শ্যামলাল গোসাঁই
আল বিরুনী : আমৃত্যু জ্ঞানের সাধন করা এক মুসলমান পণ্ডিতের কথা
আল বিরুনী : আমৃত্যু জ্ঞানের সাধন করা এক মুসলমান পণ্ডিতের কথা।
বাংলাদেশের মুসলমানদের জ্ঞান বিমুখতা এবং পশ্চাদপদতা দেখলে যেমন লজ্জাবোধ হয়, একইভাবে বিস্ময় জাগে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত মুসলিম মনীষীদের জ্ঞানার্জনের প্রতি উন্মুখতা দেখলে। মুসলমানরা আজ বিশ্বব্যাপী 'আতঙ্ক' জাগানিয়া এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ ইসলাম নয়; মুসলমানদের কপটতা, ভন্ডামি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা আর ধর্মজীবী হয়ে ওঠার কারণে। এরা জ্ঞান বিমুখতাকেই ইসলামের আদর্শরূপে প্রচার করতে ব্যস্ত। দেখলে মনে হবে জ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান সাধনার কথা শুনলেই এদের গায়ে ফোসকা পড়ে।
মুসলমানদেরও যে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানে জোরালো অংশগ্রহণ ছিল, গর্ব করার মতো মুসলিম মনীষীদেরও অবদান আছে, তা এই দিকভ্রান্ত জাতি ভুলতে বসেছে। এর কারণ, এরা জ্ঞান চর্চাকে এখন শত্রুদের কাজ হিসেবে গণ্য করে। জ্ঞান চর্চাকে ধর্মের কটূক্তি মনে করে! অথচ এমনও মুসলমান মনীষীর কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়, যারা মৃ'ত্যুশয্যায় শেষ দম ফেলার ক্ষণেও জ্ঞানের চর্চায় রত ছিলেন। তাদের একজন বলা যেতে আল বিরুনীকে। মধ্যযুগের প্রভাবশালী একজন মুসলমান দার্শনিক ছিলেন আল বিরুনী। যার নাম ভারতসহ গোটা বিশ্বের জ্ঞানপিপাসুরা জানেন।
সুলতান মাহমুদ গজনভীর রাজসভার অন্যতম পণ্ডিত আল বিরুনীর পুরো নাম আবু রাইহান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বিরুনী। তিনি বিশ্বব্যাপী আল বিরুনী নামেই পরিচিত। যদিও বিরুনী তার নাম নয়, তার জন্মস্থান ইরানের বিরুন নামক এলাকায় হওয়ায় তাকে বিরুনী ডাকা হয়। আল বিরুনী দার্শনিক ছিলেন। সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, হিব্রুসহ কয়েকটি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন জ্ঞান চর্চার সুবিধার্থে। তিনি ভারতে এসে সংস্কৃতের মতো কঠিন ভাষা শিখেছিলেন শুধুমাত্র আদি হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে জানার জন্য, হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন ইহুদি সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞানের ধারা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে। আল বিরুনী বিরচিত 'কিতাব আত-তাহকিক আল হিন্দ' যা সংক্ষেপে 'তারিখ-উল হিন্দ' নামে জনপ্রিয়, বইটি আজও আমাদের সাহায্য করে ভারতীয় প্রাচীন সাংখ্য দর্শন সম্পর্কে জানতে। একইসঙ্গে ভারতীয় ধর্ম পদ্ধতি, চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণার সাথে বিশ্লেষণাত্মক পরিচয় ঘটিয়ে দিতে আজও জ্ঞান তাপসরা বিরুনীর এ বই হাতে নেন। বিরুনীর আগ্রহ শুধু ভারতীয় ধর্ম, দর্শনেই সীমাদ্ধ ছিল না। তিনি খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, ইহুদিদের তওরাত এসব আয়ত্ত্ব করেছিলেন। কিন্তু, ভারতীয় দর্শন, গণিতশাস্ত্র ইত্যাদির প্রতি তাঁর ছিল অকৃপণ প্রীতি।
আজকের মুসলমান আরবি মাত্রই পবিত্র ভাষা, বেহেশতি ভাষা মনে করেন। আজ থেকে এক হাজার বছর পূর্বের জ্ঞানতাপষ আল বিরুনী এদের মতো এই অন্ধগামীতার পথে ছিলেন না। তিনি আরবি, হিব্রু, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষাকে জাতি ও অঞ্চলের রস নিঃসৃত ধ্বনিরূপেই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন- সংস্কৃত ভাষা না জানলে কেউ হিন্দু ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন করতে পারবে না। এর কারণও তিনি তাঁর 'তারিখ-উল হিন্দ' বইয়ে উল্লেখ করেছেন। সেইসময় ভারতে 'বিষ্ণুধর্ম' থেকে 'শৌনক' এর ঐতিহ্যগত প্রথার উল্লেখ করে লিখেছিলেন- 'সামাজিক রীতিনীতি প্রথায় প্রকৃতির প্রভাব রয়েছে। পারস্পরিক আদান-প্রদান ও সহযোগিতাই সভ্যতার মূল সূত্র।' উল্লিখিত বাক্যের শেষ পদটি (পারস্পরিক আদান-প্রদান ও সহযোগিতাই সভ্যতার মূল সূত্র) বর্তমান অস্থিতিশীল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক দাবি।
আল বিরুনী রচিত বইয়ের সংখা জানলে আজকের জ্ঞানবিমুখ মুসলমানদের থমকে ওঠার কথা। মধ্যযুগের আরেক মুসলমান পণ্ডিত ইয়াকুত (দশম শতাব্দী) একবার বলেছিলেন- তিনি বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের মার্ভ শহরে আরবি হরফে লেখা আল বিরুনীর মোট বইয়ের ষাট পৃষ্ঠার একটি তালিকা দেখেতে পেয়েছিলেন! অন্য এক লেখক বলেছেন- আল বিরুনী এতো পরিমাণ বই লিখেছিলেন যে একটা উঠের পক্ষে তাঁর বইয়ের বোঝা বওয়া সম্ভবপর ছিল না। এগুলো অত্যুক্তি মনে হতে পারে। তাই আল বিরুনীর একটি স্বলিখিত পত্রের কথাই বলা যাক। যেখানে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে তাঁর লেখা ১১৪টি বইয়ের নাম দিয়েছিলেন। যেটি আবার অসম্পূর্ণ ছিল! মধ্যযুগের জ্ঞানবিচ্ছিন্নতার ওই সময়ে যিনি ১১৪টি বই রচনা করেছিলেন তাঁকে আর যাইহোক কোনোভাবেই দেশের মুসলমানদের মতো মূর্খ, নিরক্ষর বা জ্ঞানবিমখ ভাবার কোনো যুক্তি দেখি না।
পণ্ডিত আল বিরুনীর জ্ঞান চর্চা অব্যাহত ছিল মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত। জানা যায়- আল বিরুনী যখন মৃত্যুশয্যায় তখন তাঁর এক বিজ্ঞানী বন্ধু তাঁকে দেখতে আসেন। তখন বিরুনী বিছানায় শয্যাশায়ী, অসুস্থ। কিন্তু, বিজ্ঞানী বন্ধুটি আসতে বিরুনী তাঁকে নানা ধরনের জ্ঞানমূলক প্রশ্ন করতে থাকেন। যা শুনে তাঁর বিজ্ঞানী বন্ধু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন- 'আপনি এই অবস্থায়ও কেন প্রশ্ন করে করে উতলা হচ্ছেন? আপনার উচিৎ এখন বিশ্রাম করা।' বন্ধুর এ প্রশ্নের উত্তরে সেদিন আল বিরুনী বলেছিলেন- আমার জন্য তো এটাই সবচেয়ে ভালো যে আমি মৃত্যুর আগেও একটা প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান জেনে মারা যাই। এটা কি অজ্ঞানতার থেকে শ্রেয় নয়?' এমনধারা লোক ছিলেন আল বিরুনী। যিনি, মৃত্যুর আগেও যন্ত্রণায় প্রলাপ বকার চাইতে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান জেনে মারা যাওয়াই উত্তম মনে করতেন।
অথচ, হায় বাংলাদেশের মুসলমান! যাদের দেখলে মনে হবে- জ্ঞান চর্চা এদের আজন্ম দুশমন। বিজ্ঞান মাত্রই এদের কাছে এক মহাবিতর্কের বিষয়। আল বিরুনীর নাম কয়টি মাদরাসার শিক্ষার্থী জানে? আল বিরুনীকে পড়েছে এমন মুসলমান যুবকের সন্ধান খুব একটা পাওয়া যায় না। এরা আহমদ উল্লাহ কপট, মামুনুল হক ভন্ড আর কমেডিয়ান মাদানিকে নিয়ে গর্ব করে, এদের জন্য জান বাজী লাগিয়ে দেয়! আল বিরুনী যদি এই সমাজে থাকতেন, এরা নিশ্চয়ই আল বিরুনীকেও হুমায়ুন আজাদের মতো হ'ত্যা করতো। কেননা, আল বিরুনী এদের মতো ধর্ম মানতেন না। তিনি, জ্ঞান চর্চাকেই ধর্ম বলে মনে করতেন।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা