তাসলিমা মুজাহিদ
আপডেট: ১৫:০৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩
আমার আমিকে খুঁজে নেবো আমার মাঝেই
"আমি কী তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয়" এটাই মৌল কথা- আমিত্বের জন্যই মানুষের মাঝে এতো অপূর্ণতা। এই অপূর্ণতা থেকেই যাবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষার সীমানা আকাশচুম্বী। প্রযুক্তি আমাদের মন মননকে ভালোবাসার মানবিক মূল্যবোধ থেকে কোথায় যেনো ঠেলে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের সাহিত্য- শিল্প পৌঁছাতে হলে তাদের মতো করেই পৌঁছাতে হবে।
সন্ধ্যা তখনো নামেনি। আলোর মাঝে একটু একটু করে আন্ধার নামতে শুরু করেছে, সাথে শীত। কনকনে শীত। যেনো আরেকটু পরেই সন্ধ্যা আর শীত একসাথে চেপে ধরবে মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরির পুরো অঙ্গণ। শীত কেউই গায়ে মাখছেন না। যেনো চোখের পলকেই সৈয়দ মুজতবা আলী মিলনায়তনটি ভরে উঠলো শহর ও শহরের আশপাশ থেকে জড়ো হওয়া নবীন প্রবীনের কোলাহলে। শীতের তীব্রতাকে পেছনে ফেলে, সাহিত্যের ছোট কাগজ 'ফসল'-এর উদ্যোগে আয়োজিত একক প্রবন্ধ পাঠ অনুষ্ঠানের সরব উপস্থিতি মুগ্ধ করেছে প্রাণ। প্রাণের পরে লুকিয়ে থাকা কতো-শতো জিজ্ঞাসার সহজ উত্তরের জন্য সকলেই উন্মুখ। কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক স্বপন নাথের লেখা "আমি কী তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয়" শিরোনামের প্রবন্ধটি ঘিরেই সকলের গোল হয়ে বসা, চোখের পলক না ফেলে বক্তার দিকে তাকিয়ে থাকা।
শুরু হলো প্রবন্ধ পাঠ- পিনপতনের শব্দ নেই। তথ্যবহুল বক্তৃতায় মন মনন সমৃদ্ধ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বক্তব্যের শুরুতেই বক্তা বলে নিলেন- ভেতরের পোষণ করা ধারণার পরিবর্তন হলে আমাকে ক্ষমা করবেন। প্রবন্ধের অন্দরমহলে প্রবেশ- লালন সাঁইয়ের গানের কথাকে শিরোনাম করে বক্তা তাঁর বক্তব্যকে প্রসারিত করেছেন এ সময়ের আধুনিক জীবনের আমিত্ব পর্যন্ত।
প্রস্তর যুগ থেকে আজকের এই বিশ্বগ্রামের নেটওয়ার্কিং পর্যন্ত আলোচনায় হারারে, কার্ল মার্কস, স্মিথসহ আরও অনেকের মতকে বিশ্লেষণ করে আমিত্বের অসহায়ত্ব রূপের ছবি প্রকাশ। মানুষ ডিভাইস ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক কিন্তু নিজের মন, মনন ও চিন্তাকে রেখেছে মধ্যযুগে। কোনো চিন্তাই যেনো আমরা আজকাল করতেই পারিনা। মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন যেনো আজ শুধুই স্ক্রিনের দিকে তাকাতে তাকাতেই ডুবে যায় অন্ধকারে।
আমাদের ঘুম থেকে জাগা থেকে ঘুম আসা পর্যন্ত ডিভাইস নির্ভরতা আমাদের নিজস্ব চিন্তা চেতনার বিকাশ ক্রমেই ধ্বংস করছে। এ প্রসঙ্গে বক্তা বললেন- সুইডেনের বাচ্চারা প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় মিছিল করেছিল যে, তাদের মা বাবা তাদের সময় দেয়না; সময় বেশি দেয় ডিভাইস। যা আমাদেরকে আধুনিক জীবনের স্বাদ দিয়েছে কিন্তু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আমাদের সৃজনশীলতা ও মানবিক বিকাশের সুবর্ণ সময়। মানুষের জীবন যাপনে প্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণ আমাদের জীবনকে সহজ করেছে তবে আমরা যেনো একটু বেশি রকমেই এর প্রতি ঝোঁকছি। যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে জটিলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছি নানান জটিল রোগে। তরুণ প্রজন্মের সামাজিকতা বোধ ও দায়িত্ববোধ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বক্তা বললেন- এসবের জন্য দায়ী মা-বাবা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন আরও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করবে তখন আমাদের চারপাশের অবস্থার রূপ কেমন হতে পারে, আমাদের প্রজন্ম কি আমিত্বের খোঁজ পাবে? কারণ, এমন কিছু ডিভাইস আসছে যা সবার ব্যক্তিগত জীবনের আলাপচারিতার খবরও বলতে পারবে। তাহলে আমিটা কই থাকবে তখন? এভাবেই কথার পর কথার গাঁথুনিতে আর তথ্যের নানা জটিল উপস্থাপনায় উপস্থিত সকলেই হই চমকিত ও শিহরিত।
প্রযুক্তি আজ গোটা পৃথিবীকে বিশ্বপল্লীতে রূপান্তর করেছে ঠিকই তবে তা মানুষের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। সাহিত্য, শিল্প ও আমাদের আজকের পথচলায় আমরা যেনো কোথায় গিয়ে আটকে যাই। আমাদের পৃথিবী আজ আরাম আয়েসের বিলাসবহুল স্থান কিন্তু কেউ যেনো কাউকে দেখার বা কারো কথা ভাববার সময়ই পাইনা। আমাদের সঞ্চিত সময় হাওয়ায় ভেসে যায়। মানব সভ্যতা এভাবেই ঠিকই তবে মানুষ কি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে? প্রাসাদ আর প্রযুক্তি আমাদের বাড়ছে কিন্তু একই সাথে মুক্তচিন্তার জায়গাটা কি বৃদ্ধি পাচ্ছে?
"আমি কী তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয়" এটাই মৌল কথা- আমিত্বের জন্যই মানুষের মাঝে এতো অপূর্ণতা। এই অপূর্ণতা থেকেই যাবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষার সীমানা আকাশচুম্বী। প্রযুক্তি আমাদের মন মননকে ভালোবাসার মানবিক মূল্যবোধ থেকে কোথায় যেনো ঠেলে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের সাহিত্য- শিল্প পৌঁছাতে হলে তাদের মতো করেই পৌঁছাতে হবে।
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সত্যিকার মানুষ হতে হবে। মানবিক হতে হলে মানব জন্মের সার্থকতা উপলব্ধি করে অন্তরকে প্রসিদ্ধ করতে হবে। প্রযুক্তির যে বিপ্লব ঘটছে, তাতে মানুষের শ্রমের মাধ্যম পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানে সমৃদ্ধ না হলে যুগের কাছে আমরা মূল্যহীন হয়ে যেতে পারি। তবে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটা অধিক জরুরী। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে যুগের পর যুগের বদল ঘটবে তবে মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। বিশ্বায়নের এ সময়ে সকল বদলের মাঝেও যেনো আপন বলয় আর প্রেমময় জীবন টিকে থাকে তারজন্যই সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমাদের শিশুদের যেমন পরিবেশ দিবো তারা তেমন আচরণই করবে। তাই উন্নতির পাশাপাশি মননশীল প্রজন্ম গঠনে মনোযোগী হতে হবে।
লালন সাঁই তাঁর গানে মানুষের কথা বলেছেন- মানুষের গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর প্রায় সব গানেই। মানুষের এই গুরুত্ব যেনো না হারায় সে বিষয়েই কথা বললেন বক্তা। প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল খালিক ছিলেন সভাপ্রধান। প্রাবন্ধিক আহমদ সিরাজ ও কবি ঔপন্যাসিক আকমল হোসেন নিপুর সঞ্চালনায় আলোচনাটি সমৃদ্ধ করেছে উপস্থিত সকলকে। তথ্যবহুল এই প্রবন্ধপাঠ অনুষ্ঠানে তরুণদের যুক্ত করতে পারলে এর ফল আরো সুমিষ্ট হতো নিঃসন্দেহে। আশা রাখি, নান্দনিক এই শহরে এমন আয়োজন হোক বারবার, আলোর মাঝে আমিত্বকে খোঁজে নিই বারবার। শতবার।
লেখক- তাসলিমা মুজাহিদ, কবি ও কলেজ শিক্ষক।
এই বিভাগের আরও লেখা:
- বঙ্গদেশীয় নারীবাদ: কিংবা কিছু কথা
- ভাটির কবি আব্দুল করিম এবং কিছু কথা
- দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: ইতিহাসে ভিন্নরকম এক সঙ্গীতায়োজন
- এ পি জে আব্দুল কালাম: ‘দ্য মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দুবাইয়ে লটারি জিতে একরাতে কোটিপতি বাংলাদেশী যুবক | দুবাই প্রবাসী
মানুষ হত্যা করেছে মা হাতিকে, দুধের জন্য কাঁদছে বাচ্চা হাতিটি
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা