হেলাল আহমেদ
আপডেট: ১৬:৩৭, ৮ জুলাই ২০২৩
বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াস সেরা ৫ কবিতা
বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াসের কবিতা
বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াস মারা গেছেন সম্প্রতি। গেল বুধবার (৫ জুলাই) দুপুরে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিরতরে নিদ্রায় যান এই শতকের অন্যতম এই কবি। যাবার আগেই যিনি লিখে গিয়েছেন- 'হয়তো আমার পর আমাকে ছাড়িয়ে যাবে কেউ/আমার পেছনে তাই কিছু পদচিহ্ন রেখে গেলাম...
বাংলাদেশের ভাষা আর সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে আহমদ ইলিয়াস ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি। একজীবনে যিনি আবার ছিলেন তিনটি দেশের নাগরিকও। ব্রিটিশ ভারতের কোলকাতায় সেই ১৯৩৪ সালে জন্ম নেয়া কবি প্রাণত্যাগ করলেন ২০২৩ সালে অতি আধুনিক যুগে।
জানা যায় ১৯৫০ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকায় আসেন কবি আহমদ ইলিয়াস। এরপর জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনে। ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষেও। পেশায় কবি ছিলেন একজন সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী। একসময় ঢাকা প্রেস ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি।
আহমদ ইলিয়াসের ছয়টি উর্দু কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে 'বিহারিজ : দ্য ইমিগ্রিজ ইন বাংলাদেশ' এবং দ্য ওয়ার্ল্ড আই স' নামে আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। সবকটা বই-ই বের হয়েছে ঢাকা থেকে।
কবি আহমদ ইলিয়াস ভারতের কর্ণাটক উর্দু একাডেমি থেকে সম্মাননা লাভ করেন। তাছাড়া, কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে মিলে বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন কবি আহমদ ইলিয়াস।
আহমদ ইলিয়াসের কবিতা তুলে ধরেছে উপমহাদেশের ইতিহাসের খননের মধ্যে দাঁড়ানো একজন কবির জীবন। বাংলাদেশের কবিতায় তা প্রায় অনাস্বাদিত। একই দেশে থেকেও এই কবিতা আমাদের কাছে অপরিচিত। এর একদিকে একান্ত নিজস্ব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে একদা সমগ্র এবং আজ খণ্ডিত ইতিহাসের বোঝা। এককথায় এই দুইয়ের মিথস্ক্রিয়া বাংলাদেশের উদুর্ কবি আহমদ ইলিয়াসের কবিতা।
নিচে কবি আহমদ ইলিয়াসের নির্বাচিত ৫টি কবিতা দেওয়া হলো-
ধূসরিত পদযুগল
আমরা এমন বৃক্ষ ছিলাম
রৌদ্র ছিলো বটে
মাথার উপর ছিলো না তার ছায়া
কঠোর কঠিন নীল সুরুজের কায়া
দৃষ্টি শূন্যাহত
পুড়লো গাছের সবুজ পাতা
জমলো বুকে ক্ষতের খাতা
সইলো আঘাত ক্রমাগত।
জমলো মনে তীক্ষ্ণ তাপের রেখা
খুঁজেই তারা হলো সারা
পেল না হায়! সেই পথিকের দেখা।
আমরা কেমন বৃক্ষ ছিলাম
সেই চিন্তাই হইনি চিন্তাময়
সেটাই আমার ভয় —
পথিক যখন তাপের জ্বালায়
ছায়া পাবার দীপ্র আশায়
আসবে যখন ছায়ার তলে —
আবার যখন যাবে চলে —
আমরা এখন কোথায় যাবো? আমরা তো হায়!
সেই বৃক্ষ ছিলোনা তার ঠাঁই।
ঝড়
তাহলে কি সেই থামলো দীপ্র ঝড়?
যার ভয়ে এই চক্ষুযুগল হয়েছিলো
থরোথর —
তামসী করুন মন —
খুলেনি ঘরের বন্ধ দুয়ার।
খুলেছে কি বাতায়ন?
ভিড়েছে কি সেই মাল্লার সারি মেঘনার বুকে —
যারা চলেছিলো উর্মীমালার মুখে।
ফিরেছে কি সেই পৌঢ় মাল্লা বিক্ষত মুসাফির?
যারা ছিলো ধাবমান —
সেই রাস্তার পরে
তারাও ফিরেছে ঘরে
বুকের ভেতরে ভেসেছে আবার নতুন আশার গান।
শান্ত এখন মেঘনার সব তীর —
তাহলে আমার চক্ষুযুগল বন্ধ রাখার নেই কোন প্রয়োজন
খুলবে এবার বন্ধ দুয়ার
অবারিত বাতায়ন
থেমেছে যখন শেষ নির্মম ঝড় —
বইছে এবার মৃদ-মন্দ হাওয়া —
নতুন আশার পাল খুলে আজ আমার এগিয়ে যাওয়া।
নতুন বাঁচার পথ
শব্দ ঠোঁটেই মরে যাবে ভাবিনি
এমন ঘটনা ঘটে যাবে ভাবিনি
মরুর রোদে একাকী চলব পথ
সঙ্গে চলবে স্মৃতির বৃক্ষ ভাবিনি
যে আয়নাকে আজ করেছি সাফ
সে-ও যে ভেঙে ছড়িয়ে যাবে ভাবিনি
আমার গতি তো থামবে চলতে চলতে
সঙ্গে যে সময়ও যাবে থেমে ভাবিনি
তার হাতে থাকা শব্দ-অহমের ছুরি
নেমে আসবে আমার বুকে ভাবিনি
প্রিয়র শহরে নেই দূঃখ জানার প্রথা
হৃদয় নতুন দুঃখে ভরে যাবে ভাবিনি
সবাই খুঁজেছে এখানে নতুন বাঁচার পথ
তুমিও ইলিয়াস যাবে সে পথে ভাবিনি।
কাগজের বাড়ি
যখনই আমি
সাদা কাগজের কোনো টুকরো পাই
নিজেই নড়ে ওঠে আঙুল আমার
তারপর কাগজে রেখা আঁকা
শুরু হয়ে যায়
শুরু হয়ে যায় কল্পনার বাড়ি বানানোর কাজ
আমি কাগজের দেয়াল ওঠাই
দরজা বানাই
জানালা, অলিন্দ সাজাই
ঘরের সামনে
বাগানে ফুল ফোটাই
এরপর, নিজের বাড়ির ছবি দেখে
আমার ভয় লাগে
যেমন করে আমি নিজের বাড়ি হারিয়েছি
হারিয়েছি আসসান ও জমিন
কাগজের এই টুকরোও হারিয়ে না যায়
আমি আবার যদি গৃহহীন হয়ে যাই।
আয়না
’ইতিহাসের আয়নায় যদি খোঁজো আমায়
দেখবে কখনো সিংহাসনে কখনো ঝুলছি ফাঁসির দড়িতে’
’আয়নায় সেই মুখ সেই চেহারা নেই আর
আঁকা হয়ে গেলে সেই সৌন্দর্য থাকে না আর’
’ভোর থেকে ধুলোয় নিজের মুখ লুকাই আমি
সন্ধ্যে হতেই আবার আয়না সাজাই আমি’
‘আয়না নিজেই বদলে যাবে
নিজের চেহারা বদলে দেখো’
’ওইদিকে আয়না আর চেহারার ভিড়
এইদিকে চেহারাহীনতা আর আমি’
’আয়না ছুঁয়ো না অনুতাপ হবে
যদি ভাঙে নিজেই হারিয়ে যাবে
মানুষ কবরের মাঝেও বেঁচে থাকে
এ দৃশ্য বসতির মাঝে পাবে’।
কবি আহমদ ইলিয়াসের উর্দু কবিতা থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন।
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা