শ্যামলাল গোসাঁই
শাহ আব্দুল করিমের বাউলিয়ানার সন্ধানে
শিষ্যদের সঙ্গে জীবিতকালে শাহ আব্দুল করিম। ছবি- সংগৃহীত
শাহ আব্দুল করিম, যাকে এখন বাউল শাহ আব্দুল করিম বা ক্ষেত্রবিশেষে বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম উপাধীতেও ডাকতে দেখা যায়। এর কারণ, শাহ আব্দুল করিমের বাউল গান। যে গান দিয়ে তিনি সিলেট অঞ্চল ছাড়িয়ে পরিচিতি পেয়েছেন সারা বাংলায় এমনকি বিশ্বেও। সরল, সাবলীল ভাষ্যে লিখিত তাঁর গানগুলোকে এ দেশের মানুষ লুফে নিয়েছেন বলা যায়। তাঁকে ভালোবেসে উপাধী দিয়েছেন বাউলসম্রাট।
তদুপরি একটি প্রশ্ন মাঝেমাঝেই শুনতে হয় বা উঠে, শাহ আব্দুল করিম কি শুধুই বাউল? নাকি তিনি বাউলিয়ানাকে ছাড়িয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন শিল্পের এক অনন্য উচ্চতায়। যেখানে তিনি শুধুই একজন সাধক বাউলের ভূমিকা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেননি। গানের মধ্য দিয়েই অংশ নিয়েছেন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিষয়গুলোতেও। সেখানে শাহ আব্দুল করিমকে শুধুই একজন বাউল বা বাউলসম্রাটের আখ্যা দিয়ে তাঁকে ষোলোকলা পাঠ করা সম্ভব কি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে কিছুটা অতীতে। জানতে হবে বাউলের যাত্রা ও উৎপত্তির কথা। বাউলদের সাধনপ্রণালী এবং যাপিত জীবন ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে মেলাতে হবে আমাদের শাহ আব্দুল করিমের সাধন জীবন, সঙ্গীত জীবন। তাহলে এ বিষয়ে কিছু সম্মুখ ধারণা লাভ করা যেতে পারে।
আব্দুল করিম যখন গান- 'কোয়ালিশন মন্ত্রিসভাতে আওয়ামী লীগ যাওয়ায়/ চিরদুঃখী গরিব-কাঙালে জীবনভিক্ষা পায় রে' তখন কেউ যদি বলে বসেন এটা একটা বাউল গান তাহলে ভুল। বরং বলতে হবে, অত্যন্ত সচেতনভাবেই একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এই গানগুলো সেসময় লিখেছিলেন আব্দুল করিম। তাই আব্দুল করিম পাঠ করতে করতে একটা সময় মনে হয়- আব্দুল করিম শুধুই কি একজন বাউল? তিনি কী একজন সময়সেচতন সমাজচিন্তক, রাজনীতিবিদও নন?
বাউল কী বা বাউল কারা- এ নিয়ে আগেও যেমন নানা মতবেদ ছিল এখনো তা বিদ্যমান। কেউ কেউ যেমন মনে করেন এ দেশের বাউলদের যাত্রা সংস্কৃতের উদরজাত বেদ থেকে শুরু ঠিক তেমনি অপর একটি পক্ষ মনে করেন ছুফীবাদের মধ্য দিয়ে এ দেশে বাউলদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর কারণ সম্ভবত বাউলদের বৈচিত্র্যময় জীবন ও দর্শন। তবে, বেশিরভাগ ইতিহাসবেত্তাদের লেখা পড়লে বোঝা যাবে, এ দেশে বাউল জাতীয় সম্প্রদায়ের শুরুটা সনাতনীদের থেকেই। ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মের আগমনের অনেক পূর্ব থেকেই বাউলদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাই বলা যেতে পারে, মূলত হিন্দ্ বৌদ্ধ যোগী সন্ন্যাসীদের থেকেই বাউল সহজিয়া ও ন্যাড়া ফকীরদের উৎপত্তি। যেকারণে, অতীত ইতিহাসে যাদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় তারা সবাই হিন্দু। যেমন সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাউল হলেন আদিনাথ, তার শিষ্য মূলনাথ, তার শিষ্য নিত্যনাথ, নিত্যনাথের বন্ধু ও গুরু ভাই ছিলেন মনাই ফকীর। নিত্যনাথের শিষ্য কালাচাঁদ, তাঁর শিষ্য হারাই, তার শিষ্য দীননাথ, তার শিষ্য ঈষাণ এবং ঈষানের শিষ্য হলেন একালের অন্যতম প্রধান বাউল মদন। সবশেষ বহুল পরিচিত লালন ফকীরের প্রধান শিষ্যের নাম গগন ডাকহরকরা।
ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করে আমাদের ধারণা জন্মেছে যে, নদীয়া যেলা বাউল মতের উদ্ভবের স্থান। কেননা বাংলাদেশের প্রাচীন সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল নদীয়া। তাই বৃহত্তর নদীয়ায় বাউল মতের প্রসার অধিক হয়েছে। ঈশ্বরপুরী, চৈতন্যদেব, অদ্বৈতাচার্য হরি গুরু প্রমুখ ছিলেন এর প্রবক্তা। এদের প্রভাবে সুলতানী ও মোগল আমলে ওলী-আউলিয়াদের ইসলাম প্রচার খুব জোরালো হতে পারেনি। বাউল মতবাদের অনুসারী লালন শাহ্ (আনুমানিক ১৮১৫-১৮৮৬ খ্রি.) ১৮২৩ সালে কুষ্টিয়ায় ছেউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করলে তা বাউল মতবাদের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।
‘বাউল’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ড. পঞ্চনন সাহা বলেন, হিন্দী শব্দ ‘বাউরা’ বা উন্মাদ থেকে বাউল কথাটি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন যে, সংস্কৃত ‘বাতুন’ থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। অন্যদিকে ছূফীরা সাধু ফকীরকে বলে আউলিয়া। এই আউলিয়া শব্দটি উদ্ধৃত ‘আউল’ শব্দটি ‘বাউল’ শব্দটির সাথে যুক্ত হয়েছে। এই বাউলরা জাত-পাত হিন্দু-মুসলমানে বিচার করে না। মূলত এরা পাঙ্গাশ ও ক্ষ্যাপা ভাবধারার। আর ইতিহাসবিদ এম. এ. রহীম বলেন, বাউল শব্দটি সংস্কৃত ‘বাতুন’ শব্দ থেকে এসেছে; এর অর্থ পাগল বা মানসিক অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি। এভাবে বাউল নামটি একদা ব্যক্তি বিশেষের জন্য ব্যবহৃত হলেও পরবর্তী পর্যায়ে যারা আধ্যাত্মিক উন্মাদনায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকেন, তাদের জন্য উহা সাধারণভাবে প্রচলিত হয়ে যায়।
বাউলদের সাধনার বিষয় নিজ মনে বিরাজিত খোদার সন্ধান। অর্থাৎ, বাউলরা সাধারণত ঈশ্বর বা খোদা মানুষের মাঝেই বিরাজ করেন এই সরল আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁরা মসজিদ, মন্দিরের ধার ধারেন না, নামাজ বা ঠাকুরের প্রার্থনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভজনা। বাউল ধারার একটা সাধারণ বিশ্বাস, এই মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই খোদার সান্নিধ্য লাভ করা যায়। জীবনের প্রকৃত আনন্দ খোঁজে পাওয়া যায়। তবু, বাউলদের কিছু গুঢ় সাধন প্রণালীও থাকে। তাঁরা সেই মোতাবেক তাঁদের জীবন পরিচালন করেন।
২.
সিলেট অঞ্চলের শাহ আব্দুল করিমও একজন বাউল ছিলেন। কিন্তু, শুধুই বাউল ছিলেন না। বাউলরা মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই খোদার সান্নিধ্য লাভ করা বা জীবনের প্রকৃত আনন্দ খোঁজে পাওয়া যায় এই নীতিতে বিশ্বাস করেন এবং তাঁদের গুঢ় সাধন প্রণালী চালিয়ে যান। শিষ্যদের মধ্যে সেই দিব্যজ্ঞান বিতরণ করেন। যা বাইরের লোকেদের কাছে দুর্বোধ্য। শাহ আব্দুল করিমও দম সাধন করেছেন দীর্ঘসময়। তাঁর প্রথম দিককার ওস্তাদ মুন্সি মৌলা বক্স সাহেবকে তিনি গুরুরূপে মাণ্য করতেন। বলা ভালো, তিনিই তাঁর গুরু ছিলেন।
শাহ আব্দুল করিম ছিলেন মুসলিম বাউল। বাউলদের মধ্যে যারা মুসলমান ও হিন্দু তাঁদের পরিবেশনায় কিছুটা তফাৎ লক্ষ করা যায়। বৈষ্ণবপন্থী বাউলরা কৃষ্ণপ্রেমকে পুঁজি করে এ ধরাধর জয় করতে চান। আবার বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গের বাউলরা কালীভক্তির মধ্য দিয়ে নিজেদের সাধন প্রণালী চালান। মুসলিম বাউলরা আশ্রয় নেন ছুফীবাদের। তাঁরা আশুক-মাশুকের লীলার মধ্যে এই জগতকে ধরতে চান। যা শাহ আব্দুল করিমের অনেক গানেও আমরা পাই। বলা যায়, একজন মুসলিম বাউল হবার দরুণ এটি তাঁর গানের বা সাধনের সহজাত একটি বৈশিষ্ট্য। তবে, তিনি শুধুমাত্র এই আশুক-মাশুকের লীলা বা বাউলদের গুঢ় দম সাধনের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন নি।
আমরা জানি, উজান ধলে হাওরপাড়ে জন্ম নেওয়া শাহ আব্দুল করিম বাল্যকাল থেকেই দেখেছেন দারিদ্রতার করুণ আঘাত। নিজেও এই আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন শিশুবয়স থেকেই। যে বয়সে অন্য শিশুরা হাতে বই নিয়ে বিদ্যালয়ে যেতো তিনি সেই বয়সে গরুর পাল নিয়ে মাঠে গেছেন রাখাল সেজে। ছোটবেলাতেই দারিদ্রতার এই অভিজ্ঞা তাঁর চোখে ধরিয়ে দিয়েছিল সমাজে বিভেদমূলক ব্যবস্থা, ধনী-গরীবের পার্থক্য আর অসৎ মানুষের কতৃত্ব। বাল্যকালের এই শিক্ষা পরিণত বয়সে আব্দুল করিমকে একজন সমাজচিন্তকে তৈরি করে। তিনি আরও বিস্তৃতভাবে দেখতে পান, শুধু দেশেই নয় বিশ্ব জুড়ে চলছে এই অসাম্য, নিপীড়ন। যা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। আর এই বোধ থেকে তিনি লিখতে শুরু করেন গণসংগীত ধর্মী গান। যে গানগুলোকে আমরা বলি জনমানুষের গান। যে গান বঞ্চিতের কথা বলে, যে গান শোষিতের বিপক্ষে শোসকের পক্ষের হয়ে লড়ে সেই গান লেখা শুরু করেন আব্দুল করিম। আর এতে করে, তিনি তাঁর বাউল গানের আঙিনা মাড়িয়ে প্রবেশ করেন রাজনৈতিক দর্শনে। তাঁর গানে তখন আশুক-মাশুকের লীলা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে হাওর পাড়ের সাধারণ মানুষের শোষিত জীবনের দুঃখের কথা। এ দেশের দুঃখী মানুষের দাবীদাওয়ার কথা। তাঁর গান তখন আর শুধু বাউল গান থাকে না হয়ে ওঠে দশের গান, দেশের গান, সমাজের গান।
যখন শুনি আব্দুল করিম গাইছেন-
দেশেতে মজুরি নাই
মজুরের কপালে ছাই
ভিখারির ভিক্ষা নাই সবের দরজায়।
রাড়ি বুড়ির দুঃখের চিন
গ্রামে গ্রামে চাউলের মিশিন
ধনী মানীর রঙের দিন এই বাঙলায়॥
তখন সহজেই বুঝে ফেলি আব্দুল করিম কী বলতে চাচ্ছেন। গ্রামে গ্রামে চাউলের মিশিন দিয়ে যে কবি উত্তর আধুনিককালে শিল্প আর পুঁজিবাদের নীরব অথচ ভয়াল থাবার কথা লিখছেন। কেননা, পুঁজিবাদ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে দেশে ধনীক শ্রেণীর একতরফা রঙিন দিন শুরু হচ্ছিল সেসময় তা একজন দক্ষ সমাজ পর্যবেক্ষকের মতো ধরতে পেরেছিলেন শাহ আব্দুল করিমের। যা একজন 'অপ্রকৃতিস্থ বাউল'- এর পক্ষে বলা সম্ভব নয়। শুধুই যারা বাউল তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন দিল দরিয়া। তাঁরা এই দিল দরিয়ার কথা গানে গানে ছড়িয়ে দেন। কিন্তু, আব্দুল করিম আমাদেরকে সরাসরি শোনাতে লাগলেন গণমানুষের কথা। এখানে মনের কথা আর লিখেন না আব্দুল করিম। লিখেন শাসনের কথা, শোসনের কথা, পুঁজিবাদ, সরকারি সাহায্য নানান কিছুর কথা। যেই শব্দগুলোই রাজনৈতিক। এই শব্দগুলো বাউল ঘরানার নয়।
আব্দুল করিম যখন গান- 'কোয়ালিশন মন্ত্রিসভাতে আওয়ামী লীগ যাওয়ায়/ চিরদুঃখী গরিব-কাঙালে জীবনভিক্ষা পায় রে' তখন কেউ যদি বলে বসেন এটা একটা বাউল গান তাহলে ভুল। বরং বলতে হবে, অত্যন্ত সচেতনভাবেই একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এই গানগুলো সেসময় লিখেছিলেন আব্দুল করিম। তাই আব্দুল করিম পাঠ করতে করতে একটা সময় মনে হয়- আব্দুল করিম শুধুই কি একজন বাউল? তিনি কী একজন সময়সেচতন সমাজচিন্তক, রাজনীতিবিদও নন? যিনি তাঁর গানে গানে লিখে গেছেন লিখেন শাসনের কথা, শোসনের কথা, পুঁজিবাদ, সরকারি সাহায্য নানান কিছুর কথা।
আই নিউজ/এইচএ
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা