Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১০ এপ্রিল ২০২৫,   চৈত্র ২৭ ১৪৩১

লাবণ্য চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৩:০৭, ২৪ নভেম্বর ২০২২

একজন অত্যাচারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরোনো দুটি ছবি।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরোনো দুটি ছবি।

কবিগুরু অত্যাচার করেছেন তার নিজের জামাই এবং একমাত্র জীবিত আপন ছেলের সাথেও। কবিগুরু ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কৃষি শিক্ষা নেওয়ার জন্য ১৯০৬ সালে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। প্রায় সোয়াশ বছর আগে অন্যান্য ধর্ণাঢ্য বাঙালির মতো ছেলেকে বিদেশে ব্যারিস্টারি পড়তে না পাঠিয়ে চাষাবাদ শেখাতে পাঠিয়ে তার ছেলেটির সাথে রবীন্দ্রনাথ অত্যাচার করেছিলেন সত্যি। কিন্তু করেছিলেন দেশের সাধারণ কৃষকদের আরেকটু ভালো কৃষি সেবা দেবার লক্ষ্যে। ভেবেছিলেন ছেলে বিদেশ থেকে কৃষি কাজ শিখে এসে এদেশের কৃষকদের মাঝে তা ছড়িয়ে দেবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরু, গানের পাখি, বাংলা সাহিত্যের উঁচু পর্বত- এসমস্ত ভূষণ যেন তাঁর জন্যই। যে হাতে রচনা করেছেন পদ্য, গদ্য, আর নাটক। সে হাতই সিদ্ধ ছিলো মনমাতানো গান রচনায়। নানা কারণে আজও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালীর মাঝে প্রাসঙ্গিক। কখনো কখনো আবার কেউ কেউ অভিযোগ হানেন জমিদার ছিলেন কবিগুরু, অত্যাচারও করেছেন। তাই কারও কারও কাছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অত্যাচারীও। আজ কবিগুরুকে ঘিরে এরকম কিছু বাহাসই করবো আইনিউজের এই লেখায়।

কবিগুরু বাঙালি সাহিত্যে যে আসলেই সকলের গুরুপ্রতিম তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাকে অত্যাচারী বলে যে অভিযোগ হানা হয় তা কতোখানি সত্যি? তিনি অত্যাচার করেছেন বটে, মানুষ মাত্রই অত্যাচারী, পাপীষ্ঠ। কিন্তু সে সকলের সাথে অত্যাচার করেনা। কবিগুরু কাদের সাথে অত্যাচার করেছিলেন? আর কেনইবা অত্যাচার করতে বাধ্য হয়েছিলেন এমন মানুষটি?

বলতে হয়, সেই সময়ের কথা যখন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। কোনোদিকেই কোনোকিছু করে আর টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিলোনা বিদ্যালয়টিকে। অর্থসংকটে পড়ে কবি একটা মহা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। বলতে হয় এই প্রথম তিনি অত্যাচার করতে বাধ্য হবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়টিকে বাঁচাতে সেবার কবিগুরু একটি বসতবাটিসহ স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর প্রায় সমস্ত গয়না বেঁচে দিয়েছিলেন। এতে করে তিনি বউয়ের প্রতি অতি আচার করেছেন অর্থাৎ অত্যাচার করেছেন।

কবিগুরু অত্যাচার করেছেন তার নিজের জামাই এবং একমাত্র জীবিত আপন ছেলের সাথেও। কবিগুরু ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কৃষি শিক্ষা নেওয়ার জন্য ১৯০৬ সালে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। প্রায় সোয়াশ বছর আগে অন্যান্য ধর্ণাঢ্য বাঙালির মতো ছেলেকে বিদেশে ব্যারিস্টারি পড়তে না পাঠিয়ে চাষাবাদ শেখাতে পাঠিয়ে তার ছেলেটির সাথে রবীন্দ্রনাথ অত্যাচার করেছিলেন সত্যি। কিন্তু করেছিলেন দেশের সাধারণ কৃষকদের আরেকটু ভালো কৃষি সেবা দেবার লক্ষ্যে। ভেবেছিলেন ছেলে বিদেশ থেকে কৃষি কাজ শিখে এসে এদেশের কৃষকদের মাঝে তা ছড়িয়ে দেবে। এজন্যই ছেলের অমতেও ছেলেকে কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করতে আমেরিকা পাঠান কবিগুরু।

এখানেই শেষ নয়। সমাজের বিধবাবিবাহ প্রথার পক্ষে কবিগুরুর ছিলো জোর অবস্থান। তিনি ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এক বিধবার বিয়ে দিয়ে সমাজকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এগুলো কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। কুসংস্কার নামক মহাব্যধি সমাজের মাথা থেকে নামাতে রবীন্দ্রনাথ সেদিন অত্যাচার করেছিলেন নিজের ছেলের সাথে। ভালো কোনো পরিবার থেকে মেয়ে না এনে এক বিধবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন রথীকে। এটিই ছিলো ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবাবিবাহ।

নিজের পুত্রকে দিয়েই বিধবাবিবাহ বিরোধী পাথরকঠিন প্রথা ভাঙ্গেন রবীন্দ্রনাথ। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর সাথে 'অত্যাচারী শাসক'।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারি এস্টেটের নিরক্ষর, শ্রমজীবী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত, ক্ষুধাক্লিষ্ট ও দুর্যোগগ্রস্থ রায়তদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য খাজনা মওকুফ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানীয় জলের জন্য পুকুর-কূপ খনন, বিদ্যালয়-মাদ্রাসা-ধর্মশালা নির্মাণ ও এসবের সংস্কার করেছিলেন। তিনি নিরলস পরিশ্রমে শিলাইদহে দাতব্য চিকিৎসালয়, পতিসরে হাসপাতাল ও কালীগ্রামে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জমিদারির প্রায় সব টাকাই এই মানুষ পল্লীমঙ্গল ও প্রজাকল্যাণে উদার হস্তে ব্যয় করেছিলেন।

প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশার খোঁজ নিতে সরেজমিনে তাদের সাথে দেখা করতেন এই 'অত্যাচারী শাসক'

মহাজনদের শোষণ থেকে প্রজাদের বাঁচাতে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে পতিসরে কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ২০ বছর (মতান্তরে ২৫ বছর) সক্রিয় থেকে এ ব্যাংক প্রজাদের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নে অনেকটাই সফল হয়। মহাজনদের সমস্ত ঋণ শোধ করে দিয়ে তারা ঋণমুক্ত সুখী জীবনের সন্ধান পায়। ফলশ্রুতিতে কালীগ্রাম থেকে রক্তচোষা মহাজনরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

আজ থেকে শত বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি সহজ শর্তে দরিদ্র কৃষকদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের ঋণখেলাপ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জের শিকার কৃষি ব্যাংকটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে যে দেনাগ্রস্থ হতে হয়েছিল সে দেনা পরিশোধ তত সহজ ছিল না। উপরন্তু Rural Indebtedness আইন প্রণীত হওয়ার কারণে কৃষকদের দেওয়া ঋণ আজ পর্যন্ত অনাদায়ী থেকে গেছে। তো আপনি ভারতবর্ষের এমন কজন জমিদারের কথা জানেন যাঁরা প্রজাকল্যাণ করতে গিয়ে দারুণ ঋণগ্রস্থ হয়েছিলেন?

কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংকের হিসাব খাতা। 'অত্যাচারী শাসক' তাঁর নোবেল বিজয়ের যে লক্ষাধিক টাকা এ ব্যাংকে দিয়েছিলেন, সে হিসেবেও এ খাতায় আছে।

'জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর।' না, এ উক্তি কোনো রাজনীতিক কিম্বা সমাজতন্ত্রীর নয়; এ উক্তি স্বয়ং জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। প্রশ্ন করতে পারেন তবে তিনি জমিদারি আঁকড়ে ধরে ছিলেন কেন? হ্যাঁ, জমিদারির মধ্যে 'মস্ত ফাঁকি' আবিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি ছেড়ে দেবারও চিন্তা ভাবনা করেছেন। কিন্তু ভারার্পণের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পাননি তখনও।

তার উক্তিতেই পড়া যাক, ‘মস্ত একটা ফাঁকির মধ্যে আছি। এমন জমিদারি ছেড়ে দিলেই তো হয়? কিন্তু কাকে ছেড়ে দেবো? অন্য এক জমিদারকে? গোলাম-চোর খেলার গোলাম যাকেই গতিয়ে দিই, তার দ্বারা গোলাম-চোরকে ঠেকানো হয় না। প্রজাকে ছেড়ে দেবো? তখন দেখতে দেখতে এক বড়ো জমিদারের জায়গায় দশ ছোটো জমিদার গজিয়ে উঠবে। রক্ত পিপাসায় বড় জোঁকের চেয়ে ছিনে জোঁকের প্রবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে তা বলতে পারি নে।’ ১৯৩৭ সালে পতিসর ছেড়ে চলে চলে যাওয়ার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব সম্পদ প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন।

যে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি সত্তাকে কঠোরভাবে শাসন করে দুস্থ মানবসেবায় আত্মনিবেদিত থেকেছিলেন, তিনি তো একজন শাসকই বটে। যে জমিদার জমিদারি ভোগ-বিলাসের প্রবৃত্তিকে কঠিন শাসনে বেঁধে রেখে মানবতাবোধের নজিরবিহীন বিকাশ ঘটিয়েছিলেন জীবনব্যাপী, তিনি তো একজন শাসকই বটে।

আগে প্রমাণ হলো রবীন্দ্রনাথ একজন 'অত্যাচারী' এবং পরে এও প্রমাণ হলো তিনি একজন 'শাসক'। এই দুয়ে মিলে তাঁকে তো 'অত্যাচারী শাসক' বলাই যায়। আপনার কী মত জানি না; তবে আমার মনে হয় এরকম 'অত্যাচারী শাসক' যদি যুগে যুগে আবির্ভূত হতেন তবে তাঁরা এই পৃথিবীটাকে এত অশান্তিপূর্ণ হতে দিতেন না কিছুতে।

আইনিউজ/এইচএ

এই বিভাগের আরও লেখা

দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি

সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের দেশ ।। Most beautiful woman in the world ।। Eye News

যে গ্রামে পুরুষ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন নারীরা | Women are pregnant without men | Kenyan Girls | Eye News

চুল বেঁধে ঘুমিয়ে নিজের যে ক্ষতি করছেন ।। Hair loss problems

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়