শ্যামলাল গোসাঁই
অন্যরকম কেউ | দরকারি প্রবন্ধ
পোস্টার- আই নিউজ
১.
বেশিরভাগ মানুষের সমস্যা হচ্ছে তারা ‘অন্যরকম’ বা ‘ভিন্নরকম’ কিছুকে ভয় পান; তারা গড় মানুষ হয়ে বাঁচতেই বেশি স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। ফলে ‘অন্যরকম’ কিছু, ‘ভিন্নরকম’ কিছু হতে তাঁরা ভয় পান। ভয় পান ‘অন্যরকম’ কাউকে দেখলে, যিনি তার থেকে ভিন্ন। মানুষ কখনো আশা করে না, কেউ তাঁর চাইতে ভিন্ন হোক। বরং, বেশিরভাগ মানুষই আশা করেন সবকিছু, অন্যরা তার নিজের মতো হবে।
আপনি যদি পৃথিবীর সবচাইতে আলোচ্য মানুষদের জীবনী দেখেন, আবিষ্কার করবেন তাঁরা সবাই তাঁদের সময়ের গড় মানুষদের চেয়ে ‘অন্যরকম’ ছিলেন। গৌতম যখন তাঁর চিন্তা-ভাবনার প্রচার করছিলেন তখন ভারতবর্ষ সনাতন ধর্মালম্বীদের দ্বারা আচ্ছ্বাদিত ছিল। গৌতম সে সমাজের কাছে ছিলেন একেবারে ‘ভিন্নরকম’ নতুন একজন। তবু, গৌতমকে অনেকেই তখন গ্রহণ করেছিলেন। মুহাম্মদ যে সময়ে জন্মেছিলেন আরব সমাজ তখন পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। মুহাম্মদ যখন তাঁদের ‘অন্যরকম’ কথা শোনাতে লাগলেন সৃষ্টি ও স্রষ্টা নিয়ে তাকে পাগল উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কারণ, মুহাম্মদ সেই সময় গড় মানুষদের চাইতে ভিন্ন কিছু শোনাচ্ছিলেন মক্কাবাসীকে। একসময় মুহাম্মদের ধর্মই ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বময়। সক্রেটিসের করুণ মৃত্যুর ঘটনাটি এখনো বহুল চর্চিত হয়। কেন মরতে হয়েছিল সক্রেটিসকে? কেননা, সক্রেটিস ছিলেন সেই সমাজের গড় মানুষদের চেয়ে ‘ভিন্নরকম’ কেউ। তিনি এমন বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যা সমাগজের গড় মানুষের ক্ষেত্রে ছিল বিশ্বাসবিরোধী। তিনি শোনাচ্ছিলেন সূর্য এবং পৃথিবীর ঘূর্ণন নিয়ে একেবারে ‘অন্যরকম’ নতুন তথ্য। সেই সমাজের গড় ধার্মিকেরা তা মেনে নেন নি। উপরন্তু, সক্রেটিসকে ‘ভিন্নরকম’ কেউ হবার দরুণ নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেখ মুজিবুর রহমান, মহাত্মা গান্ধী, ক্ষুদিরাম, লীলানাগ এরকম হাজার হাজার মানুষ আছেন যারা ‘অন্যরকম’ ছিলেন আমাদের থেকে। তাঁরা আমাদের গড় মানুষদের মতো ছিলেন না। ‘অন্যরকম’ হতে পারেন না তাঁরাই, যারা গড় মানুষ হয়ে বাঁচতে চান গোটা জীবন। যারা জীবনে বৈচিত্র্যপূর্ন অভিজ্ঞতা লাভের সাহস দেখাতে অপারগ। নির্দিষ্ট একটি ছাঁচের মধ্যে ফেলেই জীবনকে দেখতে পছন্দ করেন তাঁরা। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা তাদের নেই। তাঁরা নতুন কিছু দেখলে চমকে উঠেন না। বরং বিরক্ত হন। কেননা, তিনি ‘অন্যরকম’ প্রত্যাশা করতে জানেন না। ‘অন্যরকম’ গ্রহণ করতেও নারাজ।
আপনি বিশ্বময় তাকালে একই দৃশ্য দেখতে পাবেন। অর্থাৎ, সমাজের গড় মানুষরা অন্যরকম কিছুকে স্বীকৃতি দিতে অপরাগ। তারা চায় তাদের মতোই হবে অন্য সব। কিন্তু, গড় মানুষের স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির তোয়াক্কা না করে যিনি বা যারা তাদের জীবন যাপন করেন সত্যনিষ্ঠার সাথে, কল্যানব্রতে তিনিই অন্যরকম হয়ে ওঠেন, অসাধারণ হয়ে ওঠেন। ইতিহাস বলে, এই অন্যরকম, ভিন্নরকম, অসাধারণরা চলমান সমাজে নিগৃহীত হলেও ভবিষ্যতের সময় তাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। পাগল উপাধি পাওয়া মুহাম্মদ আজ বিশ্ব মুসলিমের আবেগের এক অপর নাম, গৌতম আজ কোটি কোটি যুবকের ধ্যান, সক্রেটিসের করুণ মৃত্যু আজও যুক্তিবাদী, অনুসন্ধিৎসু তরুণদের প্রেরণা, যিশুর আত্মত্যাগ (মৃত্যু) আজ খ্রিস্ট ধর্মালম্বীদের কাছে কল্যাণের কারণ হিসেবে পূজিত। এরা সকলেই তাদের সময়ে ‘অন্যরকম’ ছিলেন। এবং ‘অন্যরকম’ কেউ হবার কারণে সামাজিক, রাজনৈতিক নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন।
২.
‘অন্যরকম’ বা ‘ভিন্নরকম’ কেউ বলতে আসলে কী বুঝাচ্ছি? আমি ‘ভিন্নরকম’ বলতে তাদেরকেই বোঝাচ্ছি যারা আপনার আমার চেয়ে অন্যভাবে চিন্তা করেন, ভাবেন, চলাফেরা করেন। যারা আমাদের মতো ভাবতে পারেন না এবং আমাদের ভাবনা যাদের মেলে না। যার সাথে আমার সাদৃশ নেই সেই আমার কাছে ‘অন্যরকম’ কেউ বা ‘ভিন্নরকম’ কেউ। অর্থাৎ, যার সাথে আমার মেলে না সেই ‘অন্যরকম’ কেউ। যেমন সব বাংলাদেশীকে আমরা এক জাতি বলি। কারণ, তাঁরা আমাদের চেয়ে অন্যরকম। তাদের আচার ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্নরকম। তাই আফ্রিকানদের বলি ‘অন্যজাতি’। তেমনি ব্যক্তিজীবনেও আমরা নানা ধরনের ‘অন্যরকম’ মানুষদের সাথে পরিচিত হই। যিনি আমাদের মতো না। যার কাজ অন্যরকম, বিশ্বাস অন্যরকম, চিন্তা অন্যরকম, ধর্ম, দর্শন অন্যরকম। ভিন্ন রকম তাঁর প্রার্থনার ধরন, আনন্দের বহিঃপ্রকাশ কান্নার ধরন।
অন্যদের চাইতে ভিন্নরকম বা অন্যরকম হওয়া দোষের কিছু নয় কিংবা রোগও নয়। আমার বিশ্বাস, বরং, অন্যরকম বা ভিন্নরকম হওয়া মানে গড় শ্রেণীর চাইতে একটু বেশিই সম্ভাবনাময়তা লাভ। কিন্তু, আমাদের দেশে অন্যরকম বা ভিন্নরকম কিছু পাওয়া গেলে সেটাকে এমনভাবে চিহ্নিত করা হয়, যেন সেটা অপরাধের কিছু, দোষের কিছু কিংবা ডাক্তারি ভাষায় রোগী। ফলে, অন্যরকম হবার চাইতে ভিন্নরকম হওয়া নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন বেশিরভাগ তরুণ। অথচ, ইতিহাসে অন্যরকম মানুষদের বিশ্বের ইতিহাসে কিংবদন্তী হয়ে ওঠার ভুরিভুরি প্রমাণ রয়েছে।
পৃথিবীতে যারা ‘অন্যরকম’ কিন্তবদন্তী রয়েছেন, তাদের আবিষ্কারে, অবদানে উপকৃত হচ্ছে যারা ‘অন্যরকম’ নয়, গড় মানুষ। যেমন আইনস্টাইন ‘অন্যরকম’ কেউ ছিলেন। কিন্তু, তাঁর আবিষ্কার শুধুই তাঁর মতো ‘অন্যরকম’দের জন্য নয়, বা তাঁর আবিষ্কারের সুবিধা শুধুই ‘অন্যরকম’ মানুষরা পাচ্ছেন না। পাচ্ছে উন্নত বিশ্বের সকলেই। যিনি বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে অন্যদের চেয়ে অন্যরকম ছিলেন। কিন্তু, তাঁর অবদানে আজ উপকৃত গোটা বিশ্ববাসী। এভাবে ধারাবাহিকভাবে তালিকা তৈরি করলে দেখা যাবে- পৃথিবীতে আমরা যেসব আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, আবিষ্কার, দর্শন, ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করছি, উপকার ভোগ করছি, সুযোগ গ্রহণ করছি এসব এসেছে গুটিকতক ‘অন্যরকম’ মানুষদের দ্বারা। গড় মানুষ শুধু শুধু উপকার ভোগ করছেন। অর্থাৎ, এরা শুধু উপকারভোগী।
ভাবছেন, এতোকিছুর পরও মানুষ কেন ‘অন্যরকম’ কেউ হতে যথেষ্ট সাহস জোগাতে পারে না? সকলেই যে সাহস জোগাতে পারেন না তা নয়। কেউ কেউ নিজের বিবেক-বুদ্ধি, প্রজ্ঞার প্রয়োগে ‘অন্যরকম’ হয়ে ওঠতে পারেন। কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেখ মুজিবুর রহমান, মহাত্মা গান্ধী, ক্ষুদিরাম, লীলানাগ এরকম হাজার হাজার মানুষ আছেন যারা ‘অন্যরকম’ ছিলেন আমাদের থেকে। তাঁরা আমাদের গড় মানুষদের মতো ছিলেন না। ‘অন্যরকম’ হতে পারেন না তাঁরাই, যারা গড় মানুষ হয়ে বাঁচতে চান গোটা জীবন। যারা জীবনে বৈচিত্র্যপূর্ন অভিজ্ঞতা লাভের সাহস দেখাতে অপারগ। নির্দিষ্ট একটি ছাঁচের মধ্যে ফেলেই জীবনকে দেখতে পছন্দ করেন তাঁরা। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা তাদের নেই। তাঁরা নতুন কিছু দেখলে চমকে উঠেন না। বরং বিরক্ত হন। কেননা, তিনি ‘অন্যরকম’ প্রত্যাশা করতে জানেন না। ‘অন্যরকম’ গ্রহণ করতেও নারাজ।
আমাদের দেশে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের অটিস্টিক বলা হয় আমরা জানি। এটাও সরলমনে স্বীকার্য যে, এদেশে অটিস্টিক একটা 'গালি'তে রূপ নিয়েছে। অনেককেই দেখা যায়, অপর কাউকে 'অটিস্টিক' বলে গালি দিচ্ছেন। অর্থাৎ, অটিস্টিক মানে অন্যরকম কিছু এবং সেটা ভালো কিছু নয় বরং দোষের বা অপূর্ণতা এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয় এ ধরনের গালিতে। এতে করে, শুরুতেই অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির সম্ভাবনা বাতিল করে দেওয়ার মতো একটা বিষয় চলে আসে। যা ঠিক নয়। এ দেশে ধরেই নেওয়া হয় অটিজমে আক্রান্ত শিশু মানেই পরিবারের জন্য এক অতিরিক্ত ভোজা, সমাজের জন্য একটা অকাজের ঢেঁকি। বিষয়গুলো পড়তে খারাপ লাগলেও এদেশে অটিজমে আক্রান্তদের নিয়ে গড় মানুষের এহেন ভাবনাই আমরা চারপাশে দেখতে পাই। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে পরিবারে একটি অটিজমে আক্রান্ত শিশু জন্ম নেয় সেই পরিবারের মানুষকেই নাখোশ হতে দেখা যায়। একটু শক্ত হয়ে বললে, অনেক অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবারের কাছেই নিগ্রহের শিকার হন, এমনও দেখেছি দু-এক জায়গায়। যেটি দৃষ্টিকটু তো বটেই, অনুচিতও।
হয়তো জানি না, আমরা সকলেই এমনসব বিখ্যাতদের জানি যারা অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন বলে জানা যায়। এদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিত্ব আমাদের সুপরিচত। আইজাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইনকে আজকের দুনিয়ায় শিক্ষিতদের কে না চেনেন? কিন্তু, খুব কম লোকই জানেন যে, এদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটু আধটু অটিজমের লক্ষণ ছিল। আইনস্টাইন তাঁর স্কুলজীবনে খুব ভাল করে কথা বলতে পারেন না এ কথা ক’জন জানেন? কিন্তু, আইনস্টাইন পরবর্তীতে বিজ্ঞান জগতের মহীরুহে পরিণত হয়েছিলেন। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের শরীরের আকার জন্মের সময় স্বাভাবিক একটি শিশুর তুলনায় অনেক ছোট ছিল। তাঁর মা নাকি প্রায়শই বলতেন, ''ছোট্টবেলার সেই নিউটনকে অনায়াসে একটি কোয়ার্ট মগের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া যেত।'' এরকম অজস্র বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন যারা অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন। বাংলাদেশের মতো দেশে জন্ম নিলে নিউটনের আপেক্ষিত তত্ত্ব আজকের দুনিয়ায় চর্চিত হতো কি না সন্দেহ। আইনস্টাইন এদেশে জন্ম নিলে হয়তো ভালোভাবে কথা বলতে না পারার কারণে এতো দিনে তাঁর কোনো একটা ট্যাগনাম জুটে যেতো। যেটা হতো গালিসূচক।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা