সাহিত্য ডেস্ক
রফিক আজাদের পাঁচটি কবিতা | আই নিউজ
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এবং শক্তিমান একজন কবি রফিক আজাদ। তাঁর রচিত 'ভাত দে হারামজাদা' কবিতাটি এতোটাই জনপ্রিয় হয় যে, এ পটভূমিতে পরবর্তীতে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়। কবি রফিক আজাদ রাজনৈতিক কবিতায় যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুদ্রবাক্য দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তেমনি প্রেমের কবিতাগুলোতে নিংড়ে দিয়েছেন নিজের কোমল হৃদয়। যা অনুভব করা যায় তাঁর বিভিন্ন কাব্যের পঙক্তিতে।
আই নিউজের পাঠকদের জন্য আজ থাকছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় এ কবির বিভিন্ন সময় রচিত জনপ্রিয় পাঁচটি কবিতা :
ভাতদে হারামজাদা
ভীষণ ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে- প্রতিপলে- সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি- যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে- জ্বেলে দ্যায়
প্রভুত দাহন- তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবী
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়ঃ
বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে
আমার সামান্য দাবী পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই- এই চাওয়া সরাসরি- ঠান্ডা বা গরম
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই- মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবী;
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা
চাইনিতোঃ নাভি নিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক- যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও
জেনে রাখোঃ আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন-
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমেঃ
থাকবে না কিছু বাকি- চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে ধরো পেয়ে যাই-
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে।
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা, নদী-নালা
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা,
তা না হলে মানচিত্র খাবো:
প্রতীক্ষা
এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো…
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো
একসঙ্গে বেরুবো।”
এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো
ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।”
হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো;
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি।
যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র
ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো,
“জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে
দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি,
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতেও পারিস,
তৈরী থাকিস- আমি আসবো”
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি;
আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর জন্যেও
অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে
অপেক্ষায় থেকেছি-
কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
-প্রতীক্ষা করবো।
‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ-দু’টির তেমন কোনো
আলাদা মানে নেই-
কিন্তু আমরা দু’জন জানি
ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ—
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,
অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ?
আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো-
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে
আমার পায়ে শিকড় গজাবে…
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না…
তোমার দু’চোখ শুধু জেগে থাকে
তোমার দু’চোখ শুধু জেগে থাকে, অন্য কিছু নয়—
নিভে গেছে সকল প্রদীপ, সভ্যতার সূর্যাস্তের
পর চারদিক বড়বেশি শুনশান—উড়ে গেছে
‘মূল্যবোধ’-নাম্নী সংরক্ষিত গ্রন্থের সকল পাতা—
পৃথিবীর মূল্যবান গ্রন্থগুলি সফেদ কাগজ
ছাড়া আর কিছু নয়—বন্ধুত্বের সর্বশেষ রজ্জু
ছিন্নভিন্ন, বিশ্বস্ত ব্যাংকের ভল্ট থেকে সঙ্গোপনে
উধাও হয়েছে শেষ সোনাদানা, কংক্রিটের শক্ত
বাড়িগুলি লন্ডভন্ড, মুখ থুবড়ে প’ড়ে আছে সব
পথের ওপরে—সবকিছু বিনষ্ট, বিধ্বস্ত, দগ্ধ…
চতুর্দিকে আহাজারি—ধ্বংসযজ্ঞ ঘ’টে গেছে ক্ষুদ্র
এই গ্রহটিতে অকস্মাৎ—আমারও অস্তিত্ব ঘিরে
চারপাশে ঝ’রে যায় হলুদ পত্রালি—সবুজের
সমারোহ নেই—সশব্দে উপড়ে যাচ্ছে গাছপালা
ঘূর্ণিঝড়ে, প্রচণ্ড তাণ্ডবে ছিন্নভিন্ন লতাগুল্ম,
পশু ও শিশুর কান্না একাকার হ’য়ে বাজে কানে,
অনিবার্য অগ্নিকাণ্ড ঘ’টে যাচ্ছে লোকালয়জুড়ে,
সবগুলি গ্রাম আর গৃহস্থের বিন্যস্ত আকাশ,
সব—সবকিছু—লেলিহান শিখার সম্মুখে নত—
ক্ষেত-খামারের থেকে শুরু ক’রে সমুদ্র অবধি
মানুষের দগ্ধ হাতে প’ড়ে দূষিত হয়েছে খুব,
সিংহাসন থেকে শুরু ক’রে তার রান্নাঘর-অব্দি
মানুষ নিজের হাতে, খেলাচ্ছলে, পুড়িয়ে দিয়েছে!
অনিবার্য অগ্নিকাণ্ড ঘ’টে যায় লোকালয়জুড়ে,
অন্য কিছু নয়—জেগে থাকে শুধু তোমার দুচোখ
আরও পড়ুন : কলাবতীর দুঃখ | ছোটগল্প
নগর ধ্বংসের আগে
নগর বিধ্বস্ত হ’লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়ি
উলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে।
‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি –
তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে।
সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে-কাছে নেই :
চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি।
রক্ত-পুঁজে মাখামাখি আমাদের ভালবাসাবাসি;
এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাঙ্খার খেই।
যেখানে রয়েছো স্থির – মূল্যবান আসবাব, বাড়ি;
কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না।
শব্দহীন চ’লে যাবে জীবনের দরকারী গাড়ি –
কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না।
প্রোথিত বৃক্ষের মতো বদ্ধমূল আমার প্রতিভা –
সাধ ছিল বেঁচে থেকে দেখে যাবো জিরাফের গ্রীবা।।
নত হও, কুর্নিশ করো
হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো,
তোমার উদ্ধত আচরনে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দু:খ
পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ,
অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে
ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার,
বলো: মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ,
এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন…
বলো হে কলম, হে বলপেন, হে আমার বর্বর প্রকাশ-ভঙিমা-
এই নাকে খত দিচ্ছি আর কখনো গালমন্দ পারবো না,
আপনাদের ভন্ডামিকে শ্রদ্ধা করতে শিখবো,
আপনাদের অপমান হজম করার অপরিসীম ক্ষমতাকে সম্মান করবো,
আর কোনদিন এমনটি হবে না, হে মহামান্য মধ্যবিত্ত রুচিবোধ,
আপনাদের মতো সব অপমান হ’জম করে, এখন থেকে,
নাইট সয়েল বানিয়ে ফেলে দেবো শরীরের বাইরে-
হে বন্য লেখনী, হে অমোচনীয় কালি, হে ইতর বলপেন,
নত হও, নত হতে শেখ..
শান্ত হও, ভদ্র হও ভদ্রলোকের মতো
আড়াল করতে শেখো অপ্রিয় সত্যকে,
প্রিয় মিথ্যা বলা শিখে নাও, বিক্রি করে দাও তোমার বিবেক-
উচ্চারন কোরো না এমন শব্দ, যা শুনে আহত হবেন তাঁরা-
নত হও, নত হ’তে শেখ;
তোমার পেছনে রয়েছে যে পবিত্র বর্বর মন ও মস্তিস্ক
তাকে অনুগত দাসে পরিণত হ’তে বলো,
হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো,
ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্্বারে ধর্না দিও-
শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি…
হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও,
শিখে নাও শিক্ষিত শিম্পানজিদের আচরন-বিধি,
অতএব, নত হও, নত হ’তে শেখো, নতজানু হও।
আই নিউজ/এইচএ
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা