শ্যামলাল গোঁসাই
কলাবতীর দুঃখ | ছোটগল্প
প্রচ্ছদ- আই নিউজ
সাদাকালো রঙের গাভীন গরুটাকে আমরা কলাবতী নামে ডাকি। কলাবতীর গায়ের রঙ সুন্দর। সারা গায়ে সাদা-কালোর মিশেল। কপালে একটা তিলকও আছে প্রতিবেশী ভাণ্ডারীর লাল গাইয়ের বাছুরের মতো। আমি রোজ সকালে একবার গোয়াল ঘরের কাছের নাইনে বসে এদেরকে দেখি। এতে আমার সময়ও কাটে, আমার একান্ত কাজটিও করা যায় বিরক্তি ছাড়া। মাঝেমাঝে গোয়ালের মালিক সাহেব আলীও এখানে এসে আমার কাছে বসেন। যৌবনে তিনিও কাঁধে যন্ত্র ঝুলিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন। এখানে-ওখানে রাত কাটিয়েছেন। ফলতঃ এই লাইনে হাঁটা লোকেদের যে নেশাটি সাধারণত পেয়ে থাকে তাকেও সেটা পেয়েছিলো। ওই টানেই মাঝেমাঝে আমার কাছে আসেন। তাছাড়া, বাড়িতে তাকে সঙ্গ দেওয়ার মতো তেমন কেউ নেই-ও। আমার কাছে এসে বসে যৌবনের এটা-ওটা নিয়ে টুকিটাকি আলাপ করেন। কখনো রঙ্গ মিশিয়ে কখনো রঙ্গ ছাড়াই। আমি সেসব শুনি আর গোয়ালের গরুগুলোকে দেখি। আমার তো সময় কাটে। এই ঢের।
সাহেব আলী পরিবারে যে চারটি গরু আছে এদের মাঝে কলাবতী সবার বড়। বাকি তিনজনের একজন ষাঁড় গরু আর দুইজনের একজন যুবতী। যুবতী গাইটাকে এখন ষাঁড় গরুর থেকে দূরে রাখা হয়। তারা পরস্পর কাছে আসতে চাইলেও কাছে আসতে দেওয়া হয় না। অনেকটা আমাদের যুবক-যুবতীর মতো। ...তারা পরস্পর কাছে আসিতে চায়, মিলন ঘটাইতে চায়; কিন্তু তাহাদেরকে জোর করিয়া আটকাইয়া রাখা হয় ধরনের।
আজ আমি আর সাহেব আলী একসাথে প্রাতঃভ্রমণ শেষে গোয়াল ঘরের দাওয়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম- গাইটাতো এখন বেশ বড়। ষাঁড় গরুরে তাইলে কাছে আসতে দেন না কেন?
সাহেব আলী মুচকি হাসি হেসে বললেন- আরে গোসাঁই এই গাই এহনো 'হিটে' আসে নাই। বয়সের ঠ্যালায় ফাল পাড়তাছে। এহনি ষাঁড়েরে এইডার কাছে ঘেঁষতে দিলে সমস্যা। পেট বাজাইলে বাচ্চা দেওনের সুময় গাই মইরা যাইতে পারে।
আমি সমস্যা কী আন্দাজ করতে পারলাম। তাই আর কথা বাড়ালাম না। সাহেব আলীর ছোট নাতীন আয়েশা এর ফাঁকে শবে বরাতের রাতে মসজিদ থেকে আসা হালুয়া আর ঘরে বানানো ছেঁক দেওয়া রুটি দিয়ে গেলো। সাহেব আলী ভোজন রসিক মানুষ। বয়স নব্বইয়ের ঘর পেরিয়েছে। রোগেভুগে কাহিল তার বিশাল বপুখান। কিন্তু খাওয়াখাদ্যের ব্যাপারে এখনো আগের জোশ ধরে রেখেছেন। রুটির পেটে হালুয়া চালান দিতে দিতে তার আলাপের বিষয়ে আসলো কলাবতী গাইটা। জানালেন এই কলাবতী রোজ দুইবারে মোট আট থেকে দশ সের করে দুধ দেয়। শুনে বললাম, বাহ! ভালো পরিমাণ দুধই তো দেয়। কিন্তু সাহেব আলী আমার কথা শুনে খ্যাঁক করে উঠলেন : 'কিয়ের ভালো? এই গাই (কলাবতী) দুধ চুরি করে! এতো কষ্ট করি তার পেছনে আর হে-ই কিনা দুধ চুরি করে।'
গাই দুধ চুরি করে কীভাবে আমার ঘটে ধরলো না। আর নিজের দুধ গাই নিজে চুরি করে করবেটা কী?
উত্তর পেলাম সাহেব আলীর মুখেই। সেই উত্তর শুনে খানিকটা খারাপও লাগলো গাইটার জন্য। কলাবতীকে নিজগৃহে পরবাসীর ন্যায় মনে হলো। আসলে হয়েছে কী, এ গাইয়ের দুধ সাহেব আলীর মেঝো ছেলে ছাদিক আলী বাজারে নিয়ে গিয়ে বড় কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। সেখান থেকে মাসে মাসে ভালো পয়সাও রোজগার করেন তারা। কিন্তু কোম্পানি এই পরিমাণ দুধে (আট থেকে দশ লিটার) তুষ্ট নয়। তারা এই পরিমাণের অধিক দুধ চায়। তাই আগে গাইয়ের বাচ্চার জন্য যে দুধটুকু বাটে রাখা হতো ছাদিক আলী সেটুকুও বাবু গোয়ালার হাত দিয়ে শুষে নিয়ে যান কোম্পানির জন্য। ফলে দুধ দোহানোর পরে গাইয়ের বাচ্চার খাওয়ার জন্য দুধ থাকে না বললেই চলে....
এদিকে সাহেব আলী পরিবার যে কোম্পানির কাছে গাইয়ের সবটুকু দুধ বিক্রি করে দিচ্ছেন এটি গাইটিও বুঝে ফেলেছে কোনোভাবে। তাই সে এরপর থেকে যখনি কোম্পানির বাবু গোয়ালা দুধ দোহাতে আসে তখন বাটের গোপম থলিতে কিছু দুধ চুরি করে রেখে দেয় বাচ্চার জন্য। গোয়ালা দুধ দোহানো শেষে চলে গেলে গাইটি এই চুরি করা দুধ বাচ্চাটির মুখে তোলে দেয়।
কলাবতীর দুধ চুরির পুরো ঘটনা বললেন সাহেব আলী। সবিশেষ বললেন- এই কারণে এই গাই চোরা গাই। এই গাই দুধ চুরির স্বভাব আছে।
আমার হালুয়া-রুটি খাওয়া শেষ। হাত মুছতে মুছতে বললাম- চুরিটাতো কলাবতী করছে না আলী সাহেব। চুরিটা তো আপনারা করছেন। সাথে অপরাধও করছেন। গাইয়ের দুধ গাই যদি তার বাচ্চাকেই খাওয়াতে না পারে, অন্য লোক সেটা কোম্পানিকে দিয়ে দেয় তাহলে চুরিটা কে করলো? গাই এতোকিছুর পরেও যে প্রতিদিন সেরকে সের দুধ দিয়ে যাচ্ছে এটাই তো অনেক.....
উনি বললেন : 'সকাল-বিকাল ঘাস কাইট্যা খাওয়াই, খৈল-ভূষি, চিটাগুড়, লবণ খাওয়াই, মাস শেষ হইলে ফিডের বিল আসে হাজার টেকা। গাই দুধ চুরি করবার জন্য?'
দেখলাম সাহেব আলী রেগে যাচ্ছেন। তার পরিবারের লোকেরা এই গাইর পেছনে এতো কষ্ট করবে আর গাই তার আপন দুধ চুরি করে বাচ্চাকে খাওয়াবে এটা তিনি মেনে নিতে পারবেন না।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওঠে পড়লাম। কিন্তু মনের ভেতরে কলাবতী আর ওর বাচ্চার জন্য খারাপ লাগাটা রয়ে গেলো। ভাবলাম কলাবতীরও কি দোষ নেই? কী প্রয়োজন ছিলো বন্যজীবন ছেড়ে মানুষের সাথে সহাবস্থানের অলিখিত চুক্তি মেনে নেওয়ার? বন্য জীবনই তো ভালো ছিলো। অন্তত নিজের বাটের দুধ নিজের বাচ্চাকে চুরি করে খাওয়াতে হতো না, খাওয়ানোর জন্য কারো ধিক্কার শুনতে হতো না।
কলাবতীর জন্য আরও খারাপ লাগলো এটা ভেবে যে, কলাবতী হয়তো জানবে না, মানুষ তাদেরকে বাজার থেকে কিনে এনে খৈল, ভূষি, ফিড খাইয়ে নাদুসনুদুস বানায় তার আপন স্বার্থ হাসিলের জন্যই। মানুষ এর বিনিময়ে মাংস চায়, দুধ চায়, টাকা চায়। কিন্তু কলাবতী যে এতোদিন ধরে দুধ দিয়ে যাচ্ছে সের সের; এর বিনিময়ে কখনো কিছু চেয়েছে কি? না চাইলে চাইলো না কেন? না চাওয়াটাও কি অপরাধ নয়? কখনো কখনো নায্য বিনিময় না চাওয়াটাও অপরাধ মনে হলো কলাবতীকে দেখে।
২৪ ফাল্গুন ১৪২৯ বাংলা
লেখকের আরও লেখা :
-
ফুলগুলো আর ফুল নেই | ছোটগল্প
-
ভাটির কবি আব্দুল করিম এবং কিছু কথা
-
মৃৎশিল্পের খোঁজে একদিন... (ভ্রমণ গল্প)
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা