আপডেট: ০৯:৪১, ৫ আগস্ট ২০১৯
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পর্ব-২
শেখ মুজিবুর রহমান : শেখরা তখনও দুর্বল হয়ে পড়ে নাই। রাইনের লোকদের সাথে কয়েক দফা দাঙ্গহাঙ্গামা হল এবং কোর্টে মামলা দায়ের হল। মামলায় প্রমাণ হল রাইন অন্যায় করেছে। কোর্ট শেখ কুদরতউল্লাহকে বলল, যত টাকা ক্ষতি হয়েছে জরিমানা করুন, রাইন দিতে বাধ্য। ঐ যুগে এইভাবেই বিচার হত। শেখ কুদরতউল্লাহ রাইনকে অপমান করার জন্য ’আধা পয়সা’ জরিমানা করল। রাইন বলেছিল ”যত টাকা চান দিতে রাজি আছি, আমাকে অপমান করবেন না। তাহলে ইংরেজ সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না; কারণ ’কালা আদমি’ আধা পয়সা জরিমানা করেছে।” কুদরতউল্লাহ শেখ উত্তর করেছিল বলে কথিত আছে, “টাকা আমি গুনি না, মেপে রাখি। টাকার আমার দরকার নাই। তুমি আমার লোকের উপর অত্যাচার করেছ; আমি প্রতিশোধ নিলাম।” কুদরতউল্লাহ শেখকে লোকে কদু শেখ বলে ডাকত। আজও খুলনা ও ফরিদপুরের বৃদ্ধ মানুষ বলে থাকে এই গল্পটা মুখে মুখে। ’কুদরতউল্লাহ শেখের আধা পয়সা জরিমানার’ দু’একটা গানও আছে। আমি একবার মিটিং করতে যাই বাগেরহাটে, আমার সাথে জিল্লুর রহমান এডভোকেট ছিল। ট্রেনের মধ্যে আমার পরিচয় পেয়ে এক বৃদ্ধ এই গল্পটা আমাকে বলেছিলেন। খুলনা জেলায় গল্পটা বেশি পরিচিত।
শেখ কুদরতউল্লাহ ও একরামউল্লাহ শেখের মৃত্যুর দুই এক পুরুষ পর থেকেই শেখ বাড়ির পতন শুরু হয়। পর পর কয়েকটা ঘটনার পরেই শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেল।
ইংরেজরা মুসলমানদের ভালো চোখে দেখতো না। প্রথম ঘটনা, রাণি রাসমণি হঠাৎ জমিদার হয়ে শেখদের সাথে লড়তে শুরু করলেন, ইংরেজও তাকে সাহায্য করল। কলকাতার একটা সম্পত্তি ও উল্টাডাঙ্গার আড়ত শেখদের সম্পত্তি ছিল। এই সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন শেখ আছিমুদ্দিন। আবার জমিদারি নিয়েও রাসমণির স্টেটের সাথে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগেই ছিল। শেখ বাড়ি থেকে তিন মেইল দূরে শ্রীরামকান্দি গ্রামে তমিজুদ্দিন নামে এক দুর্ধর্ষ লোক বাস করত। সে রাসমণি স্টেটের পক্ষ অব্লম্বন করেছিল। সে ভালো যোদ্ধা ছিল। একবার দুই পক্ষে খুব মারামারি হয়। এতে রাণী রাসমণির লোক পরাজিত হয়। শেখদের লোকদের হাতে তমিজুদ্দিন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে এবং শোনা যায় যে, পরে মৃত্যুবরণ করে। মামলা শুরু হয়। শেখদের সকলেই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে বহু অর্থ খরচ করে হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পায়।
এরপরই আর একটা ঘটনা হয়। টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ীর পাশেই আরেকটা পুরানা বংশ আছে, যারা কাজী বংশ নামে পরিচিত। এদের সাথে শেখদের আত্নীয়তাও আছে। আত্নীয়তা থাকলেও রেষারেষি কোনদিন যায় নাই। কাজীরা অর্থ-সম্পদ ও শক্তিতে শেখদের সাথে টিকতে পারে নাই। কিন্তু লড়ে গেছে বহুকাল। যে কাজীদের সাথে আমাদের আত্নীয়তা ও ঘনিষ্টতা ছিল তারা শেখদের সমর্থন করত। কাজীদের আর একটি দল রাণি রাসমণির সাথে যোগদান করে। তারা কিছুতেই শেখদের আধিপত্য সহ্য করতে পারছিল না। তাই তারা এক জঘন্য কাজের আশ্রয় নিল শেষ পর্যন্ত। অধিকাংশ কাজী শেখদের সাথে মিশে গিয়েছিল।
একটা দল কিছুতেই শেখদের শেষ না করে ছাড়বেনা ঠিক করেছিল। বৃদ্ধ এক কাজী, নাম সেরাজতুল্লা কাজী। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। ছেলেরা এক ষড়যন্ত্র করে এবং অর্থের লোভে বৃদ্ধকে গলা টিপে হত্যা করে শেখ বাড়ির গরুর ঘরের চালের উপর রেখে যায়। এই ঘটনা শুধু তাদের তিন ভাই এবং তাদের বোনটি জানত। বোনটিকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল। শেখ বাড়িতে লাশ রেখে রাতারাতিই গিয়ে থানায় খবর দেয় এবং এতে শেখদের ভীষন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়।
আমার দাদার চাচা এবং রেণুর দাদার বাবা কলকাতা থেকে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে চলে আসেন বাড়িতে। কলকাতার সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। তারপর যখন সকলে গ্রেফতার হয়ে গেছে, কেউই দেখার নেই- বড় বড় ব্যবসায়ী, মাঝি ও ব্যাপারীরা নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে উধাও হতে শুরু করল। এর পূর্বে তমিজউদ্দিনের খুনে যথেষ্ট টাকা খরচ হয়ে গেছে। জমিদারিও নিলাম হয়ে প্রায় সবই চলে যেতে লাগল। বহুদিন পর্যন্ত মামলা চলল। নিচের কোর্টে সকলেরই জেল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টে মামলা শুরু হল। আমাদের এডভোকেট হাইকোর্টে দরখাস্ত করল সিআইডি দ্বারা মামলা আবার ইনকোয়ারি করাতে। কারণ, এ মামলা ষড়যন্ত্রমূলক। হাইকোর্ট মামলা দেখে সন্দেহ হলে আবার ইনকোয়ারি শুরু হলো। একজন অফিসার পাগল সেজে আমাদের গ্রামে যায় আর খোঁজখবর নেয়। একদিন রাতে সেরাজতুল্লাহ কাজীর তিন ছেলের মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয় এবং কথায় কথায় এক ভাই অন্য ভাইকে বলে, "বলেছিলাম না শেখদের কিছু হবে না, বাবাকে অমনভাবে মারা উচিত হবে না।" অন্য ভাই বলে, "তুই তো গলা টিপে ধরেছিলি তাই তো বাবা মারা গেল।" বোনটা বলল, "বাবা একটু পানি চেয়েছিল, তুই তো তাও দিতে দিলি না।" সিআইডি এই কথা শুনতে পেল ওদের বাড়ির পিছনে পালিয়ে থেকে। তার কয়েকদিন পরেই তিন ভাই ও বোন গ্রেফতার হল এবং স্বীকার করতে বাধ্য হলো তারাই তাদের বাবাকে হত্যা করেছে।
শেখরা মুক্তি পেল আর ওদের যাবজ্জীবন জেল হল। শেখরা মামলা থেকে বাঁচল, কিন্তু সর্বশান্ত হয়েই বাঁচল। ব্যবসা নাই, জমিদারি শেষ, সামান্য তালুক ও খাস জমি, শেখ বংশ বেঁচে রইল শুধু খাস জমির জন্য। এদের বেশ কিছু খাস জমি ছিল। আর বাড়ির আশপাশ দিয়ে কিছু জমি নিষ্কর ছিল। খেয়ে পড়ার কষ্ট ছিল না বলে বাড়িতে বসে আমার দাদারা বাবা চাচারা পাশা খেলে দিন কাটাতেন। সকলেই দিনভর দাবা আর পাশা খেলতেন, খাওয়া ও শোয়া এই ছিল কাজ। এরা ফার্সি ভাষা জানতেন এবং বাংলা ভাষার উপরও দখল ছিল। রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাতো ভাই, তিনি তার জীবনী লিখে রেখে গিয়েছিলেন সুন্দর বাংলা ভাষায়। রেণুও তার কয়েকটা পাতা পেয়েছিল যখন তার দাদা সমস্ত সম্পত্তি রেণু ও তার বোনকে লিখে দিয়ে যান তখন। রেণুর বাবা মানে আমার শ্বশুর ও চাচা তাঁর বাবার সামনেই মারা যান।
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের