শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১২:৪৪, ১০ নভেম্বর ২০২২
ধামাইল কবি রাধারমণ দত্ত | Eyenews
প্রতিকৃতি- আইনিউজ
১২৯০ বঙ্গাব্দে ৫০ বছর বয়সে কবি চলে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তার কাছে শিষ্যত্ব লাভ করেন। শুরু হয় কবির বৈরাগ্য জীবন। আরম্ভ করেন সাধনা। গৃহত্যাগ করে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এখানে চলে তার সাধন-ভজন। কবি নিজেই গেয়েছেন- শ্যামের বাঁশিরে ঘরের বাহির করলে আমারে/যে যন্ত্রণা বনে যাওয়া গৃহে থাকা না লয় মনে।
রাধারমণ দত্ত কিংবা ধামাইল গানে যখন ‘ভেবে রাধা রমন বলে’ কথাটি আসে তখনই সবাই বুঝে নেন ধামাইল বা এ গানের পদকর্তা আর কেউ নন, রাধারমণ দত্ত। নিজের গানের পরিচয়ের সাথে যিনি নিজের পরিচয়কে এমনভাবে মিশিয়ে অমর হয়েছেন ধামাইল গান থেকে রাধারমণ দত্তের নাম অপসারণ দুরহ ব্যাপার। ধামাইল গান মানেই যেন তিনি। সিলেটেড় বাড়িতে বাড়িতে বর্তমানে যেসব ধামাইল গীত আকারে গাওয়া হয় এর বেশিরভাগের রচয়িতাই রাধারমণ দত্ত। আজ এই বিশিষ্ট ধামাইল গানের কবির অন্তর্ধানের প্রয়াণ দিবস।
ধামাইল গান ছাড়াও রাধারমণ দত্তের গানের যে শাখাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ তাহল রাধারমণ রচিত দেশ তত্ব, সংসার তত্ব, সৃষ্টি তত্ব বা বিচ্ছেদ অঙ্গের গানগুলো। জবা কুসুম সন্ধ্যামালী আনরে তুলিয়া মনোরঙ্গে সাজাও কুঞ্জ সব সখি মিলিয়া’, ’মুর্শিদ বলি নৌকা ছাড়ো তুফান দেখি ভয় করিও না, মুর্শিদ নামে ভাসালে তরী অকূলে ডুবিবে না’, ‘দেখলাম দেশের এই দুর্দশা, ঘরে ঘরে চুরের বাসা’ এমন গান শুনলেই বুঝা যাবে রাধারমণ দত্তের সংগীত বিচিত্র বিষয়ে পরিপূর্ণ।
রাধারমণের জন্ম ও বংশ পরিচিতি
খ্যাতিমান এই সাধক কবির জন্ম হয়েছিলো প্রাচীন শ্রীহট্টের এক বিশিষ্ট বংশে। রাজবৈদ্য চক্রপাণি দত্তের অধস্তন পুরুষেরা শ্রীহট্টের প্রাচীন সামন্ত বংশ। এই বংশের প্রভাকর দত্তের দ্বাদশ পুরুষে ১৮৩৩ সালে জগন্নাথপুর থানার কেশবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন দত্ত বাবু।
রাধারমণের পিতা রাধামাধব পরম পন্ডিত ও অশেষ গুণের অধিকারী ছিলেন। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা রাধারমণকে প্রভাবিত করে বাল্যকালেই। ফলে কালক্রমে তিনিও একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
রাধারমণের গানের তালিকা
দেহ পতনের আগে রাধারমণ দত্ত ঠিক কতোগুলো গান রচনা করেছিলেন এর সঠিক সংখ্যাগত হিসাব পাওয়া মুশকিল। এর একটি কারণ বৈষ্ণব কবি রাধারমণ একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী ছিলেন। তাই তিনি কোন গানগুলোতে নিজে সুর করেছেন আর কোন গানগুলো তার নিজের রচিত তা বের করা কিছুটা সমস্যার।
রাধারমণের গান নিয়ে সিলেটের লোক গবেষক সুমন কুমার দাশ সম্পাদিত বই অগ্রন্থিত রাধারমণ
বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণে গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে। সাধক রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কলিকাতা থেকে ‘বাউল কবি রাধারমণ’ নামে ৮৯৮ টি গান নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ মনসুর উদ্দীন তার হারামনি গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে রাধারমণের ৫১ টি গান অন্তর্ভুক্ত করেন।
এছাড়াও রাধারমণ সংগীত, সম্পাদক, মোহাম্মদ আসরাফ হোসেন, সাহিত্যরত্ন, ভানুগাছ, শ্রীহট্ট, (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ (১৯৭৭) সম্পাদনা মুহম্মদ আবদুল হাই, সুনামগঞ্জ, শ্রীহট্ট, সিলেটের মোদন মোহন কলেজের সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘রাধারমণ সঙ্গীত’ নামে চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষনের সংগৃহিত একটি গ্রন্থ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা ‘রাধারমণের হাজার কবিতা’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। ঢাকার অ্যার্ডন পাবলিকেন্স প্রকাশ করেছে সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত ‘অগ্রন্থিত রাধারমণ’। আরও অনেক বিদগ্ধজন রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহ করেছেন।
কেশবপুর গ্রামটাই যেন রাধারমণের গানের খাতা
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার কবি বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাউল কবি রাধারমণগীতি সংগ্রহ’ গ্রন্থে ‘রাধারমণের জীবনী কথা’য় তিনি বলেছেন- যদিও রাধারমণের স্বগৃহে আমরা খুব বেশি সংখ্যক গান পাইনি, তবু কেশবপুর গ্রামেই এখনো প্রচুর অসংগৃহীত গান ছড়িয়ে আছে, নানা কারণে আমরা তার অংশমাত্র সংগ্রহ করতে পেরেছি।
অন্যদিকে স্থানীয়রা বলছেন, দেশ বিভাজনের পর তঁর ভক্তরা অনেকেই আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে ও অন্যত্র সরে এসেছেন। অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফ সাহেবের মাধ্যমে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের জামাইপাড়ার জনৈক শ্রীযুক্ত সতীশ রায়ের সংগ্রহেই একসময় সহস্রাধিক গানের সংগ্রহ ছিল।
তারা এটিও জানান যে, শ্রীযুক্ত সতীশ রায় কাছাড়ের শিলচরে এসে কিছুকাল বসবাসের পরই লোকান্তরিত হন এবং তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা কেউ সেই সংগৃহীত গীতরাশির কোনো হদিশ দিতে পারেন নি। রাধারমণের প্রায় ১০৫০টি গান ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ হয়েছে।
অসাম্প্রদায়িক শব্দ বন্ধনে বান্ধা রাধারমণের গান
রাধারমণের গান প্রার্থনা, আত্মতত্ব, দেহতত্ব এবং পরমাত্মা বিষয়ের মাঝেই বন্দী থাকেনি। এসব বিষয়াদি ছাড়া তার স্বদেশ প্রেমেরও অনেক গান রয়েছে। রাধারমণের গানে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ছিলা না। আল্লাহ্-ঈশ্বরে যেমন তিনি পার্থক্য দেখেন নি, গুরু এবং মুর্শিদ শব্দের পার্থক্য দেখান নি।
তার গানের সুরে ভূবন মাতোয়ারা হলেও রাধারমন দত্তের নিজের ভূ-সম্পতি অর্পিত হওয়ায় রাধারমণ গবেষক ও ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। রাধারমণ দত্তের গানের চর্চা বাড়াতে রাধারমণের জন্মভিটায় রাধারমণ কমপ্লেক্স দ্রুত নির্মাণের দাবি রয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীদের। সেজন্য তার জন্মভিটায় রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী।
লোক সাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডার রাধারমণের গান
রাধারমণ দত্তের অমূল্য সৃষ্টিকর্ম আমাদের লোক সাহিত্যের অমূল্য রত্নভান্ডার। তার রচিত গান সাধন ভজনের পরিধি সত্বেও কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর সৃষ্টিতে রয়েছে জীবনবোধের অন্য এক মায়াবী আধার, এর সংস্পর্শে এলেও আনন্দ লাভ হয়। তার গানের ওপর ইউরোপের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস হচ্ছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে তার অনেক গান হারিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে রাধারমণের কিছু গানের কথা ও সুর বিকৃত করা হচ্ছে। এজন্যই হয়তো জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি লিখেছিলেন,‘আমার সাধনার ধন হইল চুরি, আমি কার পানে চাইরে।’
মৌলভীবাজারে এসে বৈরাগী হয়ে যান রাধারমণ দত্ত
রাধারমণ দত্ত বাল্যকাল পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। শাস্ত্রীয় পুস্তকাদীর চর্চা ও সাধু সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে তিনি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যদি নানা মত ও পথের সঙ্গে পিরিচিত হন। কবির সংসারজীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় নি। শুধু জানা যায়, রাধারমণ-গুণময় দেবীর ৪ ছেলে ছিল। তাদের নাম- রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত, রসিকবিহারী দত্ত ও বিপিনবিহারী দত্ত।
একমাত্র পুত্র বিপিনবিহারী দত্ত ছাড়া বাকি ৩ পুত্র এবং স্ত্রী গুণময় দেবী অকালে মারা যান। স্ত্রী ও পুত্রদের পরলোক গমনে কবি রাধারমণ দত্ত সংসারজীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন।
রাধারমণ সমাধি মন্দির। এখানেই শুয়ে আছেন লোকসাহিত্যের এ খ্যাতিমান সাধক কবি
১২৯০ বঙ্গাব্দে ৫০ বছর বয়সে কবি চলে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তার কাছে শিষ্যত্ব লাভ করেন। শুরু হয় কবির বৈরাগ্য জীবন। আরম্ভ করেন সাধনা। গৃহত্যাগ করে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এখানে চলে তার সাধন-ভজন। কবি নিজেই গেয়েছেন- শ্যামের বাঁশিরে ঘরের বাহির করলে আমারে/যে যন্ত্রণা বনে যাওয়া গৃহে থাকা না লয় মনে।
রাধারমণের মৃত্যু এবং সর্বশেষ...
১৯১৫ সালের ১০ নভেম্বর দেহ পতন হয় সাধক কবি রাধারমণ দত্তের। তার মৃত্যুর মধ্যব দিয়ে তার রচিত লোক সাহিত্যগুলোও চোখের আড়াল হতে শুরু করলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের চেষ্টায় তার গানের অনেকাংশই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
সিলেটের মোদন মোহন কলেজের সাহিত্য পরিষদ থেকে 'রাধারমণ সঙ্গীত' নামে চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষনের সংগ্রীহিত একটি গ্রন্থ ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার অ্যার্ডন পাবলিকেন্স প্রকাশ করেছে সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত ‘অগ্রন্থিত রাধারমণ’ বইটি। দীর্ঘকাল পর রাধারমণের অগ্রন্থিত গান সংগ্রহ হওয়ায় এ গ্রন্থটি বোদ্ধামহলে প্রশংসা কুড়ায়।
রাধারমণের গানের কিংবদন্তি শিল্পী একুশে পদকপ্রাপ্ত সুষমা দাশের কাছ থেকে মূলবাণীতে রাধারমণের শতগানসহ আরো অনেক প্রাচীন গান নিয়ে আজিমুল রাজা চৌধুরীর সংকলন ও সম্পাদনায়'সুষমা দাশ ও প্রাচীন লোকগীতি'নামে একটি বই ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়।
আইনিউজ/এইচএ
এ বিভাগে আরও পড়ুন-
- জীবনানন্দ দাশ : বাংলা সাহিত্যে যার মৃত্যু এক ধোঁয়াশা
- ভাটির কবি আব্দুল করিম এবং কিছু কথা
- দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: ইতিহাসে ভিন্নরকম এক সঙ্গীতায়োজন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
মানুষ হত্যা করেছে মা হাতিকে, দুধের জন্য কাঁদছে বাচ্চা হাতিটি
৪০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হলো একটি মাছ, রাতরাতি ধনী জেলে
দুবাইয়ে লটারি জিতে একরাতে কোটিপতি বাংলাদেশী যুবক | দুবাই প্রবাসী
আদিবাসী জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি । Indigenous Culture । Eye News
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা