হেলাল আহমেদ
আপডেট: ১৫:৩৮, ২৫ মে ২০২৩
নজরুলের বুলবুল অথবা বুলবুল ই নজরুল
কবি জসিম উদ্দিনের ভাষায়- একদিন আমি ডিএন লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখি লাইব্রেরীর এক কোণায় বসে আছেন আমাদের কবি নজরুল। সেখানে বসে একমনে বুলবুলের স্মৃতিতে হাস্যরসের সব ছড়া লিখছিলেন তিনি। কিন্তু চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরছিলো তাঁর। চোখ দুটো কাঁদতে কাঁদতে লাল করে ফেলেছিলেন।
আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪ তম জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে দুই বাংলায়। সঙ্গীত, সাহিত্য, সুর, বিদ্রোহ সহ নানা আঙ্গিকে নিজের জীবনকে ছন্দময় করে তুলেছিলেন বাংলার জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। যেমন বৃহৎ নজরুল রচিত সাহিত্য ভাণ্ডার, সঙ্গীতের সুধারা কিংবা সুরের মুন্সিয়ানা ঠিক ততোটাই বিস্তৃত আর সুগভীর ছিল জাতীয় এই কবির জীবন। জীবনের চরম চড়াই, উৎরাই, উত্তেজনা কিংবা নিভে যাওয়া সবই যেন নজরুলকে করে তুলেছিলো আরও রহস্যময় কিংবা আকর্ষণীয় এবং সৃজনশীলও। ফলতঃ আজ তাঁর মৃত্যুর এতোদিন পরেও নজরুলকে ঘিরে একটুও কমেনি পাঠক আর সাহিত্যিক আগ্রহ।
নজরুল ইসলামের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যেতে পারে তাঁর ছেলে বুলবুলকে। প্রাণাধিক প্রিয় বুলবুলকে কবি পছন্দ করতেন সবার থেকে বেশি। বুলবুলও যেন জন্মের পর থেকে মাত করে রেখেছিলো কবি নজরুলের আঙিনা। কিন্তু সেই প্রাণের বুলবুলের মৃত্যুর পর চেনা নজরুল হয়ে গিয়েছিলেন অচেনা। দারুণ প্রাণচঞ্চল, বিনোদনপ্রিয় হাস্যোজ্জল একজন মানুষ হয়ে গেলেন স্তব্ধ। যেন বুলবুলের মৃত্যুতে কালের সঙ্গে সর্বকালের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছিলেন নজরুল ইসলাম। হয়ে ওঠেছিলেন নিগুঢ় আধ্যাত্মিক একজন মানুষ।
মৃত্যুর আগে পারিবারিক ছবিতে নজরুল ইসলাম ও মায়ের সঙ্গে কবিপুত্র বুলবুল ও তাঁর ভাই।
জানা যায়, কবির তিনপূত্রের মধ্যে বুলবুলকেই কবি সবচেয়ে বেশি আদর করতেন। বুলবুলের জন্ম হয় কবি কলকাতার কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন সময়ে। এই কৃষ্ণনগরের বাড়িতে বসেই কবি সৃষ্টি করেছেন অমর সব সঙ্গীত। ১৯২৭ সালের ১৩ মার্চ কৃষ্ণনগরের বাড়িতে ছেলে বুলবুলের অন্নপ্রাশন করেন কবি। কিন্তু এর কিছুদিন পর কৃষ্ণনগরের বাড়ি ছাড়তে হয় তাদেরকে।
সবশেষে বুলবুলের যখন মৃত্যু হয় তখন কবি পরিবার নিয়ে এন্টালির ৮/১ পালবাগান লেনের একটি বাড়িতে ওঠেছিলেন। যেখানে নিভে গিয়েছিল বুলবুলের জীবন প্রদীপ; আবার এখানেই জন্ম হয়েছিল কবির তৃতীয় পূত্র কাজী সব্যসাচীর।
বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে বুলবুলের মৃত্যু হয় ১৯৩০ সালের ৭ মে। ভীষণ কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিলো ছোট্ট বুলবুল। চোখেও বসন্ত হয়েছিলো। চোখ মেলে তাকাতে পারতো না ছোট্ট বুলবুল। শরীরের ব্যথায় সহ্য করতে না পেরে কবির কানের কাছেই আর্তের মতো শব্দ করে যেন। যাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন তাঁকে এমন মৃত্যুশয্যায় দেখে বারবার আকুল হয়ে উঠতেন নজরুল। যখন বুলবুলের ব্যাথায় জর্জরিত নজরুল ইসলাম তখনো দুঃখ ভুলতে নজরুল একের পর রচনা করে চলেছেন হাস্যরসাত্মক সব সাহিত্য। চন্দ্রবিন্দু-র মতো মহাকাব্য নজরুল ইসলাম রচনা করেছেন স্বীয় পূত্রের মৃত্যুশয্যায় বসে তা আজ মেনে নিতে পাঠকেরও হয়তো মন আন্দোলিত হবে।
কিন্তু তিনি যে নজরুল; শক্ত হৃদয়ের এক বিদ্রোহী। শৈশব থেকে যিনি লড়াই করেছেন এবং নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সাহিত্যের উঁচু সিংহাসনে। তাই হয়তো বেদনার কণ্টক মাল্য বারবার পরতে হয়েছে কবিকে। বুলবুল বেঁচে থাকলে অন্ধ হয়ে যেতো জেনেও কবি চাইতেন বুলবুল যেকোনো মূল্যে বেঁচে থাকুক। নজরুল ইসলামের স্বপ্ন ছিলো বুলবুল বড় হয়ে ভালো কোনো গায়ক বা বাজিয়ে হবে। বুলবুল বাবার সাথে থেকে থেকে সেসব সেভাবেই রপ্ত করেছিলো। শুধু কী নজরুল, কবিপূত্র বুলবুল প্রভাব রেখেছেন কবির বন্ধুবান্ধবদের উপরও। সকলেই বুলবুলকে আদরও করতেন; কাছেকাছে রাখতেন। বুলবুল যখন মৃত্যুশয্যায় পিতাকে ছাড়েনি একটু সময়ের জন্যও। নজরুলও ছেলের মাথার পাশে বসে থাকতেন জগতের সকলের হতাশা নিয়ে। আশা রাখতেন কোনো এক জাদুবলে সুস্থ হয়ে যাবে বুলবুল।
একবার কবি জানতে পারলেন একজন সাধু আছেন যিনি এর আগে বসন্ত রোগীকে সুস্থ করে তুলেছেন। কবি তাঁর দুই বিশ্বস্ত বন্ধুকে পাঠালেন সেই সাধুকে নিয়ে আসতে। যদি বুলবুল ভালো হয় তাঁর হাতের পরশে। এই এক বিশ্বাসে নজরুল পাঠালেন তাদেরকে। তারা যেদিন ফিরে আসলেন সাধুকে নিয়ে ততোক্ষণে জগতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো বুলবুলের; পৃথিবীর সবথেকে বড় পাথর এসে সেদিন বুকে চেপে বসেছিলো কবির। কবির দুই বন্ধু যখন সাধুকে নিয়ে গৃহপ্রাঙ্গণে মাত্র প্রবেশ করেছেন; তখন নজরুল ঢুকরে কেঁদে ওঠে তাদেরকে বললেন- ওরে মঈনউদ্দি, তোমাদের সাধু কী মরা মানুষ জীবিত করতে পারে? পরে জানা যায় সাধুকে নিয়ে ফেরার মাত্র দশ মিনিট পূর্বে মৃত্যু হয় কবির প্রাণপ্রিয় পুত্র বুলবুলের।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
বুলবুল যখন বসন্তের থাবায় চিরতরে চলে গেল চিরতরে ভেঙে পড়লেন বিদ্রোহী কবি। যেন সহ্যসীমা অতিক্রম করেছিলো বুলবুলের মৃত্যুর ঘটনা। এরপর থেকে একেবারে বদলে গেলেন সকলের বিদ্রোহী কবি, দ্রোহ আর প্রতিবাদের কবি তখন মৌন হয়ে গেলেন স্বীয় দুখের সঙ্গে সন্ধি করে। কারো সাথে কথা বলেন না, সারাক্ষণ বুলবুলের ঘোরে বসে থাকেন। বুলবুলের প্রভাব এসময় নজরুল সাহিত্যেও ব্যাপকভাবে পড়তে থাকে। যেন নজরুল বুলবুলকে হারিয়ে হতবিহ্ববল হয়ে পড়েছিলেন। আসলেও, তাই হয়েছিলেন কবি। কখনো বুলবুলকে হারানোর বেদনা ভুলে থাকতে লিখেছেন হাস্যরসাত্মক কবিতা, ছড়া।
কবি জসিম উদ্দিনের ভাষায়- একদিন আমি ডিএন লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখি লাইব্রেরীর এক কোণায় বসে আছেন আমাদের কবি নজরুল। সেখানে বসে একমনে বুলবুলের স্মৃতিতে হাস্যরসের সব ছড়া লিখছিলেন তিনি। কিন্তু চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরছিলো তাঁর। চোখ দুটো কাঁদতে কাঁদতে লাল করে ফেলেছিলেন।
কবি জসিম উদ্দিনের লেখা ছাড়াও পরবর্তীতে নজরুল নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের লেখায়ও কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে বুলবুলের যে প্রভাব তা ফুটে উঠেছে পরিষ্কারভাবে। বুলবুলের আরকটি নাম (অরিন্দম খালেদ) রেখেছিলেন কবি। যদিও অরিন্দম খালেদের চাইতে বুলবুল নামেই নজরুল ইসলাম তাঁকে ডাকতেন বেশি।
বুলবুল যখন মৃত্যুর একদম কাছাকাছি, সে সময় নজরুল তার শয়নে বসে বসে অনুবাদ করছিলেন কবি হাফিজের কিছু রুবাইয়াৎ। বুলবুলে উৎসর্গ করে ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ওই কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল রুবাইয়াৎ ই হাফিজ। এই বইটির উৎসর্গপত্রে শোক সন্তপ্ত নজরুল লিখেছিলেন- তোমার মৃত্যুর শিয়রে বসে বুলবুল ই সিরাজ হাফিজের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি- উড়ে গেছো। যে দেশে গেছো সে কী বুলবুলিস্তান, ইরানের চেয়েও সুন্দর? জানিনা তুমি কোথায়? যে লোকেই থাকো তোমার পিতার এই শেষদান, শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো।
আই নিউজ/এইচএ
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা