শ্যামলাল গোসাঁই
সৌম্যদর্শন আগুন্তক | থ্রিলার গল্প
শুক্রবার দিন, সকালে ঘুম থেকে ওঠে মুখটুক ধুয়ে মা আয়েশাদের বাড়ির ছাদে বসে আছি। প্রতি সকালেই এখানে এসে ঘণ্টাখানেক বসি। ছাদের চারপাশটা নানান জাতের বনজ বৃক্ষ দিয়ে ঘেরা। সকাল বেলা মানুষের ব্যস্ততা তেমন থাকে না বলে এ সময়টায় পাখিদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। আজকেও তেমনি কয়েক জোড়া পাখি দেখলাম ছাদে ওঠার পর। এক জোড়া মুনিয়া, দুই জোড়া চড়ুই আর একটা দোয়েল ছাদের এখানে ওখানে চষে বেড়াচ্ছে আর ছাদের মেঝে থেকে চঞ্চু দিয়ে খুঁজে খুঁজে কী যেন খাচ্ছে আর উড়াউড়ি করছে। আমি এইসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আয়েশ করে কল্কেতে তামাক সাজালাম। এই সময়টাতে একাই থাকি। তামাক খেতে খেতে বৃক্ষ, পাখি, পাতা, মেঘাচ্ছন্ন কিংবা রৌদ্রজ্বল আকাশ দেখি। ভালো লাগে। কোনো গৃহ দায়িত্বের ভার কিংবা জীবন যুদ্ধের চিরায়ত টান এসময় অনুভত হয় না।
কল্কেতে পরপর দুইটি টান দিয়ে বসে আছি, এমন সময় একজন এসে হঠাৎ আমার সামনে বসলেন। আমি যে ভঙ্গিমায় বসে আছি তিনিও ওইভাবে বসে পড়লেন, কিছু বললেন না। যেন আমার সাথে তার খুব চেনা পরিচয়। কিন্তু আমি তো চিনি না! জিজ্ঞেস করলাম: কে আপনি? আর হঠাৎ করে ছাদে এলেন কী করে?
আগুন্তক ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি আপনার খুবই পরিচিত এবং আপনিও আমার অতিপরিচিত। সহজ করে বললে আমার সমস্ত কাজকর্ম আপনাকে ঘিরেই।
অবাক হলাম, বিষ্ময় চোখে নিয়ে বললাম, কীসব যা তা বলছেন! আপনাকে তো আমি আগে কখনো, কোথাও দেখি নি। আমার মনভুলা রোগ নেই যে দেখা হয়েছে কিন্তু ভুলে গেছি। আপনাকে আমি চিনিই না। সবথেকে বড় কথা আপনি এই ছাদে উঠলেন কী করে? আমি তো বাইরে থেকে ছাদের দরজা লাগিয়ে রেখেছি। বলেই দরজার দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, দরজা আমি যেভাবে বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে আটকিয়ে রেখেছিলাম সেভাবেই আছে। নিচ থেকে কেউ ছাদে আসার প্রশ্নই ওঠে না। আসলেও দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আগুন্তক তো আমার সম্মুখে বসা! তিনি কীভাবে এলেন?
আগুন্তক বললেন, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না আমি আপনার দুশমন কেউ নই কিংবা হ ন্তা র ক নই যে আপনাকে মে রে চলে যাব। বরং, ভাবতে পারেন আমি আপনার বন্ধু। আপনার সাথ আড্ডা দিতে আসলাম। একা একা তামাক সাজিয়ে খাচ্ছেন। একা একা তামাক খাওয়ায় আনন্দ আছে নাকি? ভাবলাম আপনাকে সঙ্গ দেই।
আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না। একবার ভাবলাম খালি পেটে সকালে তামাক খাচ্ছি, তামাকের প্রতিক্রিয়ায় হয়তো এমনটা হচ্ছে। কিন্তু সে তো রোজই খাচ্ছি। কই আর তো এমন হয় নি। প্রতিদিন সকালেই তো এখানটায় বসে তামাক সাজাই; কই আর কোনোদিন তো কোনো আগুন্তকের পূত্র এসে এভাবে সঙ্গ দেয়ার আবদার করে নি। নিজেকে বুঝালাম এটা তামাকের কারণেই হচ্ছে। একটু পরেই ঘোর কেটে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, একটু পরেও সবকিছু ঠিক হলো না। নবাবের পুত্র আগুন্তক বসেই আছেন। যাওয়ার নাম গন্ধটিও নেই। আগে সামনাসামনি বসেছিলেন এখন সরে এসে আমি যে ছিঁড়ে যাওয়া সামিয়ানায় বসে আছি এর একটা পাশে বসলেন। চোখ জোড়া আমার দিকেই তাক করে রাখা। আমি এই প্রথম আগুন্তকের মুখ লক্ষ্য করলাম। কেমন যেন আমার চেহারার সঙ্গে মিলে যায়। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে। মুখে ওলি-আউলিয়াদের মতো লম্বা দাঁড়ি; কিন্তু সব কাঁচা। চুলটা বাবড়ি করে রাখা। যেমন চুল ছিল আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের। লোকটিকে নরসুন্দরের কাছে নিয়ে গিয়ে লম্বা দাঁড়িটা কেটে ফ্রেঞ্চকাট মেরে দিলে একেবারে আমার মতোই দেখাবে মনে হচ্ছে। গায়ে একটা ঘনকালো রঙের ঢিলাঢালা পিরান জরানো। একেবারে পা টু মাথা পর্যন্ত পিরানে ঢাকা। পিরানের নিচে জাঙ্গিয়া বা ট্রাউজার কিছু পরেছেন কি না বুঝা যায় না। যেহেতু বুঝা যায় না সেহেতু জাঙ্গিয়া না পরলেও এক্ষেত্রে সমস্যা নেই। এসব লক্ষ্য করতে করতে আগুন্তকের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেল। আগ্রহের মোহ লাগার মতো একটা ব্যাপার তাঁর মধ্যে আছে। কিন্তু আমি আগ্রহটা নবাবজাদার সামনে প্রকাশ করলাম না। এমন ভাব নিয়ে বসে আছি, সে যে আমার পাশে বসে আছে এটা যেন আমি দেখিই নি। আর দেখলেও আমার কিছু আসে না। কল্কেতে আরেকটা দম বসিয়ে দিলাম এর ফাঁকে। নবাবজাদা আগুন্তক বললেন, আমাকেও দিন। একা একা তামাকে আনন্দ নেই।
আমি কল্কেটা তাঁর হাতে বাড়িয়ে দিতে হাত বাড়ালে সেও হাত বাড়ালো। খেয়াল করে দেখলাম তাঁরও ডান হাতে আমার হাতের মতোই একটা উল্কি আঁকা। কিন্তু অস্পষ্ট। মুছে যাচ্ছে এরকম একটা চিত্র। আমার ডান হাতের যে জায়গাটাতে যেমন করে হলুদিয়া লেখা ঠিক তেমন করে নবাবজাদা আগুন্তকের হাতেও লেখা। ভিতরে ভিতরে ভদ্রলোকের প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগলো। সত্যি বলতে, মনেমনে আমি তখন অনেক উত্তেজিত। সম্ভবতঃ তিনি কে আমি চিনতে পারছি। তিনি হয়তো সত্যিই বলেছেন, তিনি আমাকে চেনেন এবং তাঁর সকল কাজকর্ম আমাকে ঘিরেই। আমি ছাদের দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তিনি কীভাবে ছাদে ওঠে এখানে আমার পাশে এসে বসলেন সম্ভবতঃ আমি বুঝতে পারছি।
তামাকের কল্কেতে দম দিলেন নবাবজাদা আগুন্তক। একটানে যে পরিমাণ ধোঁয়া বেরুলো আমি ভাবলাম কল্কে হয়তো শেষ! আবার সাজাতে হবে। টান শেষ করে আমার হাতে কল্কে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, আজকে একটা বিশেষ দিন। ভাবলাম আপনার সাথে সাক্ষাতের এই উপযুক্ত সময়। সারাদিন তো আপনাকে পাওয়া যায় না। এখানে, ওখানে গলায় বাদ্য ঝুলিয়ে ঘুরেবেড়ান। তাই ভাবলাম, আজকে এই বিশেষ দিনে মুলাকাত করে যাই। অনেকটা নিরাগ্রহ গলায় বললাম, আজকে কী বিশেষ দিন?
আগুন্তক এই কথার বিপরীতে এমনভাবে হেসে ওঠলেন যেন আমি মহাভারত না পড়েই সীতা রামের মাতাশ্রী এমন কথা বলে ফেলেছি। বললেন, মশাই আজকে আপনার জন্মবার। এই দিনে দুনিয়াত আলো দেখলেন আর এই দিনটাকেই ভুলে গেলেন?
আমি মনে মনে লজ্জা পেলাম বটে, কিন্তু নবাবজাদার সামনে প্রকাশ করলাম না৷ বললাম, সে নাহয় হলো। কিন্তু আপনি যে এভাবে নিঃশব্দে অনুমতি ছাড়াই আমার বিশেষ মুহূর্তে এসে ব্যত্যয় ঘটালেন এটা কি অন্যায় না? আগুন্তক আবার হেসে ওঠলেন। বললেন, মশাই, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, আমার সকল কর্মসূচীই আপনাকে ঘিরে। সুতরাং, আপনি যেখানে যেভাবে থাকবেন আমিও সেখানে সেই ভাবে থাকবো।
আমি মনে মনে ভাবলাম, এতো মহা মুশকিল। লোকটা যাচ্ছেও না উদ্ভট কথাবার্তাও বন্ধ করছে না। মাঝখান থেকে যে সকাল উপভোগ করতে এসেছিলাম তা ভেস্তে যেতে চললো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আজ কী হেতু আমার কাছে আগমন?
সৌম্যদর্শন আগুন্তক বললেন, এই সমসাময়িক আলাপ করবো আর আপনার কল্কেতে দম দিবো। এই হলো আজকের সূচি। বলেই হেসে ওঠলো। এই হাসি আমার অস্বস্তি বাড়াচ্ছে বৈ কমাচ্ছে না। কিন্তু যে লোক বিনা অনুমতিতে বন্ধ দরজা মাড়িয়ে ছাদে এসে আমার সামনে বসে পড়েছে তাকে তাড়াবো কী করে তাও মাথায় আসছে না। এটা কী আমার খালিপেটে তামাক খাওয়ার প্রতিক্রিয়া নাকি সত্যিসত্যি কোনো দৈব পুরুষের সাক্ষাৎ কিছুই বুঝতে পারছি না। সিনেমার দৃশ্যে অনেকসময় দেখেছি, কোনো কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এসে উদয় হতে কোনো এক পীর কিংবা আউলিয়াকে। কিন্তু সে তো সিনেমাতে। যা অবিশ্বাস, কাল্পনিক। এখানে আমার সঙ্গে যা হচ্ছে তাকে তো তো এভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না কোনো যুক্তিতেই। আবার অবিশ্বাস করার জোরটিও পাচ্ছি না। কেননা, লোকটা আমার সম্মুখে পদ্মাসনে বসা। তবু জিজ্ঞেস করলাম, তা আপনি যে আমাকে দর্শন দিলেন এমন করে কী সবাইকেই দেন?
তিনি বললেন, না। বললামই তো, আমার সমস্ত কাজকর্ম আপনাকে ঘিরেই৷ এরকম সবাইকে ঘিরে আমার মতো একেকজন আছেন। যারা তাদের সত্ত্বাধিকারীর সামনে স্বরূপ প্রদর্শন করেন।
আমি বললাম, কিছুও বুঝতে পারছি না মশাই। আপনি কী আমার খালিপেট নেশার ফলস্বরূপ হাজির হওয়া কোনো আগুন্তক নাকি সত্যিই আমার দৈবদর্শনের সৌভাগ্য হলো!
আগুন্তক মূর্তিটি উপহাস করেই বললো, আমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেডান আর আমাকেই এখন চিনছেন না? অবশ্য না চেনারই কথা। আমরা সচরাচর দেখা দেই না।
আগুন্তকের উদ্ভট কথাবার্তা শুনে শুধু বললাম, হুমমমম।
আমার একাক্ষরী উত্তর দেখেও আগুন্তকের আগ্রহ মরলো না। সে সাগ্রহেই আমার দিকে তাকিয়ে মিঠা একটি হাসি হাসছে৷ এই তাকিয়ে থাকা আর হাসি বলে দিচ্ছে আগুন্তক আরও অনেক কিছু বলবেন৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, তা আপনার থাকা হয় কোথায়?
সে কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়াই বললো, কোথায় আবার! আপনার অন্দরমহলেই থাকি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, অন্দরমহল বলতে?
আগুন্তক হেসে উত্তর দিলেন, মনের কথা বলছি হে। আমি আপনার মনে থাকি। সেখানেই আমার সদা বিচরণ। আপনার চোখের সামনে অধিষ্ঠিত এই পৃথিবীও আমার বিচরণ ভূমি। তবে মনে থেকেই আপনার মাধ্যমে আমার পৃথিবীর বুকে বিচরণের তৃষ্ণা মিটে যায়।
আমি মনে মনে বকছি, কী গাঁজাখোরে লোক এই আগুন্তক। মুখ দিয়ে যা আসছে তাই গপাগপ বলে যাচ্ছে। অন্দরমহল তাঁর বিচরণ ভূমি! মন ভরে হাসলাম৷ কিন্তু আগুন্তককে ঘিরে আমার অস্বস্তিটা কাটছেই না। বললাম, তামাক তো শেষ উঠবেন না?
সে উত্তর দিলো, এখনি? যে কারণে আপনাকে দর্শন দেওয়া সেই কারণটাই তো এখনো বলিনি। তাছাড়া, আরেকটু বসুন না। দখিন দিকের আকাশটা দেখুন। শূন্য আকাশে কেমন ছাই ঢাকা অন্ধকার নেমে আসছে। কিন্তু পশ্চিমে সূর্যটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আকাশের দুই দিকে দুই দৃশ্য। এক জায়গায় মেঘাচ্ছন্ম অন্য জায়গায় রৌদ্রকর।
আগুন্তকের প্রকৃতি বিবরণ শুনে তাকে কারো কারো সাহিত্যিক মনে হতে পারে। অন্তত তাঁর বিবরণের ধরনটাই এমন। নবাবজাদা আগুন্তকের কথা শুনে দখিন দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই আকাশের কিছু অংশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। একটু আগেও সমস্ত আকাশ পরিষ্কার ছিল। শরতের মেঘমুক্ত সুনীল আকাশের এ অংশটা এখন ছাইরঙা একটা ধূসর সামিয়ানার মতো দেখাচ্ছে৷ পূর্বদিকের আকাশে বিকেলের সোনালি রোদের ঝিলিক তখনো আছে।দেখতে বেশ খাসা দৃশ্যটা। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে সোনামাখা আলো নেমে আসছে একেকটি নির্দিষ্ট সরলরেখায়। রেখাগুলো রোদের তীব্র আলোয় পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। এমন সময় আগুন্তক বললেন, মানুষ এই বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির একটা ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া আর কিছুই না৷ অথচ তাদের এতো গর্ব! এতো স্পর্ধা!
বললাম, আল্লাহ মানুষকে আঠারো হাজার রকমের সৃষ্টির মধ্যে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে তৈয়ার করেছেন। যে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব সেই মানুষের গৌরব থাকবে না? স্পর্ধা থাকবে না? যে মানুষের জন্য মকরুম আবেদের মতো একজন উচ্চমার্গীয় ফেরেশতাও শয়তানে পরিণত হলো সেই মানুষের এই পৃথিবীতে একটু স্পর্ধা, গৌরবের অধিকার তো থাকবেই।
আগুন্তক বিজ্ঞের মতো বললেন, ভুল বললেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এটা শুধু আপনাদের মানবসমাজেই চর্চিত এবং স্বীকৃত। আপনারা নিজেরাই নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জীব দাবি করে বসে আছেন। এক্ষেত্রে আপনারা বাকি সতেরো হাজার নয়শো নিরানব্বই প্রজাতির প্রাণিকুলের কোনো মতামতই নেন নি। যেহেতু তারাও এই জগতের স্বাধীন বিচরণকারী জীব সেহেতু তারা মানুষকে জগতের শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে স্বীকৃতি দিলো কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা তা করেন নি।
আমি অবাক হলাম আগুন্তকের কথা শুনে। মনে হলো তিনি কোনো কারণে মানবজাতির বিরুদ্ধে। কিন্তু কিছু কথা আবার পাগলের প্রলাপ মনে হলো৷ বুদ্ধির বিচারেই যে মানুষ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার তা সকলের জানা। মানতে পারছেন না শুধু আগুন্তক। তাঁর মত, শুধু বুদ্ধির জোরেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা যায় না। বাকি সহাবস্থানকারীদের মতামত জানা জরুরি।
আমি বললাম, মানুষ কীভাবে পশুপাখির মতামত নেবে? একেক জনের একেক ভাষা। তাছাড়া, নেয়ার প্রয়োজনটাই বা কী? এই যে বিশ্ব জুড়ে সভ্যতার ক্রমাগত আধুনিকায়ন, সুপারহিউমেন, পারমাণবিক বোমা, সম্প্রতি তো চাঁদও মানুষ জয় করেছে। এতোসবের পরেও আপনার কেন এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে যে, মানুষই শ্রেষ্ঠ।
সৌম্যদর্শন নবাবজাদা আগুন্তক আবারও একটা হাসি দিলেন। কিন্তু মিঠা হাসি না। অনেকটা উপহাস কিংবা বিদ্রুপ করার ছলে হেসে বললেন, দেখুন আমি বলতে চাইছি মানুষ এই প্রকৃতির আরো অনেক গতিশীল বিষয়ের মতো ক্ষুদ্র একটি বিষয়। যার মূল সুর পোঁতা আছে এই বিস্তীর্ণ প্রকৃতির মাঝেই। এখানে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা খুবই ছোট মানের জয়জয়কার। কেননা, মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে জগতের আর কেউ মাথা ঘামায় না শুধু মানুষ ছাড়া। মানুষ ছাড়া আর কেউ বা কোনোকিছু হয়তো এসব নিয়ে ভাবেই না।
আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, ভাববে কীভাবে? অন্য সবকিছুর কী আর মানুষের মতো শক্তিশালী চিন্তাশীল মন আছে? শব্দের ব্যঞ্জনা ভাব প্রকাশের মতো মিষ্টি একটা সার্বজনীন ভাষা আছে? মানুষের মস্তিষ্ক সবচাইতে উন্নত। আর এই উন্নত মস্তিষ্কের জন্যই মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। জানোয়ার শুধু খাওয়া আর ঘুম নিয়েই চিন্তা করে দিন গুজরান করে। মানুষ নাওয়া-খাওয়ার বাইরেও অনেক কিছু করে এই পৃথিবীতে অবদান রাখছে।
আগুন্তক বললেন, আপনাদের শক্তিশালী, চিন্তাশীল মস্তিষ্কের এই উর্বর ভূমি কী কী কাজে আসছে শুনি?
আমি এক রুশে বললাম, উড়োজাহাজ, রেল, বাস, এটুআই, সুপারহিউম্যান, মহাকাশযানসহ আরো অনেক গর্ব করার মতো আবিষ্কার মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত। শক্তিশালী চিন্তাশীল মনের একাগ্র অধ্যবসায়ের ফল এসব বড় বড় আবিষ্কার।
আগুন্তক বললেন, কিন্তু এসমস্তকিছু আপনাদের কল্যানের জন্যই করেছেন। এগুলোর অনেককিছুই আবার আপনাদের কল্পিত বাস্তবতা। মানুষ মানবজাতির কল্যানস্বার্থে এ সমস্ত আবিষ্কার করেছেন। আইন, নীতি, দেশ, চেতনা এগুলো মানুষের উচ্চমার্গীয় চিন্তাপ্রসূত ফল নয়। বরং, একটা অদৃশ্য আষাঢ়ে গল্পের মতো। যদিও তা আপনাদের জন্য মূল্যবান এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্যপালনীয়ও। কিন্তু সত্যি বলছি ওসবের কোনো দৃশ্যমান ভিত্তি নেই। মানবজাতি ছাড়াও দুনিয়ায় আরো যে হাজার জাতের প্রাণি, জড়, উদ্ভিদ, আছে তাদের কল্যানের জন্য কিছু করেছেন কি?
আমি বললাম, মানুষ যেমন জন্মলগ্ন থেকে এ পৃথিবীতে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করে করে টিকে আছে, বাকিদেরও নিজেদের ব্যাপারে তাই করা উচিত। এখানে আমরা মানুষরা কী করতে পারি?
'আপনারা অনেককিছুই করতে পারেন' বলেই মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে আগুন্তক হাসলেন আর বললেন, সবথেকে ভালো পারেন বিশ্বাসযোগ্য কাল্পনিক মিথ্যা গল্প বানাতে। আমার মনে হয় বুদ্ধির জোরে নয়, এই বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা গল্প বলার গুণের জন্যই মানুষ জগত সেরা।
আমি চাপা গলায় বললাম, আপনি কিন্তু অপমান করছেন!
আগুন্তক বললেন, দুঃখিত। আপনাকে অপমান করা আমার উদ্দেশ্য নয়৷ আমি যা সত্য তাই বলছি। আপনারা বুদ্ধি আর জগতের শ্রেষ্ঠ জীব দাবি তুলে তুলে পৃথিবীর যে অনিষ্ট সাধন করছেন তা আপনাদের জন্যই কাল বয়ে আনছে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে সৃষ্টিকূলের সেরা দাবিদার একটি প্রজাতির কারণে অন্যরাও ধ্বংস হয়ে যাবে বা যাচ্ছে। এর দায় আপনাদের।
আমি বললাম, যুগ সাক্ষী এই মানুষের কারণেই আজ সভ্যতার এতো জয়জয়কার। মিশরের পিরামিড থেকে শুরু করে হাল আমলের ফ্লাইং জেট, সমরাঙ্গণে ব্যবহৃয় অত্যাধুনিক ড্রোন সবই মানুষের কারণে হয়েছে।
আগুন্তক অনেকটা উপহাস করেই বললেন, মজার ব্যাপার হচ্ছে এক মানবজাতি ছাড়া পৃথিবীর কোনোকিছুরই মিশরের পিরামিড বা আপনাদের অত্যাধুনিক ড্রোন দেখার আগ্রহ নেই৷ দীর্ঘকাল ধরে যে কুকুর মানুষের সাথে সহাবস্থান করে আসছে সেই কাছের প্রাণি কুকুরটিরও কিন্তু এসব নিয়ে কোনো আগ্রহ বা মাথাব্যথা নেই।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বলুন তো? আপনার কাছে নাহয় মানুষ নিকৃষ্ট। কিন্তু শ্রেষ্ঠ কে?
তিনি বললেন, মানুষ নিকৃষ্ট একথা কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও বলি নি। শুধু বলতে চাচ্ছি, মানুষ তার মূল শেকড় থেকে সরে যাচ্ছে। শুধু মানুষ সরেই যাচ্ছে না। তার উত্তরাধিকারীদেরকেও সচেতনভাবে শেকড় বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন। আপনাদের পড়ার বই, আপনাদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র, আপনাদের বাচ্চাদের পাঠ্যবই সবকিছু থেকে শেকড়কে উগরে ফেলে দিয়ে আপনারা ক্রমশ গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন একটা কল্পিত বাস্তবতার স্তুপে। যেখানে রং আছে সার নেই।
আগুন্তকের কথাবার্তা ক্রমশ গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে কী বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
চলবে ....
- লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা