শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১১:২৪, ৫ মার্চ ২০২৪
রবিবাবুর বৃটিশ প্রীতি অথবা শরৎ বাবুর দীর্ঘশ্বাস
রবিবাবুর বৃটিশ প্রীতি অথবা শরৎ বাবুর দীর্ঘশ্বাস
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ''পথের দাবী'' বইটি বের হওয়ার পর এই বই দেশবিরোধী অভিযোগ তোলে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯২৭ এর ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত গেজেটে পথের দাবী নিষিদ্ধ হয়। সুভাষচন্দ্র বসুও তৎকালীন আইনসভায় ''পথের দাবী'' বাজেয়াপ্তের যৌক্তিকতা নিয়ে কড়া মনোভাব প্রকাশ করেন। কিন্তু, তাতেও লাভ হলো না। ইংরেজ গভর্নমেন্ট শরৎ বাবুর বইটি বাজেয়াপ্ত করেই রাখল। কেননা, তাদের ধারণা ছিল বা তাদেরকে বোঝানো হয়েছিল শরতের এই বইটি পড়ে পাঠকমহলে ইংরেজ বিদ্বেষী মনোভাবের জন্ম নেয়।
ওদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তখন দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। ততোদিনে তিনি গভর্নমেন্টসহ অন্যান্যদের কাছে 'রবিবাবু' হয়ে ওঠেছেন। এখানে তৎকালীন ভারতীয় গভর্নমেন্ট সম্পর্কে এর আগে কিঞ্চিত ধারণা পাওয়া প্রয়োজন। তাহলে গোটা বিষয়টি বোধগম্য হতে পাঠকদের সুবিধা হবে। সেসময় ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে 'ভারতীয় সরকার' নামে একটি সরকার ছিলো বা গভর্নমেন্ট বলবত ছিল। কিন্তু, সেটি ছিল ইংরেজ আজ্ঞাবহ একটি সরকার। তৎকালীন সময়কার বইপুস্তক, পত্রিকাদি পাঠ করলে এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনার ব্যাপার আছে। ইংরেজ আজ্ঞাবহ ভারতীয় গভর্নমেন্ট গড়ে উঠলেও অনেক বিষয় আশয় পরিচালিত হত ইংল্যান্ড ভূমি হতে। এ নিয়ে 'ভারতীয় গভর্নমেন্ট এবং ইংরেজ গভর্নমেন্টের মাঝেমাঝে দর কষাকষিও হতো। সম্ভবত, এই দর কষাকষিরই একটি বিকৃত ফলাফল ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগ। সে যাইহোক, ইংরেজ আজ্ঞাবহ সেই 'ভারতীয় গভর্নমেন্ট' এর মূল চালিকাশক্তি ছিলেন সেসময়কার উঁচু বর্ণের হিন্দু সমাজপতিগণ। রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে আমাদের কবিগুরুও সেই দলের একজন। এ হিসেবে ইংরেজ ও ইংরেজ আজ্ঞাবহ ভারতীয় গভর্নমেন্টের সম্পর্কের একটা কাঠামো সম্পর্কে অনুমান করা যায়। তাছাড়া, এ বিষয়ে জানতে অতিআগ্রহী পাঠকদের আমি একটি উপায় বাতলে দিতে পারি। আপনারা বাংলাদেশের একজন নিভৃতচারী সমাজ দার্শনিক প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের Political Parties in India (ভারতীয় রাজনৈতিক দল) বইটি পড়তে পারেন। যদিও এটির বাংলা কপি বাজারে এসেছে কি-না এ বিষয়ে এই অধম শূন্য জ্ঞান। এ বই পাঠ করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা তৎকালীন সময়ে এই পর্যায়ের জমিদাররা কীভাবে সাধারণ নূনের ব্যবসায়ী থেকে জমিদার হয়ে গেলেন তাঁর একটা ঐতিহাসিক ধারাপাত জানা যাবে। যাহোক, এ নিয়ে লেখার পরিব্যাপ্তী বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই। এতে পাঠক মূল বিষয় থেকে সরে যেতে পারেন।
''পথের দাবী'' বইটি যখন গভর্নমেন্ট বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করলো, শরৎচন্দ্র মনে কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে ''পথের দাবী'' বইয়ের বাজেয়াপ্তের বিষয়টি নিয়ে রবিবাবুকে একটি পত্র লেখেন। মূলত, তিনি যেন ''পথের দাবী'' বইটির হয়ে একটি প্রতিবাদ লিখে দেন পত্রে সেই অনুরোধ এবং যৌক্তিকতা চিঠিতে তোলে ধরেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যাতে করে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে বৃটিশ গভর্নমেন্ট সাহিত্যের প্রতি কীরকম অবিচার চালাচ্ছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ''পথের দাবী'' বইটিও দেন। যেন তিনি পড়ে এর সারবস্তু বুঝতে পারেন। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ বাবুর পত্রের যে উত্তর পাঠিয়েছিলেন তা পড়ে হতাশই হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। এবং তাঁর ওই উত্তরেই আমার আজকের শিরোনামের যথার্থ উত্তর পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের বড় কবি হয়েও কতোখানি বৃটিশ রাজশক্তি ভক্ত ছিলেন! বা ওইসময় কেন যেন তিনি বৃটিশদের গুণকীর্তন করছিলেন। অবশ্য এই উত্তর পড়ে রবিবাবুর ব্যাপারে এহেন কথা বিশ্বাস করতেও বেগ পেতে হতে পারে বর্তমান পাঠককে। ভাগ্যিস, কথাগুলো রবিবাবু 'নিজ হস্তে করে দান' চিঠিতে লিখেছিলেন শরৎ বাবুর উদ্দেশ্যে।
আজকাল যেমন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ও বিপক্ষে দুইটি দল বর্তমান পূর্বেও তেমনিই ছিল। তবে তখনকার ব্যাপারটা ছিল আধুনিক সাহিত্যের প্রবর্তনকারী কবিদল আর রবিবাবুদের পক্ষ। এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের প্রকাশ পাওয়া যেত সেকালে প্রকাশিত বিচিত্রা, শনিবারের চিঠি, কল্লোল ইত্যাদি পত্রিকায়। আজকাল যেমন সরকার পক্ষের পত্রিকা সরকারের গান গায় বিপক্ষেরটা বিএনপির গান গায়। সেসময়ও তেমনি রবিবাবুর পক্ষের পত্রিকাগুলো রবিবাবুর গান গাইতো আধুনিকের কবিদের গান গাইতো তাঁদের পক্ষের পত্রিকাগুলো। আর সেসব পত্রিকায় পাওয়া যেত আমাদের বাংলা সাহিত্যের বাঘা বাঘা সাহিত্যিকদের মনোদ্বন্ধের নানাবিধ বহিঃপ্রকাশ। যা আমাদের আজকের শক্তিশালী সাহিত্য ভাণ্ডারকে করে তোলেছে আরও সমৃদ্ধ, আলাপযোগ্য, তর্ক সাপেক্ষ আর প্রশ্ন তোলবার মতো এক আদর্শ সাহিত্যিক ভূমি।
শরৎচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়ের পত্রের বিপরীতে সেদিন রবিবাবু যে পত্র পাঠিয়েছিলেন সেখানে তিনি লিখছেন- ''পৃথিবী ঘুরে ঘুরে দেখলাম ইংরাজ রাজশক্তির মতো সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল রাজশক্তি আর নেই। তোমার বই পড়লে পাঠকের মন ইংরাজ গভর্নমেন্টের প্রতি অপ্রসন্ন হইয়া ওঠে। তোমার বই চাপা দিয়া তোমাকে কিছু না বলা, তোমাকে প্রায় ক্ষমা করা। এই ক্ষমার উপরে নির্ভর করে গভর্নমেন্টকে যা তা নিন্দাবাদ করা সাহসের বিড়ম্বনা।''
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠির ভাষ্যটি কী তা কবিই যথেষ্ট খোলাসা করে লিখেছেন। তিনি তৎকালীন বৃটিশ রাজশক্তির মতো ক্ষমাশীল, সহিষ্ণু আর দেখেন নাই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কবি কোন্ সময় এই কথা বলছেন (বৃটিশদের মহত্ববাদ প্রচার করছেন)? যখন ভারতবর্ষের শত শত ছেলে ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মাতৃভূমির আজাদির জন্য দলে দলে লড়ছে, প্রাণ ঝরছে। আমি এটি বলছি না, রবিবাবু বৃটিশভক্ত বাঙ্গাল বিরোধী ছিলেন। আমি প্রশ্ন রাখতে চাইছি, যেই সময়ে দাঁড়িয়ে বৃটিশ রাজশক্তি তাঁর নিজ মাতৃভূমিকে শুষে খাচ্ছিল সেই সময়ে দাঁড়িয়েও তিনি শরৎ বাবুকে লেখা চিঠিতে বৃটিশদের গুণকীর্তন করছিলেন কেন? এর নেপথ্যের কারণটা হয়তো খুব পরিষ্কার আবার খুবই ঘোলাটে। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর একটি বইয়ে আকারে ইঙ্গিতে রবিবাবুর দুইটি সত্বার কথা বলতে চেয়েছেন। একটি সত্বায় যখন তিনি রচনা করছেন পদ্য, গীত, নাটিকা, সুর, চিত্রকর্ম তিনি তখন দেবাদিদেবের ন্যায়। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেকটি সত্বাও রয়েছে। যা আমাদের পাঠকদের কাছে অপরিচিত ঠেকতে পারে, অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। গুজব মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কেননা, এই সত্বায় রবিবাবু অতি সাধারণ জাগতিক বিষয়ে লিপ্ত থাকা একজন মানুষ। আমার সরল বিশ্বাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লেখা পত্রে প্রদর্শিত ''ইংরাজ ভক্তি'' রবিবাবুর দ্বিতীয় সত্বাটির একটি বাহ্যিক প্রকাশ। যেখানে তিনি হয়তো একজন বৃটিশ আজ্ঞাবহ ভারতীয় জমিদার। ঔপেনিবেশিক বৃটিশ রাজশক্তি তাঁর কাছে সবচেয়ে সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল!
আমার লেখা পড়তে পড়তে এই জায়গাটিতে এসে রবিভক্ত পাঠককূল প্রশ্ন তোলতে পারেন, তবে যে কবি নাইটহুট পদক পরিত্যাগ করেছিলেন? এর কি কোনো কারণ নেই? মহত্ব নেই? অবশ্যই মহত্ব আছে। কিন্তু, সেই মহত্বটিও যে তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যর্থ কালের সঙ্গে সম্পর্কিত সে খবর আমাদের এ দেশের কয়জন পাঠক রাখেন? খুব কম লোকই সে খবর রাখেন বলেই হয়তো সাহিত্যের কাঠগড়ায় রবিবাবুকে দাঁড় করালে তাঁরা নাইট হুড পরিত্যাগের বিষয়টি টেনে আনেন। অথচ, সাহিত্যিক প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ পাওয়া উপাধি বলে প্রচারিত এই নাইট হুড উপাধির প্রশংসা পত্রে যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে একটি শব্দও লিখা নেই। বরং, নাইট হুড উপাধিটি যে কবিগুরুর অনেকখানি ইংরেজ কর্মকর্তার সাথে সম্পর্কের সখ্যতার জের ধরে পাওয়া এ বিষয়ে এদিককার কারো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না।
অনেকে আরেকটি প্রশ্নও করতে পারেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্র চালাচালিতে এতোসব করে ফেললেন আর কেউ জানল না? এতোদিন পরে এসে কেন এই গাঁজাখুরি আলাপন? আসলে ব্যাপারটি ততোখানিও সরল নয় যতোখানি আমরা ভাবছি। এর জের ধরে শরৎচন্দ্র পরবর্তীতে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধও লিখেছেন। ''সাহিত্যের রীতিনীতি ও দুর্নীতি'' নামে যেটি এখন বাজারে পাওয়া যায়। আমার বিশ্বাস আমার মতো অনেক নব্য কবিই এই বই পড়তে নারাজি, অনাগ্রহী। কিন্তু, এটি 'কেহ না পড়িলেও মূল্যবান' টাইপ। ওই প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র রবিবাবুকে নিয়ে বেশকিছু কড়া লেখা লিখেছেন। অবশ্য, এগুলোকে সাহিত্যিক বিচারে কড়া লেখা না বলে প্রবন্ধের জবাবে প্রবন্ধ বললে সুন্দর দেখায়।
শরৎচন্দ্র যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পছন্দ করতেন না বা তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাশীল ছিলেন বিষয়টি তেমন নয়। আমাদের মাথায় রাখতে হবে এ দুই গুণী জন সাহিত্যিক ক্ষেত্রে একে অন্যে দুইটি পক্ষ হয়ে গেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধের তর্কের অবতারণা করেছেন। এখানে আমাদের হা-পিত্যেস করে মরবার কিছু নেই। বরং, আছে পান করার মতো অমিয় কিছু। পাঠককূলকে মনে করিয়ে দিতে চাই আমরা শুধু সেই অমিয় সুধাটি পান করবো। এ দুই বড় সাহিত্যিককে আমাদের মতো নগণ্যের বিচারের মাপকাঠিতে ফেলব না। সমালোচনা করার হলে করবো কিন্তু, কোনও সিদ্ধান্ত টানব না। সিদ্ধান্ত টেনে দেবে সময়। যে সময় পরিবর্তন এনেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বাসে, ভাবনায়ও। সময়ের ঘর্ষণে সকলকিছুই তো পরিবর্তনশীল। যাহোক, মেদের কথা বাদ দিয়ে বেদের কথায় আসি।
শরৎচন্দ্র ''সাহিত্যের রীতিনীতি'' নামের প্রবন্ধটিতে বেশকিছু গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখেছেন। যা থেকে আঁচ করা যায় সেসময় কবিগুরুর সঙ্গে আধুনিক কবিতা লেখা শুরু করা কবিদের, সাহিত্যিকদের একটা নড়বড়ে সম্পর্ক ছিল। রবিবাবু আধুনিক সাহিত্য শুরুতে হয়তো গ্রহণ করতে দ্বিধায় ভোগছিলেন। তিনি আধুনিক সাহিত্যের অতবেশি মুক্ত প্রাঙ্গণে মানিয়ে নিতে হয়তো পারছিলেন না; হয়তো তিনি ধরে নিয়েছিলেন সৃজনশীল এ কর্মটি আধ্যাত্মিক যোগের সাথে সম্পৃক্ত সাহিত্যের আধুনিকতা যাকে অপবিত্র করছে (যদিও পরবর্তীতে কবি নিজেও আধুনিক কাব্যের দিকে ঝুঁকেছিলেন বলে শোনা যায়)। অন্যদিকে ''সাহিত্যের রীতিনীতি'' প্রবন্ধে শরৎচন্দ্রের আধুনিক সাহিত্যের প্রতি ঝোঁকের ছাপ স্পষ্ট। সহজেই বোঝে নেওয়া যায় এঁরা কোন্ দুই পক্ষ। সমস্যা হচ্ছে, তৎকালীন সাহিত্যিক এমনকি বৃহৎ নাগরিক সমাজ্ রাজনৈতিক মহলে কবিগুরুর গ্রহণযোগ্যতা, খ্যাতি, প্রতিপত্তি ছিল প্রভাবশালী। কংগ্রেসের দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সাথে তাঁর একান্ত সম্পর্ক ছিল। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গেও কবির সম্পর্ক ছিল মজবুত। তাই তাঁর অপছন্দ মানে একটা বিরাট সমাজের অপছন্দ যে হবে সেটা শিশুও বোঝে। কিন্তু, শরৎচন্দ্ররা এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। একটা সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর দীর্ঘদিনের সহচরদের অনেকের প্রতি বিস্মিত হয়েছিলেন। জালয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কবির অতীত চিন্তায় চ্ছেদ ঘটিয়েছিল। শরৎচন্দ্রই তাঁর লেখায় বলছেন, বাংলা সাহিত্যে আধুনিক হাওয়া যে লাগছে এবং তার যে ধীরে ধীরে পরিসর বড় হচ্ছে তাঁর আভাস রবিবাবুও পেয়েছিলেন। খোদ শান্তিনিকেতন থেকেই সেই আভাস পেয়েছিলেন কবি। কিন্তু, কবি আধুনিক সাহিত্যকে যেই যুক্তিতে একপেশে করে রাখছিলেন সেই যুক্তিগুলো ছিল খুবই পলকা। আজকের দিনে মুসলমান সমাজ যেমন চুমোচুমি, বোরকা-হিজাব নিয়ে বিভিন্ন সময় আপত্তি-অনাপত্তি তোলে অনেকটা সেরকম। রবীন্দ্রনাথের যুক্তি ছিল অনেকটা এরকম আধুনিক সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের পবিত্রতা নষ্ট করছে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আধুনিক ধারায় সাহিত্য রচনায় অবাধ যৌনতা থাকবে যা মেনে নেওয়া অসম্ভব। বিপরীতে আধুনিক কবিদের ভাষ্য ছিল কেউ সাহিত্যের নামে কামশাস্ত্র প্রচার করুক সে তাঁরাও চান না। কিন্তু, যৌক্তিক ব্যাপারকে এড়িয়ে শুধু অযৌক্তিকতা আর কল্পনার মিশেলে সাহিত্য গড়ে উঠুক এটাও তাঁরা চান না। তাঁরা চান না শুধুই কল্পনাপ্রসূত বাক্যে, ফুল, পাখি আর নারীর সারল্যের বর্ণনা দিয়ে তৈরি হবে বাংলা সাহিত্যের শরীর। তাঁরা চাইছিলেন বিজ্ঞান, যুক্তির, এবং কল্পনার মিশ্রিত এক স্পর্শ ছোঁয়াতে। কিন্তু, এখানেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিকদের বিরোধী। শরৎচন্দ্র লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞান বিমুখ ছিলেন। হয়তো এটাও একটা কারণ যে তিনি সবসময় শাস্ত্রমুখী ছিলেন। তিনি সকলকিছুকে আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পছন্দ করতেন। যদিও রবিবাবুও শেষ পর্যন্ত তা থাকতে পেরেছিলেন কি-না যা তিনি লোকসম্মুখে প্রদর্শন করতেন এটিও তর্কসাপেক্। এখানে আবারও বুদ্ধদেব গূহের সেই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। রবীন্দ্রনাথের দুইটি সত্বা। একটিতে তিনি দেবাদিদেব তুল্য। আর অন্যটিতে আমাদেরই মতো ক্ষুদ্র জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একজন মানুষ মাত্র!
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবিবাবুর মতের অমিলের কেন্দ্রে যা আছে তা অনেকটা এরকম- শরৎচন্দ্র বলছেন, ''উপস্থিত কালটাও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এবং তার দাবি মানবো না বললে কালও শাস্তি দেয়।'' কিন্তু, রবিবাবু তা মানতে ছিলেন নারাজ। কেননা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎচন্দ্রকে বলছেন, ''তুমি যদি উপস্থিত কালের দাবি ও ভীড়ের লোকের অভিরুচিতে না ভুলিতে পারো তাহলে তোমার এই শক্তি বাধা পাবে।'' শরৎ বাবু রবিবাবুকে একটি জিনিস বুঝাতে চেয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে, ছবির PERSPECTIVE এবং সাহিত্যের PERSPECTIVE কথার দিক দিয়ে একরকম লাগলেও কাজের দিক দিয়ে দুই রকম। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের সেই ডাকে সাড়া দেননি বলেই আমার বিশ্বাস।
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়, কবিগুরুর দেশভক্তির প্রতি প্রশ্ন তোলা কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে রবির চাইতে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণ করা। লেখার উদ্দেশ্যটি সরল। সাহিত্যিক পর্যালোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তৎকালীন আধুনিক সাহিত্যের সাথে সংশ্লিষ্টদের মতবিরোধ সম্পর্কে অবগত হওয়া। কেউ তাঁর একই বিশ্বাস সারাজীবন একইভাবে বয়ে বেড়াতে পারে না। কট্টরপন্থী ধার্মিকের ধর্মবিশ্বাসও সময়ের আবর্তে পড়ে পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তন আসে মানুষের চিন্তায়, মননে, চর্চায়, সাধনায়ও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একদিকে যেমন এক সময় ইংরাজ রাজশক্তিকে সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল মনে হতো। অন্যদিকে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের পর কবির মনে ইংরাজ রাজশক্তি নিয়ে ভাবনার পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে তৎকালীন কংগ্রেস নিয়েও। এই পরিবর্তনশীলতাই আমাদেরকে উৎকর্ষতার দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু, যেই সময়ে আমরা এই ঘটনাচক্রে জড়িয়ে যাই সেসময় যেকোনো একটি পক্ষে পরে যেতে হয়। যেমন পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-রামমোহনরা।
আজকাল যেমন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ও বিপক্ষে দুইটি দল বর্তমান পূর্বেও তেমনিই ছিল। তবে তখনকার ব্যাপারটা ছিল আধুনিক সাহিত্যের প্রবর্তনকারী কবিদল আর রবিবাবুদের পক্ষ। এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের প্রকাশ পাওয়া যেত সেকালে প্রকাশিত বিচিত্রা, শনিবারের চিঠি, কল্লোল ইত্যাদি পত্রিকায়। আজকাল যেমন সরকার পক্ষের পত্রিকা সরকারের গান গায় বিপক্ষেরটা বিএনপির গান গায়। সেসময়ও তেমনি রবিবাবুর পক্ষের পত্রিকাগুলো রবিবাবুর গান গাইতো আধুনিকের কবিদের গান গাইতো তাঁদের পক্ষের পত্রিকাগুলো। আর সেসব পত্রিকায় পাওয়া যেত আমাদের বাংলা সাহিত্যের বাঘা বাঘা সাহিত্যিকদের মনোদ্বন্ধের নানাবিধ বহিঃপ্রকাশ। যা আমাদের আজকের শক্তিশালী সাহিত্য ভাণ্ডারকে করে তোলেছে আরও সমৃদ্ধ, আলাপযোগ্য, তর্ক সাপেক্ষ আর প্রশ্ন তোলবার মতো এক আদর্শ সাহিত্যিক ভূমি।
- তথ্যসূত্র: প্রবন্ধ- সাহিত্যের রীতিনীতি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- উপন্যাস- হাজারদুয়ারী, বুদ্ধদেব গুহ
- প্রবন্ধ- রবীন্দ্রনাথ ও নাইটহুড; প্রাপ্তি-পরিত্যাগ-প্রতিক্রিয়া, অত্রি গোলুই (ইতিহাস তথ্য ও তর্ক)
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা