সাহিত্য প্রতিবেদক
আপডেট: ১৪:০৪, ১৭ আগস্ট ২০২৩
শামসুর রাহমানের আম্রবৃক্ষ ও পাড়াতলী গ্রাম
‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, কিংবা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা দুইটি বাংলা সাহিত্যের মুক্তিযুদ্ধের এক নান্দনিক দলিল বা চিত্র হয়ে থাকবে অনেক দিন। কবিতা দুটি লিখেছিলেন পঞ্চাশের দশকের প্রভাবশালী আধুনিক বাংলা কবি শামসুর রাহমান। যিনি উল্লিখিত দুইটি কবিতা ছাড়াও বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছেন সমৃদ্ধ কবিতার এক বিশাল ভাণ্ডার। আজকে এই কবির সতেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী।
শামসুর রাহমানের সতেরোতম মৃ ত্যু বার্ষিকীতে কি নিয়ে লিখবো যখন ভাবছি তখনি চোখে পড়ল কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে লেখক আলতাফ শাহনেওয়াজের প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি লেখায়। সেই লেখা জুড়ে কবি শামসুর রাহমান আর কবির নিজ গ্রাম পাড়াতলী, গৃহের সেই ‘ঐতিহাসিক আম্রবৃক্ষ’। ভাবলাম কবির এই আম্রবৃক্ষ এবং পাড়াতলী গ্রাম নিয়েই লেখা যাক। কেননা, এই দুইটি বিষয় জড়িয়ে শামসুর রাহমান হয়তো আজও অদৃশ্যে হেঁটে বেড়ান প্রিয় পাড়াতলীর পথে, মাঠে। কিংবা হয়তো এখনো অদৃশ্য শামসুর রাহমান তাঁর প্রিয় পুকুরঘাটটিতে বসে লিখে চলেছেন মহাকালের কাব্য।
কবি শামসুর রাহমানের সাহিত্যিক জীবনে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা দুইটি যেমন এক বিশাল অর্জন তেমনি এই দুই কাব্যালোচনা যখনি হবে তখন নেপথ্যের আলোচনায় চলে আসবে একটি আম্রবৃক্ষ। সেই আম্রবৃক্ষ যেই আম্রবৃক্ষের তলায় এক বসে এক ঘণ্টার মধ্যে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ দুইটি কাব্য।
সালটা মুক্তিযুদ্ধের। তখন মাত্র যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং ঢাকাসহ মূলত শহরগুলোই বেশি আক্রান্ত। গ্রামগঞ্জে তখনো যুদ্ধের ভয়াবহ চিৎকার আর তাণ্ডবতা পৌঁছায় নি। একাত্তর সালের এপ্রিল মাসে কবি শামসুর রাহমান নরসিংদীর পাড়াতলীতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। এপ্রিলের এক দুপুরে কবি তাঁর বাড়ির পুকুরপাড়ের আমগাছটির নিচে বসে কবি রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ওই দুই যমজ কবিতা।
কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমগাছটির সম্পর্ক নিয়ে কবি নিজেই তাঁর আমতস্মৃতিমূলক লেখা কালের ধূলোয় লেখা বইটায় লিখেছেন- এপ্রিল মাসের সাত অথবা আট তারিখ দুপুরের কিছুক্ষণ আগে বসেছিলাম আমাদের পুকুরের কিনারে গাছতলায়। বাতাস আদর বুলিয়ে দিচ্ছিল আমার শরীরে। পুকুরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, কিশোর-কিশোরীও ছিল ক'জন, সাঁতার কাটছিল মহানন্দে। হঠাৎ আমার মনে কী যেন বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো খেলে গেল।...আমি চটজলদি আমার মেজ চাচার ঘরে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে একটি কাঠপেন্সিল এবং কাগজ চাইলাম।...কাঠপেন্সিল ও কাগজটি নিয়ে সাততাড়াতাড়ি পুকুরের দিকে ছুটলাম...পুকুরের প্রতিবেশী সেই গাছ তলায় বসে...পর পর লিখে ফেললাম দুটি কবিতা— 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা', এবং 'স্বাধীনতা তুমি'।
লেখক আলতাফ শাহনেয়াজের নিবন্ধ পড়ে জানা যায়, কবি শামসুর রাহমান সেদিন যেই গাছটির নিচে বসে কবিতা দুটি লিখেছিলেন সেটি ছিল পুকুরপাড়ের আমগাছ। সেই আম গাছটি পরবর্তীতে ঝড়ের কবলে পড়ে ভেঙে যায়। কিন্তু ২০০৫ সালে অন্যদের অনুরোধে কবি আবারও সেই জায়গায় আরেকটি আমগাছের চারা রোপন করেছিলেন। এ ব্যাপারে কবির বংশের মানুষ বলে দাবী করা এরশাদুর রহমান নামের একজন স্থানীয়ের ভাষ্য ছিল এরকম— 'কবিচাচাকে বলেছিলাম, আমগাছটা লাগিয়ে যান, পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে কবিতা দুটো কোথায় লেখা হয়েছিল।'
পাড়াতলী গ্রামে কবির বাড়ির এই আমগাছটির সঙ্গে কবি শামসুর রাহমানের আরেকটি দুঃস্মৃতিও আছে। সেই স্মৃতিতে লেগে আছে পুত্র হারানোর করুণ শোক। জানা যায়, আমগাছটির পাশেই এই পুকুরে ডুবে প্রাণ গিয়েছিল কবিপুত্র ওয়াহিদুর রহমানের। ঘটনাটি ১৯৭৬ সালে ঘটে, যখন ওয়াহিদুর রহমান একজন কিশোর। সেই কিশোর পুত্রের অকাল মৃ ত্যু শামসুর রাহমানকে হয়তো পরবর্তীতে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। ছেলে ওয়াহিদুরকে কবি আদর করে ডাকতেন মতিন বলে। সেই মায়ার মতিন যখন অকালে কবিকে কাঁদিয়ে চলে গেল তখন শামসুর রাহমান লিখেছিলেন— তোর কাছ থেকে দূরে, সে কোন নিশ্চিন্তপুরে পালাতে চেয়েছি/ প্রতিদিন বুঝলি মতিন!/ হয়তোবা টের পেয়ে অবশেষে নিজেই উধাও হয়ে গেলি।'
-
কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা
-
বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াস সেরা ৫ কবিতা
-
এক যে ছিল স্বপনচারিণী | গল্প
পাড়াতলী গ্রামে কবি শামসুর রাহমান 'কবিচাচা' হিসেবে পরিচিত। রিকশাচালক থেকে শুরু করে সমাজের নানা শ্রেণীপেশার মানুষের কাছে তিনি 'কবিচাচা'। তাঁদের অনেকেই পড়াশোনা জানেন না, কিন্তু এটা জানেন কবিচাচা'র কবিতা দেশের স্কুলে বাচ্চাদের বইয়ে আছে, বাচ্চাদেরকে পড়ানো হয়। গ্রামটি এভাবেই কবিকে আবদ্ধ করে রেখেছিলো নিজের আস্টেপৃষ্টে। কখনো দুঃখ দিয়ে, কখনো শব্দের মাল্যদানে কখনো সাধারণ মানুষের সরলতায়। কবির জবানবন্দিতেই তিনি বলেছেন, এই পাড়াতলী গ্রামকে ভোলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। এই পাড়াতলী ঘিরে কেটেছে কবির শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং প্রৌঢ়ত্ব। পুকুরপাড়ে গাছতলায় বসে উদাস দুপুরে ডাহুকের ডাক শোনার সেইসব স্মৃতি কবি জীবদ্দশায় ভুলতে পারেন নি।
কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট পরলোক গমন করেন। এর আগে ২০০৫ সালে কবি যখন অসুস্থ তখন শেষবারের মতোন গিয়েছিলেন পাড়াতলী গ্রামের বাড়িতে। সেবছরই কবি আগের জায়গায় আমগাছের চারা লাগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর ফিরে এসে আর কখনো পুকুরপাড়ে আমগাছের তলায় বসে হাওয়ার শরীর বুলিয়ে দেয়া উপভোগ করা হয় নি কবির। আমগাছটি এখন আগের চেয়ে বড় হয়েছে। শাখা বড় হয়েছে। শুধু কালের পিঠে থেমে গেছে সেই ঋদ্ধ হাতের লেখায় কাব্যের ছুরিকাঘাত কিংবা সুন্দর পুষ্প উদ্যান নির্মাণ।
তথ্যসূত্র:
পাহাড়তলীর কবিচাচা, আলতাফ শাহনেওয়াজ, প্রথম আলো-১৭ আগস্ট, ২০২৩
কালের ধূলোয় লেখা, আত্মজীবনী, শামসুর রাহমান
- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা