শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১৬:৫১, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
ফুলগুলো আর ফুল নেই | ছোটগল্প
ফুলগুলো আর ফুল নেই। ছবি- হেলাল আহমেদ
°
আমাদের আটপৌরে ঘরে ঘটনার শুরু হয় একটি দুর্ঘটনার পরে। বেলালের মৃ*ত্যুর পর আম্মা আমাদেরকে রাতে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে ঘুমোতে দেন না। আমরা চার ভাই ছিলাম। বেলাল মারা যাওয়ার পর হলাম তিন ভাই। একেবারে ছোটোটি আম্মাদের সাথেই ঘুমায়। আমি আর দেলোয়ার ঘুমাই আলাদা আলদা ঘরে। দেলোয়ার বেলালের ছোট, আমিই সবার বড়। কিন্তু তাতে কি? বেলাল চলে যাওয়ার পর আম্মার কাছে আমরা বাকি তিন ভাই আরও ছোট হয়ে গেলাম। সদ্যপ্রসবজাত শাবককে মৃগ যেমন চোখে চোখে রাখে, আম্মাও সারাদিন আমাদেরকে তেমনি চোখে চোখে রাখতে শুরু করলেন। প্রথম এক মাস তো আমাকে অফিসেই আসতে দিলেন না। আমরা তিন ভাই সারাদিন আম্মার চোখের সামনে থাকি।
আব্বাও বসে থাকেন বাড়িতে। ক্ষেতে যান না, যাবেনই বা কীভাবে ক্ষেতের লাগানো ধানগুলোও বেলাল নিজহাতে লাগিয়ে গেছে। সেই ধান গোলায় তোলার আগেই বেলাল চলে গেলো! ক্ষেতে গেলেই আব্বার বেলালের কথা মনে পড়ে; তাই ক্ষেতে যাওয়া কমে যায় আব্বার। সারাদিন নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকেন আর মাঝেমাঝে ব্যাধিগ্রস্ত বুক থেকে পাহাড় সমান দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আমি পাশের ঘর থেকে এসব দেখি, শুনি কিন্তু কিছু করতে পারি না। আসলে ছেলের লাশ বহনকারী বাবাকে বোধয় প্রত্যক্ষ বিষয় দিয়ে শান্তনা দেয়া যায় না!
বেলাল ছিলো আমাদের সবার চেখের মণি, আমাদের একমাত্র অভিভাবক বলা যায়। মাত্র মাধ্যমিকের পরেই পড়াশোনা বাদ দিয়ে আব্বার সাথে পরিবারের হাল ধরে নেয় বেলাল! আমি তখন ঘোর বোহেমিয়ান। ঘরের সাথে ওরকম কোনো সম্পর্ক নেই। ঘরের একজন হয়েও আগুন্তকের মতো দূরে থেকে থেকে দেখেছি আমাদের টালমাটাল ঘরটাকে বেলাল কী করে থিতু করে দিলো!
°°
মারা যাওয়ার তিন-চারদিন আগে বেলাল আমার কাছে তিনশো টাকা চেয়েছিলো। আমার কাছে তাৎক্ষণিক টাকা ছিলোনা। আমার সাথে প্রায়শই টাকা থাকেনা। বৈষয়িকভাবে কম চাহিদার মানুষ বলতে পারেন। যেটুকু যখন দরকার হয় সংগ্রহ করে নিই। তাই বেলালকে টাকা দিতে পারলাম না।
পরেরদিন অফিসে বলে পাঁচশো টাকা নিয়ে বেলালকে দিলাম। ও নিলোনা! বললো লাগবে না। আমি বললাম, গতকালই বললি টাকার দরকার। বেলাল আমাকে হতবাক করে দিয়ে বললো, আমি আসলে তোর সাথে মজা করেছিলাম (ছোট হলেও ও আমাকে তুই করেই ডাকতো) দেখলাম তুই আমায় টাকা দিস কিনা....
আমি তাজ্জব বনে গেলাম। বেলাল এরকম কখনো করেনা! আজ করলো, কেন করলো? বুঝিনি তখন। যদি বুঝতাম, তাহলে হয়তো এজন্য আজকে এতো খারাপ লাগতো না, নিজেকে ধিক্কার দিতাম না। এখন আমার শুধু মনে হয় বেলালের হয়তো সেদিন সত্যিই টাকার দরকার ছিলো। পরে আর নেয়নি। কিন্তু এর একদিন পরেই ও মরে গেলো! আমার কাছে কিছু চেয়েছিলো কিন্তু আমি তা দিতে পারিনি। আর এই না পাওয়া নিয়েই ও চলে গেলো। নিজেকে হতভাগা ছাড়া কিচ্ছু ভাবিনা এরপর।
এই ঘটনার পর থেকে আমি সাথে টাকা ঘুরি না। টাকা পকেটে থাকলে আমার বুকে ব্যথা করে। সেই ব্যথা কাওকে দেখাতে পারিনা। চাপা ব্যথা আরও চেপে দিয়ে আমি শূন্যপকেটেই এখন ঘুরাই।
°°°
আমার ভাত খাওয়ার একটা অভ্যাস আছে। আমি দিনে দুইবেলা খাই। সকালে আর রাতে। দুই বেলাই ভাত খাই। কিন্তু আয়োজন করে খাই না। আমার ঝামেলা মনে হয়। কিন্তু বেলাল মারা যাওয়ার পর থেকে আয়োজন করে খেতে হয়। যেভাবে আম্মা বেলালকে নিজের কাছে বসিয়ে খাওয়াতেন ঠিক সেভাবে।
বেলাল আম্মাকে সঙ্গে না নিয়ে খেতো না। বাড়ির বাইরে গেলে আম্মাকে কদমবুসি করে যেতো। বাইরে থেকে বাড়ি আসলেও তাই করতো। আম্মার পা ব্যাথা করলে আম্মার পা টিপে দিতো। বেলাল যখন খেতে বসতো আম্মা নিজ হাতে বেলালের পাত সাজিয়ে দিতেন। এখন আমাকেও এভাবে সাজিয়ে দেন। আমি সাজানো ভাতের পাত নিয়ে বসে থাকি; কিন্তু মুখের নলা দিয়ে ভাত নামেনা। আটকে যায়। দুঃখ লাগে বেলালের জন্য। আমার চোখ ভরে কান্নাও আসে। কিন্তু পাতা বেয়ে জল গড়ায় না। কারণ, বেলাল এখনো আমার চোখের পাতায় হেঁটে বেড়ায়......
°°°°
আমাদের বাড়িতে গোসলখানাটা পেছনের ঘাটপাড়ে। খোলা আকাশের নিচে চারদিক পাকা দেয়ালে ঢাকা গোসলখানার আশপাশজুড়ে বেলাল অনেকগুলো ফুলের গাছ লাগিয়েছিলো। শিউলি, গাধা, অপরাজিতা আর একটা নাম না জানা ফুলের গাছ। এখন বসন্তকাল। গাছগুলোর কয়েকটিতে ভরে ফুল ফোটেছে। দেখতে বেশ সুন্দর, আম্মা বলেন অনেকটা বেলালের হাসির মতো!
আম্মা রোজ সকালে এখন ফুলের গাছে পানি দেন। আর কাওকে পানি দিতে দেন না। ওদিকে যেতেও দেন না। যদি কেউ ফুল গাছগুলো ভেঙে ফেলে! আম্মার ভয় হয়। আম্মা ফুলগাছগুলোকে তাই আগলে রাখেন। যেমনটা রাখতেন বেলালকে।
ফুলগুলো যখন এলোমেলো হাওয়ায় দোলে ওঠে, এদিক ওদিক হেলে পড়ে আম্মা হাসেন একা এক দাওয়ায় বসে। বুঝিবা বেলালকে দেখছেন, বেলাল হাসছে। আমাদের বাড়ির ফুলগাছগুলো এখন আর ফুলগাছ নেই, ফুলগুলো আর ফুল নেই; ওরা সবাই বেলাল হয়ে গেছে। আম্মা এখন দাওয়ায় বসে বসে তাই বেলালকে দেখেই দিন কাটান। আর রাত হলে চোখের জলে বুক ভাসান...
ফাল্গুন-৭/১৪২৯বাংলা
লেখক: শ্যামলাল গোসাঁই, কবি এবং সাংবাদিক
লেখকের আরও লেখা:
- বঙ্গদেশীয় নারীবাদ: কিংবা কিছু কথা
- ভাটির কবি আব্দুল করিম এবং কিছু কথা
- মৃৎশিল্পের খোঁজে একদিন... (ভ্রমণ গল্প)
আই নিউজ ভিডিও গ্যালারী
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা