Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, রোববার   ২০ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৭ ১৪৩২

শ্যামলাল গোঁসাই

প্রকাশিত: ১৯:১২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আপডেট: ১৫:১৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

একটি বইবাহী যান এবং অন্যান্য

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আয়োজিত ভ্রাম্যমাণ বইমেলা।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আয়োজিত ভ্রাম্যমাণ বইমেলা।

শুনলাম সরকারি ইশকুলের মাঠে একটা ছোট বইমেলা বসেছে। বসেছে বললে ভুল হবে বইমেলা নাকি চাকায় চরে এসেছে! মৌলভীবাজার একটা ছোট্ট গ্রামীণ শহর। এটা না গ্রাম না শহর টাইপ। মনু নদের পাড় ঘেঁষে যান্ত্রির শ্বাস নিয়ে বেড়ে ওঠা শহরে যেমন গাড়ি, উঁচু দালান, ডিজেলের গন্ধ ভরা ভ্যাপসা গরম হাওয়া আর শপিং মল আছে। তেমনি মনুর ওপাড়ে গেলেই দেখা মেল সবুজ বিস্তীর্ণ গ্রাম্য এলাকার। জেলা সদরেই পড়েছে গ্রামগুলো। তবু, একেবারে ষোলো আনা গ্রাম। তাই এটাকে এখানকার মানুষ গ্রামীণ শহর বলে। এখানে সাধারণত বইমেলা বসে না। শহরে যে বইয়ের দোকানগুলো আছে সেগুলো পাঠের বই কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবই দিয়ে ঠাসা থাকে। পড়ার মতো বইয়ের জন্য তাই বছরে এক দুইবার রাজধানীতে যাই। অল্প দামে বই নিয়ে আসি। তাই মেলার খবরটা শুনতেই ভাবলুম একবার ঢুঁ মেরে আসি। 


বইমেলা বসেছে সরকারি ইশকুলের মাঠে। আমার অফিস থেকে বেশ কাছেই। হেঁটেই যাওয়া যায় পাঁচ মিনিটে। মাঠে প্রবেশ করে তো চোখ ছানাবড়া! এতো বড় আয়োজন। এতো শিশু এখানে কী করছে? একঝাঁক তারার মতো শিশুকে দেখলাম মাঠের একটা কোণায় বসে রঙিন সব ছবি আঁকছে। কেউ কেউ বইয়ের তাকগুলোতে পছন্দসই বই দেখছেন। 

ততোক্ষণে আমি বুঝে গেছি মেলাটা ভ্রাম্যমান। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আয়োজন করেছে। ওরা প্রতিবছরই এমন আয়োজন করে। ওদের বইয়ের গাড়িতে করে সারিসারি বই নিয়ে ছুটে যায় এই শহর থেকে ওই শহরে। প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে যায় বইবাহী এই গাড়িটি। সেই টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, হাওর থেকে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে দুর্দাম ছুটে চলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই বইবাহী গাড়ি। গাড়িটা সারাবছর দেশের কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়ায়। কাঁচের গ্লাসের ভর্তি রঙবেরঙের বই নিয়ে। যখনই গাড়িটা দেখি আমার দুইটা বিষয় মনে পড়ে। এক নম্বরে আবু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কথা। লোকটাকে কোনোদিন সামনে থেকে দেখিনি আমি। দূর থেকে শুনেছি এই দেশের কিশোর-কিশোরীকে বই পড়ার আনন্দকে আরও সহজ করে দিতে তিনি কেমন দারুণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগেরই ফসল এই বইবাহী গাড়ি।

বইবাহী গাড়িটা দেখলে দুই নম্বরে আমার মনে পড়ে লাশবাহী গাড়ির কথা। কু কু শব্দে সারা পথঘাট কাঁপিয়ে মোর্দা বহন করে লাশবাহী গাড়ি। যখন আর মানুষের কিছুই করার থাকে না। নিথর পড়ে থাকে স্ট্রেচারে। কিন্তু, বইবাহী গাড়িতে কোনো মানুষ না থাকলেও থাকে কোটি কোটি জীবিত বর্ণমালা। এগুলোর প্রত্যেকটি মানুষকে আলো দেয়। এই আলোয় মানুষ আলোকিত হয়ে মৃত্যুকেও জয় করে নেয়। লাশবাহী গাড়িটা ভয় ধরিয়ে দেয়। কিন্তু, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইবাহী গাড়িটা দেখলেই আনন্দ লাগে।  

আমি তাকে সাজানো একের পর এক বইগুলো দেখছি। বেছে বেছে পকেটের কথা মাথায় রেখে মুনতাসীর মামুনের অনুবাদ করা আলজেরীয়–ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যুর দি আউটসাইডার আর আমাদের লোকাল লিজেন্ড সৈয়দ সাহেবের বড়বাবু কিনলাম। অনেক দিন ধরেই ভাবছি বাংলাদেশি সাহিত্যিক মুনতাসীর মামুনের লেখায় আলবেয়ার কাম্যুকে পড়া শুরু করবো। বইটা দেখেছিলামও অনলাইনে কেনা হয়নি দাম বেশি বলে। এখানে তিরিশ পার্সেন্ট কমিশনে দিয়ে দিল তাই দুইটা বই-ই নিয়ে নিলাম।পাশেই একজন মাকে দেখলাম তাঁর কিশোর ছেলেকে নিয়ে এসেছেন বইমেলায়। আমার পাশে দাঁড়িয়েই বই দেখছিলেন মা-ছেলে। দেখলাম তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' বইটা দেখিয়ে বলছেন, 'এই বইটা নেবে? এটাও অনেক সাড়া জাগানো।'  

বুঝলাম নারী নিজেও বই পড়েন। না পড়লেও অন্তত খবর রাখেন বইয়ের পাড়ার। একটা সময় ছিল যখন বাঙালি নারীরা অন্দরে বই পড়ে দিনের বড় একটা সময় কাটাতেন। গ্রামের নারীরাও বাদ যেতেন না। আমাদের কাছাকাছি বাড়ির এক কিশোরী বিবাহিতা ছিলেন। তাঁর ঘরে অনেক পুরোনো কিছু রঙিন মলাটের বই দেখতাম। সব আনাড়িপনা সস্তা প্রেমের গালগল্প। তবু তাঁরা পড়তেন তো! এখন শহুরে কিছু শিক্ষিতা ছাড়া কারো হাতে বই দেখা যায় না। বরং, হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন, কানে কানের দোলের বদলে এয়ার পড, হাতে ধরা সন্তানের হাতের বদলে শপিং ব্যাগ! দৃশ্যগুলো দেখলে মাঝেমাঝে মন বিগড়ে যায়। 

আমাদের মায়েরা, আমাদের মেয়েরা একটা সময় বই পড়তেন। সেকালে যেকোনো অবস্থাপন্ন বাড়িতে গেলে দু্টো, একটি বই পাওয়া যেতো। মুসলিম ঘরে বিষাদ সিন্ধু, কারবালা উপাখ্যান, হালাতুন্নবী ইত্যাদি বই পাওয়া যেতো। এখন সেই দৃশ্য যেন সুদূর অতীত। বইয়ের সাথে আমাদের দূরত্ব যেমন বাড়ছে তেমনি বিপরীতে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়, নানা অপরাধ, কিশোর গ্যাঙ-এর মতো নানাবিধ সমস্যা। যা একটি সুন্দর সমাজকে অন্দর থেকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। বই সে জায়গায় আমাদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে কাজ করে। বই মানুষকে জ্ঞানের সন্ধান দেয়। জ্ঞান দেয় মানুষকে সুচিন্তার খোড়াক। আর মানুষের সুচিন্তাই মানুষকে পরিণত করে একজন বন্ধুসুলভ মানুষে। একজন বন্ধুসুলভ মানুষ সমাজ এবং রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ। আমাদের সমাজে যা এখন ক্রমশ কমছে। এর থেকে উত্তোরণের জন্য বই পড়া আর জ্ঞান চর্চার বিকল্প নেই। 


লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী 

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়