শ্যামলাল গোসাঁই
বার্ট্রান্ড রাসেল : দর্শন বিদ্যার আধুনিক প্রতিমূর্তি
''...বিচ্ছিন্ন হও, উপেক্ষিত হও, আক্রান্ত হও, সন্দেহে থাকো, ভীত হও, কিন্তু নীরব হয়ো না।''
কথাটি লিখেছিলেন ব্রিটিশ দার্শনিক, গণিতবিদ ও বুদ্ধিজীবী বার্ট্রান্ড রাসেল। গতকাল মানে, ১৮ মে ভদ্রলোকের জন্মদিন ছিল। বাঙালী বার্ট্রান্ড রাসেলের নাম শুনেছে, কিন্তু পড়েছে খুব অল্প। যারা পড়েছে তারা বিস্মিত হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেলের কোনো বই পড়ে কেউ যদি বলে— এ বইয়ে আমি শেখার মতো কিছু পাইনি; বুঝতে হবে সেই পাঠক এখনো পাঠক হয়ে ওঠেননি। তিনি সেই শিশুদের মতোই আছেন যারা বইয়ের শব্দবদ্ধ বাক্যগুলো রিডিং পড়তে পারে কিন্তু, লেখার সারমর্ম কোনোকিছুই বুঝে না। তারা শুধু প্রেম এবং যৌনতার অংশ যখন পড়ে তখন খানিকটা উত্তেজনা বোধ করে।
বার্ট্রান্ড রাসেল আধুনিক দর্শনের হালহকিকত বদলে দেনেওয়ালাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মনে করতেন দুই যোগ দুই সমান চার হয় এটা বিশ্বাস করার চেয়ে কীভাবে দুই যোগ দুই চার হয় সেটা জানা জরুরি। নিজের যুক্তিবাদী মনের উচাটন থেকে রাসেল দুই যোগ দুই চার হয় এটি প্রমাণ করতে প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠা লিখেছিলেন বলে শোনা যায়। কেউ কেউ আরও বেশি পৃষ্ঠা দাবি করেন।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হয়েও সমাজ ও দর্শন পাঠেই তাদের সবচেয়ে বেশি উদাসীনতা। নিজেদের সম্পর্কে এরা জানতে যেন ভয় পায়। এর কারণ, নিজের মতাদর্শ, চিন্তা, চেতনা ভুল হতে পারে এই আশঙ্কায় থাকা। এর চেয়ে তারা ভুল নিয়েই সারাজীবন কাটাতে রাজি। অথচ, একটি দক্ষতাপূর্ণ ও সাফল্যের জীবন কাটানোর পূর্বশর্তই হচ্ছে ভুল শিকার করে তা শোধরানোর দিকে এগিয়ে যাওয়া। দর্শন পাঠে, মানুষের সামাজিক, আত্মিক, দার্শনিক ভুল ভাঙার সুযোগ থাকে। সুযোগ থাকে ভুল শোধরানোর। বাঙালী তাদের এসব ভুল ভাঙতে চায় না বলেই মনে হয়।
শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে রাসেল বেশ চিন্তিত ছিলেন। তাঁর শিক্ষা ও সমাজ কাঠামো এদেশের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য একটি বই। যেখানে প্রকৃত শিক্ষার রূপ কেমন হবে, শিক্ষকের ভূমিকা, শিক্ষাক্ষেত্রে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা, শিক্ষায় রাজনীতি থাকা না থাকার ফল-কুফল, সমাজের অংশগ্রহণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন বার্ট্রান্ড রাসেল। রাসেল হেন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে লেখার চেষ্টা করেননি। শুধু লেখার ছলে লিখেই ক্ষান্ত হননি, এই লেখাগুলোই পরবর্তীতে বদলে দিয়েছে ইউরোপীয় অনেক চিন্তাধারার বাঁকবদল, সিস্টেম।
ইউরোপীয়রা বার্ট্রান্ড রাসেলকে পড়েছে, ফলে তারা চিন্তাগত দিক থেকেও রাসেল মারফতে একটি অন্যরকম উচ্চতার সন্ধান পেয়েছে। যেই সন্ধান পেতে পারি আমরাও। কিন্তু, এদেশের সমস্যা হচ্ছে এখানে ভাইরাল বই বেস্ট সেলিং বইয়ের তালিকায় থাকে; সস্তা প্রেমের গালগপ্প, ছড়া-কবিতার বই এখানে হুরহুর করে বিক্রি হয়। কিন্তু, দর্শনের পাঠক পাওয়া যায় না। যারা পড়েন খুবই অল্প। অথচ, শিক্ষক-স্নাতক শিক্ষার্থীদের কেনা বইয়ের তালিকায় দুই চারটে দর্শনের বই থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অবশ্যই উচিৎ বার্ট্রান্ড রাসেল, ফ্রিডরিখ নিৎশে, জঁ-পল সার্ত্র্, সিমন দ্য বোভোয়ার, লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন, কাফকা, এদেশের আহমদ ছফা, সরদার ফজলুল করিম, হুমায়ুন আজাদ, সাদ উল্লাহ প্রমুখদের বই পড়া।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হয়েও সমাজ ও দর্শন পাঠেই তাদের সবচেয়ে বেশি উদাসীনতা। নিজেদের সম্পর্কে এরা জানতে যেন ভয় পায়। এর কারণ, নিজের মতাদর্শ, চিন্তা, চেতনা ভুল হতে পারে এই আশঙ্কায় থাকা। এর চেয়ে তারা ভুল নিয়েই সারাজীবন কাটাতে রাজি। অথচ, একটি দক্ষতাপূর্ণ ও সাফল্যের জীবন কাটানোর পূর্বশর্তই হচ্ছে ভুল শিকার করে তা শোধরানোর দিকে এগিয়ে যাওয়া। দর্শন পাঠে, মানুষের সামাজিক, আত্মিক, দার্শনিক ভুল ভাঙার সুযোগ থাকে। সুযোগ থাকে ভুল শোধরানোর। বাঙালী তাদের এসব ভুল ভাঙতে চায় না বলেই মনে হয়। এজন্য এরা বইয়ের বাজারে গেলেও কিনে নিয়ে আসে ভুলে ভরা প্রেম আর জীবনের গালগপ্পের বই। এসব পড়তে পড়তে এমন অবস্থা হয়েছে- অনেকে আজকাল বই কিনতে গিয়ে ভালো বই বাছাই করতে পারেন না। বাজারে যা খুব চলছে সেটাকেই ভালো বই মনে করে ঘরে তোলে আনছেন। বাজারে সাদাত হোসাইনের বই এখন খুব জনপ্রিয়। কিন্তু, লেখক হিসেবে তার স্থান বার্ট্রান্ড রাসেল বা মহিউদ্দিন মোহাম্মদের চেয়ে অনেক অনেক নিচে। এই বিষয়টি একজন ভালো পাঠককে বোঝা দরকার।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা