সাইফুর রহমান তুহিন
আপডেট: ১৩:১৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বাংলা সাহিত্য
শক্তিমান এক কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই।
বাংলাদেশের ছোটগল্প ও ভ্রমণ সাহিত্যে হাসনাত আবদুল হাই একটি সুপরিচিত নাম। ছোটগল্পের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকে। তার লেখা উপন্যাস ‘সুলতান’ ১৯৯৭ সালে আয়ারল্যান্ডের ‘ইমপ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড’-এর জন্য মনোনীত হয়েছিলো।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের কোনো রচনা ছাড়া সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক রোববার, সাপ্তাহিক পূর্ণিমা প্রভৃতির ঈদ সংখ্যা কল্পনাই করা যেতো না। আর কয়েকদিন পরই ছিয়াশি বছরে পা দেবেন তিনি । তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে এই লেখায়।
সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা হওয়াটা যে সৃষ্টিশীল লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধক হতে পারে না তা বিভিন্ন সময়ে বার বার প্রমাণিত হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, প্রসব বেদনায় ছটফট করতে থাকা একজন নারী সন্তান জন্মের পর যেমন তৃপ্তি লাভ করেন ঠিক তেমনি অনুভূতি একজন লেখক কিংবা লেখিকার হয় যখন তিনি নতুন কোনো সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেন। তার জন্য এটি আত্মার প্রশান্তি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার ও সুরকাররা পাঠকের জন্য উপভোগ্য কিছু সৃষ্টির নেশায় গভীর সাধনায় মগ্ন থাকেন।
ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ লেখক হাসনাত আবদুল হাই গত ১৯ মে তার সাতাশিতম জন্মদিন পালন করেছেন। খাদ্যে ভেজাল, বায়ু ও পরিবেশ দূষণ, ট্রাফিক জ্যাম এবং নানা সমস্যায় জর্জরিত এই দেশে আশি বছরের অধিককাল বেঁচে থাকাটা অনেক বড় ব্যাপার। আশি বছর বেঁচেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। এই দীর্ঘ জীবনে নিজের বহুমাত্রিক কাজের দ্বারা কবিগুরু সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গান, নাটক, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণবিষয়ক লেখা, স্মৃতিকথা প্রভৃতি তাকে অমরত্ব দিয়েছে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার বহুমুখী প্রতিভা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধি তার সৃষ্টিশীল কর্মজীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছিলো। সাহিত্যের আরেক দিকপাল নীরোদ সি. চৌধুরী বেঁচেছিলেন একশো এক বছর। পঞ্চাশ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা চালিয়ে গেছেন তিনি। খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশংকর রায়, সুকুমার সেন, বাট্রান্ড রাসেল, জর্জ বার্নার্ড শ’ ও খুশবন্ত সিং নব্বই বছরেরও বেশি বেঁচেছিলেন। তাদের লেখা বই দেশে দেশে সমাদৃত হয়েছে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইএসএস)-র সদস্য হওয়াটা
অন্নদাশংকর রায়ের স্বাধীন লেখালেখিতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
কিন্তু, দুঃখজনকভাবে জন কীটস, পিবি শেলী, লর্ড বায়রন, অস্কার ওয়াইল্ড, আন্তন চেখভ, মাণিক বন্দোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, ডিএল রায়, জীবনানন্দ দাস, আদ্বৈত মল্লবর্মণ, ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া, ফ্রানৎস কাফকা, আলবার্ট কামুস প্রমুখ বেশিদিন বাঁচেননি। কিন্তু তাদের অসামান্য সৃষ্টিসমূহ পাঠকের মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে গেছে। এটি কিন্তু তাদের সৃষ্টিশীল কাজের সুফল, দীর্ঘ জীবনের নয়।
হাসনাত আবদুল হাই একজন দারুণ সৃষ্টিশীল লেখক। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই লেখেন তিনি। সচিবালয়ের একজন আমলা হিসেবে অনেকদিন কাজ করে অবসরে যান তিনি। তবে উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা হওয়াটা তার সৃষ্টিশীল কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। হাসনাত আবদুল হাইয়ের প্রথম উপন্যাস ‘সুপ্রভাত ভালোবাসা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। আরেকটি উপন্যাস ‘আমার আততায়ী’ তিন বছর পর প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক উপন্যাস বের হয়েছে তার। খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান, খ্যাতিমান ভাস্কর নভেরা এবং স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতব্বরকে নিয়ে হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা জীবনধর্মী উপন্যাস পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। এছাড়াও ছোটগল্প ও ভ্রমণের ওপর তার কমপক্ষে ১০টি করে বই রয়েছে। ইংরেজি ভাষায়ও গোটা দশেক বই লিখেছেন তিনি। চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে তার আলোচিত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে তার বইগুলো বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
১৯৯ সালে প্রকাশিত ‘মহাপুরুষ’ উপন্যাস দিয়ে হাসনাত আবদুল হাই জীবনধর্মী উপন্যাস লেখা শুরু করেন। এটি তাকে সাফল্য এনে দেয় একক চরিত্র অঙ্কনে যার নাম ছিলো সৈয়দ বেলাল। পরবর্তীতে তো অঙ্কন করেন আরজ আলী মাতব্বর, এসএম সুলতান ও নভেরার মতো চরিত্র। এদের জীবনের ব্যতিক্রমী ও নাটকীয় দিকগুলোকে উপজীব্য করে তিনি লেখেন উপন্যাস ‘সুলতান’ (১৯৯১ সালে), ‘এখন আরজ আলী’ (১৯৯৫ সালে), ও ‘নভেরা’ (১৯৯৫ সালে)। বাস্তব চরিত্রসমূহের নান্দনিক উপস্থাপনের মাধ্যমে হাসনাত আবদুল হাই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
১৯৩৭ সালের ১৯ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন হাসনাত আবদুল হাই। তার পূর্বপুরুষের ভিটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার সৈয়দাবাদ গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন এই বরেণ্য সাহিত্যিক। সেখানে এক বছর শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। ১৯৬৫ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)-তে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ওয়াশিংটন ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সচিবালয়ের একজন সচিব হিসেবে অবসরে যান তিনি।
হাসনাত আবদুল হাইয়ের বিচরণ ছিলো সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। নগর জীবন এবং এর সমস্যা ও জটিলতাসমূহ তার কিছু উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে। এখানেই তার উপন্যাস ও ছোটগল্পসমূহের গভীরতা। তার কাহিনি উপস্থাপনের ধারা খুব সহজ-সরল আবার খুব শক্তিশালীও। জীবন ও প্রকৃতির দারুণ এক পর্যবেক্ষক হাসনাত আবদুল হাই। মানুষের মনস্তত্ত্বের একেবারে ভেতরের দিকটি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সমসাময়িক মধ্যবিত্ত জীবনের সমস্যাগুলো তিনি বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। নগর ও পল্লী জীবনের নিখুঁত চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে
হাসনাত আবদুল হাই তার উপন্যাস ও ছোটগল্পের চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছেন। এরা বাস্তব জীবনের বিভিন্ন স্তরের প্রতীক। তার প্রতিটি
উপন্যাসেই ভাষা ও শব্দচয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিপক্কতার ছাপ মেলে। একজন ভ্রমণপ্রেমী মানুষ হিসেবে তিনি চমৎকার কিছু ভ্রমণবিষয়ক বই রচনা করেছেন। এসব বইয়ে বিভিন্ন জায়গা ও সেখানকার মানুষ, তাদের জীবনযাপন, ঐতিহ্য ও
সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ড. আখতার হামিদ খান, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, উইলিয়াম র্যাডিস, মুর্তজা বশীর, বেলাল চৌধুরী, শামসুজ্জামান খান ও সেলিনা হোসেনের মতো বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ হাসনাত আবদুল হাইয়ের কাজের মূল্যায়ন ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পদক এবং ১৯৯৫ সালে মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদক লাভ করেন তিনি। তার প্রাপ্ত অন্যান্য পুরস্কারগুলো হলো শেরে বাংলা একে ফজলুল হক পুরস্কার (১৯৯৫ সালে), মাওলানা আকরম খাঁ পুরস্কার (১৯৯৫ সালে) জগদীশচন্দ্র বসু পুরস্কার (১৯৯৫ সালে), শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন পুরস্কার (১৯৯৬ সালে), এসএম সুলতান পুরস্কার (১৯৯৫ সালে), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৩ সালে), এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (২০২০ সালে) প্রভৃতি।
লেখক : সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও সাহিত্য সমালোচক।
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা