শ্যামলাল গোসাঁই
কোরআনের বাংলা অনুবাদে এতো বিলম্বের পেছনের কারণ কী?
১৮০৮-১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্তও বাংলা অঞ্চলে বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআনের কোনো কপি পাওয়া যায়নি
বাংলা ভূ-ভাগে মুসলমান সংস্কৃতির সাথে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি সবথেকে বেশি মিশ্রিত হবার সুযোগ ঘটে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা দখলের সুবাদে। লক্ষণ সেনকে রাজ সিংহাসন থেকে হটিয়ে মুসলিম শাসনামলের শুরু করেন এই তুর্কী সেনা। ফলে ধীরে ধীরে এ গাঙ্গেয় অঞ্চলে নব্য তৈরি হওয়া বাঙালী মুসলিম সমাজে কোরআন পড়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করা হয়।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ভাষাটি। পবিত্র কোরআন শরীফের ভাষা যে বাংলা নয়, আরবী। একেবারেই অপরিচিত একটি ভাষা। তবু সেসময় বাংলা ভাষার মাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি ইসলাম ধর্ম প্রচার ও ধর্মবিষয়ক গ্রন্থাবলী রচনা উৎসাহিত করেন সেসময়ে মুসলিম সাহিত্যিকরা।
মধ্যযুগীয় কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর এদের অন্যতম। মাতৃভাষায় কোরআনি সাহিত্যচর্চার গুরুত্বটি ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগের কবি সৈয়দ সুলতানের (১৫৫০-১৬৪৮) ‘ওফাতে রসূল’ নামক কাব্য গ্রন্থেও প্রতিফলিত হয়েছে।
কোরআনের বাংলা অনুবাদের সন্ধানে
১৮০৮-১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্তও বাংলা অঞ্চলে বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআনের কোনো কপি পাওয়া যায়নি। ১৮০৮-০৯ সালের দিকে পবিত্র কোরআনের আমপারা ভাগের কিছু বাংলা অনুবাদ হঠাৎ পাওয়া গেলে মুসলিম সমাজে রীতিমত ঝড় ওঠে। কেননা, এটিই যে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা পবিত্র কোরআনের প্রথম সংস্করণ।
আমিরুদ্দিন বসুনিয়া নামের রংপুরের এক মাওলানা এই অনুবাদটি করেন। সেসময় এটিই ছিলো একমাত্র বাংলা সংস্করণ। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোরআনের অনুবাদ করেন নি বসুনিয়া মহাশয়। তিনি কেবল, কোরআন শরীফের আমপারা অংশটির অনুবাদ করেছিলেন। এ খণ্ডিত অনুবাদটি ছিল বাংলা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় আমপারার কাব্যানুবাদ।
বাংলা ভাষায় কোরআন অনুবাদে এতো বিলম্ব হলো কেন?
আগেও বলেছি, পবিত্র কোরআন মাজীদের মূল ভাষা হলো আরবী। আরবী ভাষায় এই মহাগ্রন্থটি নাজিল হয়েছে। অন্যদিকে এই গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে অর্থাৎ বঙ্গদেশে আরবী ছিল একেবারেই অশ্রুত ভাষা। ইউরোপীয়, ডাচ, পর্তুগীজ বণিকদের বদৌলতে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা উর্দু, হিন্দি, ফার্সি, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার সাথে যতোটা পরিচিত ছিলেন আরবী ভাষার সাথে ততোটা ছিলেন না।
তাই শুরুতেই কোরআন শরীফ বুঝার ক্ষেত্রে এবং অনেকাংশে পড়ার ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলের মানুষদের অসুবিধা হচ্ছিলো। বাংলা অনুবাদ করার কথা ভাবাও তখন দূরহ। তাছাড়া এ অঞ্চলের যারা ছিলেন বড় বড় ইসলামিক স্কলার তারাও মূলত দেওবন্দ হতে দীক্ষা নিয়ে আসায় তাদের ফার্সি ভাষায় দক্ষতা থাকলেও আরবীর ক্ষেত্রে ছিলেন কাঁচা। ফলে তাদের মাধ্যমেও কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদ সম্ভব হয়নি।
বাংলা ভাষার আগে পবিত্র কোরআন শরীর হিন্দি ভাষায় অনুবাদিত হয়েছিলো বলে শোনা যায়। এতে বাংলায় কোরআন অনুবাদের পথ কিছুটা হলেও মসৃণ হয়েছিলো। কেননা, আরবী ভাষার সাথে এ অঞ্চলের মানুষের পূর্ব পরিচয় না থাকলেও হিন্দি তাদের কাছে ছিলো বহুলশ্রুত। তাই হিন্দি তর্জমা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা অনেকখানিই সহজ হয়ে যায়।
তবু কোরআন শরীফের মুটামুটি পাঠ্য বাংলা অনুবাদের জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয় ১৮০৮-১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মূলত, এই সময়কাল থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সময় ভেদে পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদের খবর আসতে থাকে।
ভাই গিরিশচন্দ্রসহ কোরআনের আরও কিছু বাংলা অনুবাদক
আমির উদ্দীন বসুনিয়ার পর কোরআনের বঙ্গানুবাদে এগিয়ে আসেন কলকাতার পাটওয়ার বাগানের আকবর আলী। ব্রিটিশ-ভারতের রাজেন্দ্রনাথ মিত্র, গিরিশ চন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০), খ্রিস্টান পাদ্রি তারাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, টাঙ্গাইলের মাওলানা নঈমুদ্দিন (১৮৩২-১৯০৮), দিনাজপুরের আকবর উদ্দিন, ব্রিটিশ-ভারতের একজন দেশীয় খ্রিস্টান শ্রী ফিলিপ বিশ্বাস প্রমুখ।
এদের মধ্যে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বঙ্গানুবাদটি ছিল পূর্ণাঙ্গ আর অন্যদের অনুবাদ ছিল খণ্ডিত। গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদটি অনেকটা আক্ষরিক পর্যায়ের। এতে টীকা-টিপ্পনী সংযুক্তির ফলে এটিকে অর্থানুবাদও বলা যায়। এর ভাষা প্রাঞ্জল। তবে সংস্কৃত শব্দের প্রভাবও কম নয়। প্রাথমিক পর্যায়ের কোরআন হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম পণ্ডিত ও সাহিত্যিকরা অনুবাদটির প্রশংসা করেছেন।
আকবর আলীর অনুবাদটি ‘তরজমা আমছেপারা’ নামে বাংলা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় কাব্যানুবাদ। কলকাতা থেকে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মাওলানা নঈমুদ্দীন সর্বপ্রথম কোরআনের বঙ্গানুবাদসহ ভাষ্য রচনা করেন। তার অনূদিত কোরআন ১ম থেকে ৯ম পারা পর্যন্ত তার জীবদ্দশায় (১৮৮৭-১৯০৮) খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
তার পুত্ররা ২৩ পারা পর্যন্ত কোরআনের বঙ্গানুবাদ ও ভাষ্য ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। শ্রী ফিলিপ বিশ্বাসের অনুবাদটি ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। অনুবাদটি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলে তৎকালীন জনতার প্রতিবাদের মুখে ব্রিটিশ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে।
সিলেটের আবুল মনসুর লিখেছিলেন ‘কোরআন কুসুমাঞ্জলি’
সৈয়দ আবুল মনসুর। সৈয়দ মনসুর ছিলেন সিলেটের অধিবাসী। তিনিও কলকাতা থেকে ১৯৩৫ সালে ‘কোরআন কুসুমাঞ্জলি’ নামে পবিত্র কোরআন অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। পরে ‘কোরআন মঞ্জরি’, ‘কোরআন মঙ্গল’ ইত্যাদি নামে আরো কিছু সুরার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দের অনুসরণ করে তিনি কোরআনের কাব্যানুবাদের অনুশীলন করেছিলেন।
পদ্যে-গদ্যে কোরআন অনুবাদ করেছিলেন কাজী নজরুলও
বাঙালীর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই কীর্তিমান সাহিত্যিক তার পদ্য এবং গদ্য দুই প্রতিভাকেই কাজে লাগিয়ে পবিত্র কোরআনের অনুবাদ করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে নজরুলের সে অনুবাদ ‘কাব্য আমপারা’ নামে কলকাতা থেকে প্রকাশ হয়।
কবি নজরুলের অনুবাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কাব্যানুবাদ শেষে মার্জিনের নিচে আরবি সুরার বাংলা অর্থ পরিবেশন করেছেন।১৯২০ সালে ‘আমপারা’ শীর্ষক অংশে পবিত্র কোরআনের অনুবাদের খণ্ডাংশ কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। গদ্য ও কাব্য—এ দুই-ই বিচ্ছিন্নভাবে অনুবাদে তিনি কাজে লাগান নজরুল।
নজরুলের কোরআন অনুবাদের ফলে বাংলা সাহিত্য মহলে এটি আরও একবার বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
পাঞ্জাবের গুরুমুখী লিপিতে কোরআনের অনুবাদ
পাঞ্জাবী ভাষার গুরুমুখী লিপিতে প্রকাশিত একটি কোরআন সম্প্রতি পাঞ্জাব এর মোগা জেলার লান্ডগাঁও এ খুঁজে পাওয়া গেছে৷ এটি ১১৫ বছরেরও বেশি পুরনো বলে মনে করা হয়।
এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বলতম নিদর্শন হিসেবে শিখ সম্প্রদায়ের নির্মল মতাবলম্বী সন্ত বৈদ্য গুরদীত সিং আলমহরি কর্তৃক অনুবাদিত পাঞ্জাবী ভাষার এ কোরআনটি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে৷ এ প্রকাশনায় সহায়তা করেন হিন্দু ব্যবসায়ী ভগৎ বুদ্ধমল অদতল এবং বৈদ্যভগ ও এক শিখ সরদার মিল সিং আরিফ।
আইনিউজ/এইচএ
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- ২০ হাজার গানের জনক গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও তার কীর্তি
- প্রেম-ভালোবাসার ১০ উপকারিতা : শ্রেষ্ঠ কিছু প্রেমের গল্প
- কোমরে বাশি, হাতে তালি — গানই মদিনা ভাই’র জীবন-মরণ
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের দেশ ।। Most beautiful woman in the world ।। Eye News
যে গ্রামে পুরুষ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন নারীরা | Women are pregnant without men | Kenyan Girls | Eye News
চুল বেঁধে ঘুমিয়ে নিজের যে ক্ষতি করছেন ।। Hair loss problems
পায়খানা ও প্রস্রাব দীর্ঘক্ষণ চেপে রাখলে যে ক্ষতি হয়??
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা