শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ২০:৩৩, ৩০ জুলাই ২০২২
যাত্রাপালার যাত্রাপথ (প্রথম পর্ব)
ভারতমুণির নাট্যসূত্র: যাত্রার আদিকথা
কালের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে যাত্রাপালা ও যাত্রাশিল্পীরা
যাত্রাপালা মঞ্চায়নের পূর্বমুহূর্তে মিউজিক পার্টি হারমোনিয়াম, কেসিও, বাঁশি, ঢোল, তবলা, মৃদঙ্গ, খোল প্রভৃতি বাজিয়ে একটি সুন্দর সুর তোলে দর্শক-স্রোতাদেরকে মঞ্চের দিকে আকৃষ্ট করেন। যাত্রাপাড়ায় এটাকে ‘কনসার্ট’ বলা হয়ে থাকে। যাত্রাপালায় এই কনসার্টের গুরুত্ব অপরিসীম। দর্শক শ্রোতাদের অভিমত- কনসার্ট যতো ভালো হবে পালাও ততো মুধুর হবে। দাস্য, সখ্য, হাস্য, বীভৎস, শান্ত, মধুর, করুণ, রুদ্র, বীর এই নবরসে সিঞ্চিত বর্তমানের যাত্রাপালা। নায়ক-নায়িকাদের ও অন্যান্য চরিত্রদের সঙ্গে একজন কৌতুক অভিনেতাও একালের যাত্রাপালায় যুক্ত হয়েছে।
আমাদের আদি বাঙালি গ্রাম্য সমাজে বিনোদন বিলিয়ে দিতে যাত্রার ভূমিকা আকাশসম। জমিদার বাড়ির প্রশস্ত উঠোনে কুপি বাতি জ্বালিয়ে কিংবা বিশাল মাঠের কোনো এক বটবৃক্ষের নিচে রাত-বিরেতে বসে যাত্রা দেখার দিন ফুরিয়েছে। কালের চাকায় যাত্রাশিল্প এখন পিষ্ট হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তবু যাত্রার যৌবন একদা ছিলো, ছিলো যাত্রা দেখার মানুষও। তা নাহলে সিরাজগঞ্জের বাসন্তী মুক্ত মঞ্চ নাট্য প্রতিষ্ঠান (১৯৫৪), ঝালকাঠির নাথ কোম্পানি যাত্রাপার্টি (১৯৫৫), চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা (১৯৫৮), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরা (১৯৬০) ও ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরার (১৯৬০) মতো যাত্রাদলগুলো তৈরি হতে পারতো না। কিন্তু বাংলা যাত্রাপালার যাত্রা শুরু কবে থেকে?
এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে মতানৈক্যের শেষ নেই। ঋগ্বেদ এর অনেক সূক্তে সংলাপ বিদ্যমান। এই সংলাপগুলিও নাট্যগুণে গুণান্বিত। ঋগ্বেদের ১০/১০-এ যম-যমী সূক্ত, ১০/৯৫-এ পুরূরবা-উর্বশী সূক্ত এবং ৪/১৮ এর ইন্দ্র-অদিতি-বামদেব প্রভৃত সূক্তগুলো উৎকৃষ্ট নাট্যসংলাপের ধারায় রচিত বা লিখিত। কিন্ত এগুলো কখনোই মঞ্চে অভিনীত হয়নি। তাছাড়া বেদ যেহেতু সর্বজনশ্রুত ছিলো না তাই এ সংলাপগুলোর নাটগুণালাপ করাও বৃথাই।
যাত্রাপালার উৎসস্থল হিসেবে অনেক গবেষক পাঁচালীকে মূল্যায়ন করেন। যদিও পাঁচালীর সাথে যাত্রার পার্থক্য বিদ্যমান। যেখানে একটি যাত্রাপালায় একাধিক শিল্পী অভিনয়ের কাজ করেন সেখানে একটি মাত্র মূলচরিত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় একেকটি পাঁচালী। ১৪৮১ সালের পর শঙ্করদেব নাচগান সহযোগে যে 'ভাওনা' করেছিলেন তার নাম ছিলো 'চিহ্নযাত্রা'।
ভারতমুণির নাট্যসূত্র
ভারতমুণির নাট্যসূত্রে আছে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে 'গ্রাম্যধর্ম প্রবৃত্ত' হয়ে কাম ও লোভের বশবর্তী হলে জনগনের হৃদয়ে ঈর্ষা ও ক্রোধের সৃষ্টি হয়। সামাজিক এই বিশৃঙ্খলা দূরীকরণের জন্য মহেন্দ্র প্রমুখ দেবগণ পিতামহ ব্রহ্মার কাছে গিয়ে একই সঙ্গে দৃশ্য ও শ্রব্য এমন একটি 'ক্রীড়নীয়ক' সৃষ্টির প্রার্থনা জানালেন, যাতে সর্বধর্মের এবং সবার অধিকার থাকে এবং যার প্রয়োগে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। তখন ব্রহ্মা যে ক্রীড়নীয়ক সৃষ্টি করলেন তাই নাট্যবেদ বা পঞ্চমবেদ। দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে ব্রহ্মা এই পঞ্চমবেদ শিক্ষা দেয়ার ভার ভরতকে প্রদান করেন এবং তাঁর শতপুত্র নিয়ে নাট্যচর্চার নির্দেশ দেন। 'মহেন্দ্র বিজয়োৎসব' উপলক্ষে আচার্য ভরত, ব্রহ্মা রচিত ও নির্দেশিত 'দেবাসুরসংগ্রাম' নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ব্রহ্মা রচিত দ্বিতীয় নাটকের নাম 'অমৃতমন্থন' এবং তৃতীয় নাটকের নাম 'ত্রিপুরদাহ'। ভারতবর্ষে সংস্কৃত নাটকের যাত্রা ধর্মকে ঘিরে এভাবেই শুরু হয়েছিলো, এটা অনুমান করা যায়।
মানুষ যখন ভাষার জন্ম দেয়নি, তখনও তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। আকারে, ইঙ্গিতে, বিভিন্নভাবে অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে জন্মের পর থেকেই একজন আরেকজনের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করে আসছে। 'অভিনয়'ও তাই, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কোন দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপনই 'অভিনয়'।
'হরিবংশ'- গ্রন্থে বন-যাত্রার কথা উল্লেখ আছে। 'অভি' অর্থ সম্মুখে আর 'নী' অর্থে নিয়ে আসা বা তোলে ধরা। যেকোন বিষয় বা ঘটনাকে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে সংলাপের মাধ্যমে উপস্থাপনা করাই অভিনয়।
যাত্রাপালার ইতিহাস
যাত্রাপালার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাত্রাশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। জানা যায়, দ্বাদশ শতকে রাজা লক্ষণসেনের সভাকবি জয়দেবগোস্বামী রচিত 'গীতগোবিন্দ' পালাগানে তার স্ত্রী পদ্মাবতী নাচতেন।
শুরুতে ছন্দে রচিত ধর্মীয় কাহিনীভিত্তিক কাহিনীগুলো পালায় গ্রথিত করে গদ্যসংলাপ দিয়ে মঞ্চায়নের কাজ শুরু হয়। শুরুতে পালায় সঙ্গীতের প্রাধান্যই ছিলো বেশি। জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ', বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন ইত্যাদি ধর্মীয় পালাগুলোতেও সঙ্গীতের প্রাধান্যই ছিলো বেশি। সেসময় অনেকসময় পালাকারেরাও অভিনয়ে অংশ নিতেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য চন্দ্রশেখর আচার্যের গৃহে স্বয়ং কৃষ্ণলীলায় অভিনয় করেন। কৃষ্ণ সেজেছিলেন অদ্বৈত আচার্য আর শ্রীরাধা ও রুক্ষ্মিণীর দ্বৈত ভূমিকায় ছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু।
যাত্রাপালার বিষয় ও আঙ্গিক
যাত্রাপালার যখন যাত্রা শুরু হয় তখন সেসব পালার বেশিরভাগই রচিত হতো ধর্মীয় কাহিনীকে নির্ভর করে। তবে পরবর্তীকালে ধর্মীয় কাহিনীর বাইরে গিয়ে ইতিহাস, সমাজ, গোয়েন্দাকাহিনী ইত্যাদি বিষয়ও পালায় যুক্ত হতে থাকে। গোয়েন্দা, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পালাগুলোতে রাজকীয় ও জমকালো পোশাকের প্রয়োজন হয় যাত্রাশিল্পীদের। কিন্তু সামাজিক ও ধর্মীয় পালাগুলোতে সেসব কিছুই লাগেনা। গৃহস্থের সাধারণ বেশভূষাই এসব পালায় প্রাধান্য পায় বেশি।
যাত্রার সংলাপ সবসময় মুখস্ত করা যায় না। দীর্ঘ পালার সবটুকু মনে রাখা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই পালায় সময় ডায়লগ পাশ থেকে বলে দেয়ার জন্য একজন লোক রাখা হয়। তিনি 'প্রোমোটার' নামে পরিচিত। এনার কাজ মঞ্চের নির্ধারিত এককোণে বসে যাত্রাশিল্পীকে সংলাপ মনে করিয়ে দেয়া। আগে আস্তে আস্তে 'প্রোমোটার' সংলাপ বলেন। তা শুনে মূল অভিনেতা তা অভিনয়সহযোগে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন।
একটি সফল যাত্রাপালা করতে সবার আগে প্রয়োজন যাত্রাবই। যে বইয়ে পালার কাহিনী লিখা থাকে। যাত্রাপালা রচিত বইগুলোর একটা নির্দিষ্ট আকৃতিও আছে। সাধারণত ৭ ইঞ্চি লম্বা এবং ৫ ইঞ্চি প্রস্থের হয়ে থাকে বইগুলোর আকার। প্রোমোটররা প্রোমোট করার সময় বইটিকে মুঠোর ভেতর রেখে ব্যবহার করেন বলেই এর কভার সামান্য মোটা কাগজে তৈরি করা হয়; বোর্ডবাইণ্ডিং হয়না।
যাত্রাপালার দৃশ্য
যাত্রাপালায় পাঁচটি অঙ্কের মধ্যে বিশ থেকে বাইশটি দৃশ্য থাকে। প্রথম অঙ্কে চারটি দৃশ্য; এই চারটি দৃশ্যের মধ্যে সকল চরিত্রের উপস্থাপন ও ঘটনার বিষয় সম্পর্কে সংলাপের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের অবহিতকরণ।
দ্বিতীয় অঙ্কে পাঁচটি দৃশ্য এবং ঘটনার ঘনঘটা শুরু; পালার এ পর্বে দর্শক শ্রোতাদের উদ্বিগ্নতার পালা, বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে আলোচনা। তৃতীয় অঙ্কে পাঁচটি দৃশ্য এবং ঘটনার চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে ধাবমান; দর্শক শ্রোতারা এ পর্যায়ে অনুমান করতে পারেন পালাটি কোন পথে হাঁটতে চলেছে। এই পর্বে দর্শক-শ্রোতাও পালার সাথে মিশে একাকার হয়ে যান।
চতুর্থ অঙ্ক, এই অঙ্কে তিনটি বা চারটি দৃশ্য হতে পারে। এই পর্বে ঘটনা নিষ্পত্তির দিকে ধাবিত হয়। অনেক চরিত্রের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। পঞ্চম অঙ্কে দৃশ্য সংখ্যা দুইটি বা তিনটি। এইসব দৃশ্যে পালার যবনিকা টানা হয়।
যাত্রাপালা মঞ্চায়নের পূর্বমুহূর্তে মিউজিক পার্টি হারমোনিয়াম, কেসিও, বাঁশি, ঢোল, তবলা, মৃদঙ্গ, খোল প্রভৃতি বাজিয়ে একটি সুন্দর সুর তোলে দর্শক-স্রোতাদেরকে মঞ্চের দিকে আকৃষ্ট করেন। যাত্রাপাড়ায় এটাকে ‘কনসার্ট’ বলা হয়ে থাকে। যাত্রাপালায় এই কনসার্টের গুরুত্ব অপরিসীম। দর্শক শ্রোতাদের অভিমত- কনসার্ট যতো ভালো হবে পালাও ততো মুধুর হবে। দাস্য, সখ্য, হাস্য, বীভৎস, শান্ত, মধুর, করুণ, রুদ্র, বীর এই নবরসে সিঞ্চিত বর্তমানের যাত্রাপালা। নায়ক-নায়িকাদের ও অন্যান্য চরিত্রদের সঙ্গে একজন কৌতুক অভিনেতাও একালের যাত্রাপালায় যুক্ত হয়েছে।
আগামীকাল পড়ুন এই ধারাবাহিক লেখার দ্বিতীয় পর্ব-যাত্রাপালার শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতা : অতীত থেকে বর্তমান
লেখক: শ্যামলাল গোসাঁই সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও কবি
আইনিউজ ভিডিও
নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে ছুটছেন সিলেটবাসী
মৌলভীবাজারে বন্যা, জলমগ্ন টিবি হাসপাতাল রোড
ঘরে থৈ-থৈ পানি, নেই খাবার পানি, বিদ্যুৎ নেই, নেটওয়ার্ক নেই
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা