আহমদ সিরাজ
ড. সেলু বাসিতের জন্মদিনে
ড. সেলু বাসিত
‘জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো’ এমন প্রবাদ বাক্য যথার্থ বিবেচ্য হলেও ড. সেলু বাসিতের জন্ম যথাযথ ও যথাযোগ্য এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে হয়েছে বলে তিনি সৌভাগ্যবান এমন বিবেচনার বাইরেও তিনি তাঁর যোগ্যতাকে বহন করেই একজন ড. সেলু বাসিত হয়ে উঠেছেন ও একজন আলোকিত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছেন।
তিনি ছাত্র হিসেবে মেধাবী হওয়ায় ‘বইপোকা’ হয়ে কেবল পড়ার মধ্যেই থেকে যেতে পারতেন যা তাঁর সঙ্গী-সাথীদের অনেকেই জীবনের পথ বাছাইয়ে এভাবে করে থাকেন। তিনি তা না করে পড়া জ্ঞান চর্চার অংশ হলেও জ্ঞানের একটা জগৎ তৈরি হওয়া- যা একটা বৃহত্তর মানবিক সমাজ বহন করে। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘খেলাঘর’ এ জাতীয় প্রগতিশীল সংগঠনের ভিতর দিয়েই কেবল একটা সামাজিক বৃহত্তর জ্ঞানদীপ্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
তিনি ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল বাসিত, মাতা আনোয়ারা বেগম এই সময়ে আলোকিত অগ্রসর চিন্তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে তাঁরাও। মাতা সিলেটের নারী আন্দোলনে-জাগরণে সক্রিয় সংগঠক নেত্রী। সুশিক্ষিত অগ্রসর পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে সেলু বাসিতের গড়ে উঠায় এসব অবশ্যই প্রেরণাশ্রয়ী হয়েছে। এছাড়াও এ সময়টা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ৫২-র ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। তিনি শৈশবেই এর প্রভাব-স্বভাবে আলোড়িত হয়েছেন। এ সময়টাকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন উমর বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাকিস্তানের জন্মের আগে বাঙালি মুসলমান মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনায় মোহান্ধ থেকেছে এবং পাকিস্তান জন্মের পরপরই ১৯৪৮ সালে এই মোহ ভাঙতে থাকে এবং ৫২-র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মোহমুক্তি ঘটে। ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রূপায়িত হয়ে ওঠে।
এই পটভূমি বহন করে সেলু বাসিতের যাত্রাপথ পরিক্রমা বা বেড়ে ওঠা সংগঠিত হয়েছে। তাঁর পরিবারও প্রগতিশীল সংস্কৃতিতে সক্রিয় ও সংগঠিত। তিনি শৈশবেই পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি এসবে আকৃষ্ট হয়েছেন। তিনি শৈশবে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় শিশু-কিশোর সংগঠনে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। শিশু-কিশোর সংগঠন তাঁর পাঠের অংশের মতো হয়ে ওঠে। তাঁর চিন্তা মনন গড়নে খেলাঘর হয়ে ওঠে যেন গোলাঘরের মতো। তিনি খেলাঘরের কর্মী সংগঠক হিসেবে ক্রমশ এই সংগঠন গড়ে তোলাতে নেতৃত্বের ভূমিকাও পালন করেন। সিলেট অ লে খেলাঘরকে আলোর বাতিঘর হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। তিনি ছাত্র হিসেবে মেধাবী হওয়ায় ‘বইপোকা’ হয়ে কেবল পড়ার মধ্যেই থেকে যেতে পারতেন যা তাঁর সঙ্গী-সাথীদের অনেকেই জীবনের পথ বাছাইয়ে এভাবে করে থাকেন। তিনি তা না করে পড়া জ্ঞান চর্চার অংশ হলেও জ্ঞানের একটা জগৎ তৈরি হওয়া- যা একটা বৃহত্তর মানবিক সমাজ বহন করে। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘খেলাঘর’ এ জাতীয় প্রগতিশীল সংগঠনের ভিতর দিয়েই কেবল একটা সামাজিক বৃহত্তর জ্ঞানদীপ্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি এই চেতনার ভেতর অগ্রসর হয়ে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামেও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষার পাঠ গ্রহণ করেছেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। সমাজ পরিবর্তনে সংস্কৃতির বিরাট ভূমিকায় উদীচী থেকে সিলেটের গণমানুষের কবি দিলওয়ারের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। তিনি তাঁর সমস্বর শিল্পীগোষ্ঠী সক্রিয় কর্মী সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি পড়াশুনার নিবিষ্ট স্বনিষ্ঠ একজন থেকেও সমাজের তথা আর্থ-সামাজিক রাজনীতির আমূল পরিবর্তনে সাধারণ কর্মীর মতো মাঠের কর্মী হয়ে উঠতেও দ্বিধা রাখেননি। তিনি এসব চিন্তা-চেতনা বহন করেই উচ্চশিক্ষা, গবেষণা রপ্ত করেছেন। তিনি নির্লিপ্ত গবেষক হয়ে উঠেননি। তিনি ১৯৭৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ (অনার্স) সহ ১৯৭৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভ করে ১৯৯৯ সালে ‘সিলেটের উপভাষা : সাংগঠনিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণার উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২-৮৪ সালে বাংলা একাডেমির বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক হিসেবে ‘বাংলাদেশের গবেষণা সাহিত্য ১৯৪৭-১৯৮২’ শীর্ষক গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করেন- যার প্রথম সংস্করণ ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডি এন্ড ল্যাঙ্গুইস্ট অব বাংলাদেশ’ (১৯৮৭), দিলওয়ার : অব্যাহত কবিতার ধারায়; এছাড়া প্রবন্ধ-নিবন্ধ, জীবনীগ্রন্থ, ছড়া, কবিতা প্রভৃতি আছে। এছাড়া জাতিসংঘ সমিতি সহ বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে পারিবারিকভাবে আনোয়ারা বাসিত ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে দরিদ্র, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা হিসেবে বৃত্তি প্রদান করে থাকেন। এছাড়াও চাবাগান, হাওর অঞ্চলে সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও সময় সময়ে আর্থিক সহায়তার চেষ্টা করে থাকেন। তিনি গতানুগতিক হইহুল্লোড় ধরনের আড্ডাবাজ না হলেও সাহিত্য সংস্কৃতির সৃজনশীল কাজে একজন বিবেচক মানুষ। তিনি মানুষের দুঃখের সকালে ও বিকালে একজন স্বজন, হৃদয়ী মানুষ। তিনি অনুসন্ধানী একজন গবেষক হিসেবে ঘুরে বেড়ানোতেও আগ্রহী থাকেন।
মজার ব্যাপার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেও পদ-পদবিকে যথাযথ রেখে পাবলিক মন দ্বারা তাড়িত থেকেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু পদাধিকারী ও একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হলেও বিবৃতিজীবী হয়ে ওঠেননি। তিনি এলিট বিদ্বানের নাভী তথা রাজধানীতে থেকেও দূরের নিস্তরঙ্গ জনপদের গ্রাম শ্রীনাথপুর কিংবা চা-পল্লি মির্তিঙ্গা হারায়নি। তাঁর সঙ্গে আমাদের জানাবুঝা যত প্রবল হয়ে উঠেছে এমন অনুভূতিও আমাদের তাড়িত করেছে।
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা