আহমদ সিরাজ
মানুষ সম্পর্কিত বন্দনা
মানুষ অন্যান্য প্রাণীজগত থেকে আলাদা হয়েছে, তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা, জন্ম, মৃত্যু প্রভৃতিতে মিল থাকার পরও মানুষ ভিন্নভাবে থেকেছে। মানুষ প্রতিনিয়ত সৃষ্টিশীল ও বিকাশমান বলেই আজ ও আগামীকালের মানুষ এক নয়। মানুষের মাঝে যে যত সৃষ্টিশীল সে ততো গতিশীল, সৃজনশীল।
মানুষের সৃষ্টিশীলতা, জ্ঞান, বুদ্ধি অংশ হিসাবে ভাষার একটা সৃষ্টিশীল হাতিয়ার হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এই সৃষ্টিশীলতা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, সমষ্টি থেকে সমষ্টি, সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায়, জাতি থেকে জাতি, দেশ থেকে দেশে, মহাদেশ থেকে মহাদেশ অভিন্ন থেকেও ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে।
মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্তহীনতা ও মননশীলতার কারণে মানুষের মাঝে শুভ ও অশুভ চেতনা যেমন তাকে প্রগতিগামী, তেমনি প্রতিক্রিয়াগামীও করেছে, ফলে মানুষ বিশাল সৃষ্টি সম্ভার বহন করে। দ্বন্ধ বিরোধে তাড়িত থেকেছে। মানুষের সৃষ্টিশীলতার বস্তুগত উৎপাদন নির্মাণের ভেতর একটা সংস্কৃতির সুশীল বিস্তার রয়েছে- যার ভেতর দিয়ে বস্তুগত নির্মাণের পাশাপাশি গল্প, কবিতা, উপন্যাস নাটক সহ কত কত কাহিনীও বিচিত্রভাবে নির্মাণ করে থাকে। মানুষ এই প্রকৃতিতে অপরাপর প্রাণীর মতো জীবন্ত হলেও তারা মানুষের সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র গঠনে সীমাবদ্ধ থাকে নি, গ্রহের মানুষ হয়েও গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে পাড়ি জমাতে অভিযান পরিচালনায়, ব্যস্ত থেকেছে।
মানুষ সৃষ্টিশীলতার মাত্রা, কৃতিত্ব বুঝে কিন্তু এই মানুষই তার কৃতিত্বের মাত্রাকে নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ি করে, তেমনি ফুলে ফেপে সে যা নয় তার বহুগুন বাড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। অবশ্য এমন পরিস্থিতি সর্বত্র ঘটে না। দেখা গেছে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ সমাজ ভেদে এসবে পার্থক্য রয়েছে। যে সমস্ত দেশে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সুশীল সমাজ নির্মাণ করে একটা গণতান্ত্রিক মানবিক সুষম সমাজ নির্মাণ করে দেশ পরিচালনায় সক্ষম হয়েছে, সেই সমস্ত দেশের নাগরিকরা একটা জীবনধর্মী সাবলীল সুন্দর প্রস্ফুটিত মানুষের সমাজ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সৃষ্টিশীলতাকে সম্মানের চোখে দেখেছে। পক্ষান্তরে সমস্যা তৈরী হয়েছে, অনিয়ম দুর্নীতিতে টাসা যে সমস্ত দেশের মানুষ আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে, সেসব দেশের মানুষেরা কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা তা চিহ্নিত করার গরজ বোধ করে না। তারা শক্তির দাপটে-জোর যার মুল্লুকতার নীতিতে চলে থাকে।
একটা গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের মানুষ হয়ে ওঠা থেকে দূরে পড়ে থাকে, সেই সমাজে জ্ঞান, বিজ্ঞান চর্চার নামে
একটা বিশাল বঞ্চনা ও বৈষ্যমের থাকে বেশীর ভাগ মানুষ। অতি অল্প জনগোষ্ঠীর লোকেরা নানা কায়দায় স্বদেশ সমাজের কর্তৃত্বে থাকে। এখানে মানুষ বিবেচ্য নয়, কর্তৃত্ব বিবেচ্য থাকে। এই কর্তৃত্ব রক্ষায় এক শ্রেণির বন্দনাগীত প্রচলিত থাকে, যারা চারণ কবির মতো কর্তৃত্বের চারপাশে থাকেন। তাদের কাজ হয়, কর্তৃত্বের বন্দনাগীত গাওয়া প্রচলিত কর্তৃত্বের সকল কু-কর্ম রক্ষা ও ঢাকা দেওয়ার জন্য এর বিশেষণ-বিশেষায়ন যুক্ত করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত রাখা, কর্তৃত্বের এমন অবস্থানটিতে একটা অলৌকিক ছায়া আরোপ করা। মানুষ যাতে বুঝে নিতে পারে যে, কর্তৃত্বের উপর কোন অতিলৌকিক এমন ছায়া পড়াতেই তার দিকে থাকাটা গৃহীত হয়েছে। তাতে মানুষের হাত নেই, হলে কর্তৃত্বের কৃতিত্ব বলেও যে জিনিসটা আছে তাতেও রহস্য ধাঁধা চিহ্নিত করে অদৃশ্য শক্তির মহিমা হিসাবে প্রচার করা হয়, মানুষের সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয় যাতে কর্তৃত্বের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে না পারে। এজন্য কর্তৃত্ববাদী কর্তৃত্বের ঠিকে থাকার জন্য এক শ্রেণির এলিট বিদ্বানের দরকার পড়ে, যাদের বেশীরভাগ এর উৎপাদন ঘটেছে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এর ভিতর থেকে।
মানুষ লাঞ্চনা ও বঞ্চনার মধ্যে বিদ্বানদের এখনও সম্মান করে থাকে। দেশ সমাজের মাথা বিদ্বান- কোন চাষাভুষা নয়। এলিট বিদ্বানের এমন একটা অংশ কর্তৃত্বের অলংকার হয়ে ওঠেন, যাতে কর্তৃত্বের অলংকৃত হওয়া সহজ হয়। এসব বিদ্বানেরা যাতে ছন্দ, অলংকার ও উপমায় এত ভূতপত্তি সম্পন্ন যে, কোন বোমাবাজিতেও কর্তৃত্বকে অক্ষম করে তোলা সহজ হবে না। অধুনা বিশ্বায়ন কেন্দ্রিক এলিট বিদ্বান তারা। তাদের কাজ নিত্যনতুন বন্দনাগীত দেশ জাতির সামনে হাজির করা। কর্তৃত্বের পাশাপাশি আরেকটি বন্দনা গীতা আছে। যা অতীতে এভাবে রাজ্যপাঠ নিয়ে, সম্মুখে আসে নি। এরা ধর্মাশ্রীত নীতি নৈতিকতায় কর্তৃত্ব থেকে দূরেই থেকেছে। এখন বিশ্বায়নের ঢুলে তারাও কর্তৃত্বের দুধ, ননী, সর থেকে দুরে নয়। তাদেরও একটা অংশ কর্তৃত্বের ধর্মাশ্রিত বন্দনায় হিম্মত দিতে পিছপা নন। সাধারণ লোকজন এসব আলোকিত লোকদের কর্তৃত্বের এমন বন্দনায় কেবল স্তম্ভিত নয় বোকাসোকাও।
মাঝেরছড়া ত্রিপুরী পল্লীতে একদিন
এ যেন আধুনিক ও মধ্যযুগীয় বন্দনা শক্তির অভিন্ন মহড়া। এজন্য যে দেশে যত বেশী দুর্নীতি ও লুটপাট থাকে সেই দেশে তোষামোদ ও বন্দনাগীত প্রবল থাকে। এসব তোষামোদ-বন্দনা দুর্নীতির ঢাকনা হিসাবে ধূম্রজাল তৈরী করে কর্তৃত্বের নিরাপদ অবস্থান অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট থাকে। এই বন্দনাগীত দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয়ে উঠলে সাধারণ মানুষের সক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ক্রমশ লোকজন কর্তৃত্বকে অনঢ়ভেবে নিয়তিবাদী হয়ে উঠতে পারে। তার সমস্ত চেষ্টা পরাজয়ের গ্লানিতে যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। প্রবল বন্দনা, যেন সুপার ন্যাচারাল শক্তির মহাত্মে তাড়িত হয়। অধুনা নিয়তিবাদ এর বিকাশ এভাবেও ঘটতে পারে।
বন্দনা-নিয়তি-ভাগ্য সম্পুরক শক্তি হয়ে মনোজগতে অশরীরি হয়ে উঠতে পারে, যা অবশেষে সাধারণ মানুষের জীবনের জন্য হাহাকারে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। বিদ্যমান বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ এমন একটা অবস্থানে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক- আহমদ সিরাজ, লেখক ও লোক গবেষক
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা