিমাণ কতো? এর জন্য কাছে ভিড়া, পাশে বসা। এই ৭৪ বছর বয়সেও কণ্ঠ থেকে যে জলে আগুন জ্বলের বদলে সে কণ্ঠে আগুন ঝরে। কী যে এক অদ্ভুত রকমের মাধুর্যভরা আগুন বলে বুঝানো যাবে না।
হেলাল হাফিজ
হাফিজ যখন কবিতা পড়েন অদৃশ কোনো মখমলের ছামিয়ানায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে যতদূর তাঁর কণ্ঠের আওয়াজ পৌছায়। একদম গোটা গোটা অক্ষর, শব্দ, বাক্য, পরিচ্ছন্ন উচ্চারণ অডিয়েন্সের দিকে তীরের মতো নিক্ষেপ হতে থাকে একের পর এক। সামনে শ্রোতা হয়ে বসে যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন কেবল তিনিই অনুভুতির সারাসার বলতে পারবেন। হেলাল হাফিজের কবিতা, পড়ার ভঙ্গি, দাড়ঁনোর কায়দা, কথা বলার ঢঙ, বিনয়ের ধরণ, হাসির সৌন্দর্য, চিন্তার গভীরতা এগুলো শত বছর, হাজার বছরের পরের জন্য মুদ্রিত হয়ে সংরক্ষিত থাকুক সময়ের ডানায়; উড়তে থাকুক আকাশ মাটির মধ্যিখানে। ... এবং সেটিই হবে। একান্ত কাম্যও তাই।
গেলো ২৭ ফেব্রুয়ারি ছায়ানটের সম্মেলন কক্ষের সন্ধ্যা আর অন্য সন্ধ্যার মাঝে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করেছেন পুরো দেশ থেকে সমবেত এক ঝাঁক শব্দের কারিগর; যারা পরম মমতায় অক্ষর দিয়ে কবিতা বানান। গ্রাম-গঞ্জ চষে-পিষে ঘ্রাণ সংগ্রহ করেন; গোলাপ জলে চন্দন কাঠের প্যাক তৈরি করে কবিতার শরীরে মাখান। তাদের অনেককেই বলতে শুনি, ওই সন্ধ্যা তাদের কাছে জীবনের উপভোগ্য সন্ধ্যাগুলোর মধ্যে একটি। উপস্থিত কবিতাপ্রাণ মানুষগুলোর চেহারায় কেমন একটা ঘোর লেপ্টে গিয়েছিল। অন্যরকম ঝিমধরা আলো-আঁধার চোখের পাতার সাথে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেনো দাবা খেলায় ডুবে ছিল।
সন্ধ্যাটা নামতে গিয়ে যেনো বারবার আটকে গিয়েছিল ছায়ানটের চার দেওয়াল অথবা বাদামী রঙের ফ্রেমের ভেতর। দেওয়ালে টাঙানো ছবির ভেতরও আটকে থাকে সন্ধ্যার মায়া আর হেলাল হাফিজের বলিষ্ঠ উচ্চারণ; কবিতার পংক্তি। কেউ কেউ বিস্ময় চোখে, উচ্ছ্বল হৃদয়ে ক্যামেরায় ধরে রাখেন। হাফিজের কণ্ঠ থেকে শব্দগুলো বুলেটের মতো সেদিনের সন্ধ্যা তছনছ করে দেওয়ার দৃশ্য।পাশপাশি যেনো কবিতার সুগন্ধিতে ডুবে গিয়েছিল সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের ঝাড়বাতি, ঘাসরঙা কার্পেট, মঞ্চের শোভা রঙিন কাগুজে ঘুড়ি। তখন উপস্থিত তরুণ তরুণীরদের মাঝে অনেকটা হুশকমতি ভাব চলে আসে। হাফিজের কণ্ঠে উচ্চারিত এন্টি সেফটিক চুমু কবিতাটি শুনে প্রেমিক মনগুলোয় এমন এক নীরবতা নেমে আসে। মনে হয়েছে পুরো হলরুমের সবগুলো মানুষকে একসাথে কে যেনো এনেস্থিসিয়া দিয়ে রেখেছে। কবিতার এনেস্থিসিয়া। কবিতা শুনে হলভর্তি মানুষ হাততালি দেওয়া ভুলে সবাই হাফিজের কণ্ঠের প্রেমে, কবিতার প্রেমে একটা ভিন্নরকম আবহে মিশে গিয়েছিল। ঠিক এর কিছুক্ষণ আগে কবি আবৃত্তি করেছিলেন তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘প্রস্থান’। পাঠকের জন্য কবিতাটি এখানে জুড়ে দিলাম।
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিও
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিও।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিও।
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিও, পত্র দিও।আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালবাসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কি আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা বা কষ্ট দেবে!
নাতিদীর্ঘ এ কবিতার ছবি আর শীতযন্ত্রের মোলায়েম হাওয়ায় হলের ভেতর ভাসতে থাকে, ভাসাতে থাকে অন্যসব কবিদের। কবিরা সব তন্ময় হয়ে ঢুকে পড়েন কবিতার ভেতর। যাপন করেন কবিতা ও কবিতাময় সময়।
কবিতাময় সময় অষ্টমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো সমধারা কবিতা উৎসব ২০২২। একটা বিশেষ আভিজাত্যে ভরপুর এই উৎসবটি ভিন্ন ভিন্ন কারণে তার একটা গ্রহণযোগ্যতার জায়গা পাকাপোক্ত করেছে ইতোমধ্যে। মনে হলো নান্দিনকতারও শ্রেণি বিন্যাস রয়েছে সমধারার নিজস্ব অভিধানে। সৌন্দর্যকেও সমধারা যাচাই বাচাইয়ের মধ্যদিয়ে গ্রহণ বর্জন করে। সমধারার প্লার্টফর্ম আক্ষরিক অর্থেই পরিশীলিত, মার্জিত এবং গোছানো।যেখানে বাংলা সাহিত্যের নিখাঁদ মশলাপাতি উৎপাদিত হয়, উচ্চারিত হয় সময়ের স্পষ্টতম শব্দ। আর সে জন্যই কাঠখড় পোড়ানো এই দীর্ঘ সময়ে তৈরি হয়েছে ভিন্নরকম ইমেইজ। যা বাংলা সাহিত্যের ভেতরবাড়ির দেয়াওলে অঙ্কিত এক টেরাকোটা অথবা শিলালিপি।
এবছরের সমধারা সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয় কথা সাহিত্যে আনোয়ারা সৈয়দ হক ও কবিতায় কবি ও সংবাদের মানুষ ওমর কায়সারকে। সমধারা সম্মাননার অর্থমূল্য কুড়ি হাজার টাকা। সাথে দৃষ্টিনন্দন ক্রেস্ট, পোর্ট্রেট যুক্ত ছিলো। আগামী সালে সমধারা সাহিত্য পুরস্কার যাদের প্রদান করা হবে তাদের নামও ঘোষণা করা হয় এবারের পরিপাটি এই মঞ্চ থেকে। কথাসাহিত্যে হরিশংকর জলদাস, কবিতায় ফরিদ আহমদ দুলাল ও শিশু সাহিত্যে স ম শামছুল আলম পাচ্ছেন এই সম্মননা।এই লেখায় গুণী লেখকদের আগাম অভিনন্দিত করছি।
নজমুল হেলাল সজ্জন মানুষ।কবিতায় সজ্জিত থাকেন সব সময়। কবিতার মজমা তার বিশাল। সমধারার উৎসবে পড়লেন- ‘ঘুমের ভেতর’ শিরোনামের কবিতাটি। আমরাও কবিতাটি আরেকবার পড়তে চাই
পাখিরা হাল চাষ করে
আর গাধারা উড়ে বেড়ায় আকাশে
গরুরা কাটায় বিলাসী জীবন
কলুর বলদ যেন চেয়ে চেয়ে দেখে
এসব দেখতে দেখতেই
এক সময় আমার ঘুম ভেঙে যায় !
- আরও পড়ুন- ‘মনে করো কেউ ছিলো না’
কবি নজমুল হেলাল-এর কবিতার প্রতি তার কমিটম্যান্ট আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার সাথেই আছেন সরলপ্রাণ এই মানুষটি। কবি নজমুল হেলাল, তরুণ কবি নুরজাহান মহুয়াসহ আমরা ঠিক আড়াইটায় কবি হাফিজের রাজকীয় আবাসনের অভ্যর্থনা কক্ষে পৌঁছি। উদ্দেশ্য কবিকে নিয়ে সমধারা কবিতা উৎসব প্রাঙ্গণ ছায়নটে যাওয়া। পৌঁছে দেখি কবি শয়ন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে অপেক্ষার কক্ষে কফি খেতে খেতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। মেরুন রঙের হাফহাতা শার্ট, গলায় কাঠের তৈরি মোটা মোটা দানার মালা, হাতে রঙিন পুতির ব্রেসলেইট।টেবিলের ওপর পাটের ব্যাগ। একেবারে টিপটপ ডেকোরেশন। প্রিয় কবিকে দেখে-পেয়ে মুগ্ধ। আমরাও কফির আসরে যোগ দিই। শুরু হয়ে যায় আড্ডা।কফির কাপের এই আড্ডা গড়াতে গড়াতে চলে যায় সংস্কৃতি বিকাশকেন্দ্রে; ছায়ানটে। বিকেল, সন্ধ্যা মাড়িয়ে রাত।শতাধিক কবির উপস্থিতি, স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ, আলোচিত আরো অন্য আবৃত্তির সংগঠনের বাচিক শিল্পীরা চমৎকার চমৎকার আবৃত্তি মুগ্ধ করে শত শ্রোতাহৃদয়।
কবিতার রাজকুমার হেলাল হাফিজ ছিলেন সমধারার অষ্টম কবিতা উৎসবের উৎসব প্রধান। উদ্বোধক কবি, প্রাবন্ধিক পানরসিক মানুষ ফরিদ আহমদ দুলাল। বিশেষ অতিথি কবি নজমুল হেলাল, লেখক ও গবেষক মো. আরিফুর রহমান।সকলের স্বক্রিয় অংশগ্রহণ, সমধারার টিম প্রধান কবি ও বাচিক শিল্পী সালেক নাছির উদ্দিন ও তাঁর দলের সদস্যদের বিচক্ষণতা, আন্তরিকতাই পারে এরকম পরিপাটি একটি আয়োজন দেশবাসীকে উপহার দিতে। এরকম অনুষ্ঠান শুধু শুধু আনুষ্ঠানিকতার ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়।এরকম অনুষ্ঠান সাহিত্যের মাঠে পলি বিলাবে নিঃসন্দেহে এমনটি আশা করা অমূলক হবে না। জয় হোক সমধারা’র।
মুজাহিদ আহমদ, সম্পাদক, সাহিত্যের ছোট কাগজ- কোরাস
আইনিউজ/এমজিএম
আইনিউজ ভিডিও
কৃষক ও ফিঙে পাখির বন্ধুত্ব (ভিডিও)
পোষ মানাতে হাতির বাচ্চাকে নির্মম প্রশিক্ষণ
হাতির আক্রমণে হাতি হত্যা মামলার আসামির মৃত্যু
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা