অনিক দেব
ছোটগল্প: মহাজন বাড়ির দুর্গাপূজো
প্রচ্ছদ- আইনিউজ
একটি আত্মহত্যার পর কেমন স্থবির হয়ে গেলো বাড়িটা, কোথাও কোলাহল নেই, কাক-পক্ষীও যেনো মাড়ায় না এ বাড়িতে, অমাবস্যার মতো কাল অন্ধকার বিরাজ করছে সারা বাড়ি জুড়ে। বিছানার একপাশে এখনও পড়ে আছে তার পানের বাটা, সুপারি কুটার যন্ত্রটাও পড়ে আছে স্বস্থানে, শুধু নেই অপর্ণা।
অপর্ণা এই বয়সে এসে এরকম একটা কাণ্ড ঘটাতে পারে আমি বা, আমরা কেউ কল্পনাও করিনি। ছেলে-মেয়ে নিজেদের মতো কাজ-কর্ম করছে, বিয়ে করেছে, সংসার করছে। বড় ছেলে বসেছে লাইব্রেরিতে, একমাত্র নাতিকে নিয়ে অপর্ণার সময় কতো সুন্দর কাটছিলো। দুর্গাপূজোর জন্য কেনাকাটার ফর্দটাও সে নিজ হাতে লিখে গেছে। হঠাৎ করে কি হয়েছিলো তার আমরা কেউ-ই বুঝে উঠতে পারিনি।
অন্তত আমি তো তাকে তিন যুগের অধিক চিনি, একদম হৃদয় দিয়ে জানি। কই কোনোদিন তো কোথাও ফাঁরাক দেখিনি, কোনো অতীত পিছুটানের গল্পও ছিলো না তার, কিশোরী মেয়ে থেকে আমার সাথে বৃদ্ধা হলো, অতঃপর তার কি অভিমান ছিলো, কার প্রতি এতো অভিযোগ জন্মালো? এতো বছর পরে, এতোটা বয়স পেরিয়ে তাকে কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলো, নিজ হাতে সৃষ্ট এতোসব নিপুণ সমাচার রেখে কেনো সে পাড়ি দিলো!
নিজের জন্য মোটেও খারাপ লাগছে না, ছেলে-মেয়েদের মলিন মুখ দেখতে দেখতে আর ভালো লাগছে না। মাস হয়, এতো হৈ-হুল্লোড়ে ঘেরা বাড়ি আমার আজ নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ, বিভৎস চিৎকার করছে পোষা পায়রাগুলোও। দানা-আহারের জো নেই, সবার ভেতরে এক অসীম নীরবতা বিরাজ করছে। একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, রুষ্ট কণ্ঠে আদেশ দিলাম- সবাই যেনো যার যার কাজে মনযোগী হয়, কাউকে যেনো ফের মনমরা না দেখি।
বাজার-সদাই করে দেয় দীর্ঘদিনের ভৃত্য, তাঁকে সম্মানের চোখে সকলেই কাকাবাবু বলে ডাকে। আমি ডাক দিলাম- অমল, বিকেলের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক চাই, প্যান্ডেল, মণ্ডপ সব গুছিয়ে নাও, সামনের সপ্তাহে পূজো। এ বাড়িতে কোনোদিন অমাবস্যার মতো এতো অন্ধকার নামেনি, দ্রুত পূজোর বন্দোবস্ত চাই। কোনো প্রকার ত্রুটি আমি সমীহ করবো না।
অমল নিজেও ভীষণ বিষণ্ণ, নিজের বড়ভাইয়ের মতো মান্য করে আমাকে৷ বউদির এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্থানে সেও বিচলিত, অপর্ণা এভাবে আমাদের সবাইকে ভয়াল বিচলিত করে যাবে, কে ভেবেছিলো!
ঠাকুর গড়ার কাজ প্রায় শেষ, পূজোর আয়োজন চলছে, অপর্ণার বিদায়ে আত্মীয়দের আনাগোনা কমেছে। তবে দুই মেয়ে, মেয়ের জামাই, নাতি-পুতিরা যথারীতি এসেছে। আমেজ কম, কিন্তু পূজোর সাথে এই বাড়ির কয়েকপুরুষের সম্পর্ক। পুরো এলাকাজুড়ে নামডাক আছে- মহাজন বাড়ির দুর্গাপূজো।
আগামীকাল মহাষষ্ঠী, পুরোহিত মশাই এসেছেন, সবকিছু ঠিকঠাক। শিশুরা আনন্দ করছে, বউমা কঠিন মুখেও আলতো হাসি হেসে নারকেল নাড়ু বানাচ্ছে, বড়ছেলের তটস্থতার শেষ নেই। আমার পরে সে-ই এই বাড়ির কর্তা, এদিকে ওদিক সর্বদিক সামলেও একটু পর পর আমার কাছে আসছে- বাবা, আর কিছু করতে হবে? আর কি করা প্রয়োজন? বেশ উদ্বেগ আর আনন্দ নিয়ে আমাদের সন্ধ্যা পেরুলো। পূজো পূজো আমেজ কিছুটা হলেও এসেছে, আমি অপর্ণাকে ভেবে চোখের জল ফেলছি। এই সংসারে তার চেয়ে ঢের অন্নপূর্ণা, ত্রিনয়না, দশভূজা আর কে আছে!
রাতে যখন সবাই ঘুমানোর জন্য চিন্তা করছে, আমি তখনও রেলিংয়ের ধারে বসে আছি। বোধহয় তখন সবাই ঘুমিয়েও পড়েছে, প্রায় শেষরাত হবে- হঠাৎ অমলের চিৎকার শুনতে পেলাম। দাদাবাবু, সর্বনাশ হয়ে গেছে, ওরা এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে, ভেঙে ফেলেছে সবগুলি মূর্তি। প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
আমি দৌড়ে বের হলাম, একে একে বের হলো সকলে, তখন ভোর হয়ে গেছে, দেখলাম- চোখের সামনে জ্বলছে সবকিছু, আমার মনে হলো- এই আমি অপর্ণাকে চিতায় জ্বলতে দেখছি। এর আগে অপর্ণার চিতা আমাকে এতোটা ভস্ম করেনি, আজ এক্ষণে মনে হচ্ছে জগতের সমস্তকিছু ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। কাউকে সামলাতে পারছি না, পানি ঢেলেও আগুন নেভানো সম্ভব হচ্ছে না, যেনো পানির স্রোতে দ্বিগুণবেগে জ্বলে উঠে সাম্প্রদায়িকতার আগুন। ছেলে-মেয়ে-শিশুরা কান্না জুড়ে দিলো, এক গগণবিদারী চিৎকারে ভরে গেলো আমার বাড়ি।
এখনও মহাষষ্ঠীর লগ্নের কিছুটা বাকি আছে, আমি অপর্ণার ঘরে এসে সিঁদুরের কৌটো খুঁজছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে পেলাম কৌটো, সাথে পেলাম এক টুকরো চিরকুট। তাতে লেখা-"ওরা সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিবে, আমি আগাম বার্তা পেয়েছি, আমি এই তাণ্ডবলীলা দেখতে পারবো না, তাই চলে গেলাম, এ বাড়িতে আর কোনোদিন দেবীমাতার পূজো হবে না এ আমি সইতে পারবো না, আমাকে ক্ষমা করে দিও।"
আমার ভেতরটা তখন আরো জ্বলে উঠলো, আমার অপর্ণার আত্মহত্যার কারণ তবে ওরা! মনে মনে শপথ নিলাম- ওদের আগুনে ওরাই পুড়বে, ওদের হিংস্রাত্মক আক্রমন একদিন ওদেরকেই বিনাশ করবে। বাহিরে এসে ক্রন্দনরত হতবিহ্বল ছেলে-মেয়েকে বললাম- কান্না থামাও, পূজো হবে। এ বাড়িতে পূজো কেউ থামাতে পারবে না।
বউমা বললো, কিন্তু বাবা, কিছু তো আর অবশিষ্ট নেই। ওরা সব শেষ করে দিয়েছে!
আমি বললাম, কিচ্ছু শেষ হয়নি, এই নাও তোমার শ্বাশুড়ির বিয়ের বেনারসি, আজ তোমাকে প্রতিমার স্থান দিলাম, তুমিই হবে এ বাড়ির ত্রিনয়না, দশভূজা।
কেউ আমার কথার উপর টুঁ শব্দটি করলো না। শাঁখ-কাসর-ঢোল বেজে উঠলো, দেবীকে বিল্বতলে আহবান জানালাম, এবং ভক্তিভরে প্রার্থনা করলাম- মা আমার, এবার তুমি-ই সংহার করো এই পাপাত্মাদের, রক্ষা করো তোমার পুণ্যকামী সন্তানদের...
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা