রিপন দে
প্রকাশিত: ০০:৫৮, ৫ জুন ২০২০
লাউয়াছড়ার সড়ক ও রেলপথে মারা যাচ্ছে বন্য প্রাণী
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে সন্ধ্যার দিকে মোটরসাইকেল চড়ে লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছিলেন নাজমুল হক। জাতীয় উদ্যানের মূল ফটকের ১০ গজ আগে দেখতে পান রক্তাক্ত একটি বানরের বাচ্চা ছটফট করছে। আহত বানরটিকে কি করবেন বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় সেটি। পরে জানতে পারেন ২০ মিনিট আগে একটি দ্রুত গতির পিকআপ বানরটিকে চাপা দিয়ে গেছে। ফলে ঘটনাস্থলেই বানরটির মৃত্যু হয়। এভাবে প্রতিদিনই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরের সড়কে মারা যাচ্ছে অনেক বন্য প্রাণী।
সড়কের এই মৃত্যুর মিছিলের সঙ্গে যোগ হয়েছে রেলপথ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সড়ক ও রেলপথ মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে অন্তত তিনটি প্রাণি। এর মধ্যে রয়েছে সরীসৃপ, উভচর ও স্তন্যপায়ী প্রাণি।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টরের লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। এ উদ্যানে রয়েছে বিশ্বব্যাপী বিরল এবং বিপন্ন অনেক বৃক্ষ, উদ্ভিদ এবং প্রাণির বসবাস। শুধুমাত্র এখানেই রয়েছে আফ্রিকান টিকওক গাছ। সম্প্রতি আইইউসিএন বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছে চীনা বনরুইকে। সে বনরুই বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র লাউয়াছড়াতেই ভালো অবস্থানে রয়েছে।
প্রাণ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ৬.৫ কিলোমিটার উপজেলা সংযোগ সড়ক। এছাড়া রেলপথ রয়েছে প্রায় ৮ কিলোমিটার। ওই সড়ক ও রেলপথে প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে একাধিক প্রাণী। মৃত্যুর এই মিছিল ঠেকাতে দীর্ঘদিন ধরে প্রাণিপ্রেমীরা আন্দোলন করে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ওই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করে প্রায় চার থেকে পাঁচশ ছোট-বড় গাড়ি।
স্থানীয়রা জানায়, বনের ভেতর রাস্তা দিয়ে বন্য প্রাণীরা সড়কের এপাশ থেকে ওপাশে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এক সময় যানবাহনের সংখ্যা কম থাকলেও বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যান বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে প্রাণী মৃত্যুর হারও। দিনের থেকে রাতের বেলায় বন্য প্রাণীর বিচরণ বেশি। রাস্তা পারাপারের সময় হঠাৎ করে সামনে চলে আসা দ্রুতগামী যানবাহনের আলোতে প্রাণিরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন দ্রুতগামী গাড়ির আঘাতে অনেক বন্য প্রাণী মারা যায়।
সম্প্রতি মধ্যরাতে নিজের গাড়িতে করে লাউয়াছড়া সড়ক দিয়ে কমলগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গল ফিরছিলেন ‘শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থা’র সাংগঠনিক সম্পাদক এস কে দাস সুমন। তিনি তার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘লাউয়াছড়া ভেতরে প্রবেশ করার পর একটি খরগোশ গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়াতে থাকে। প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা খরগোশটি গাড়ির আলোতে দৌড়ানোর পর বনের ভেতর ঢুকে যায়। আমি গাড়ির গতি কমিয়ে দেওয়ার কারণে খরগোশটি বেঁচে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ চালক তা করেন না।’’
এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী কয়েকজন জানান, প্রায়ই সড়কের উপর ও সড়কের পাশে বন্য প্রাণীর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
গত বছর উল্লুক নিয়ে গবেষণার কাজে লাউয়াছড়ায় ছয় বার এসেছেন তানভীর আহমেদ সৈকত। এ পর্যন্ত তিনি উদ্যানের ভেতরে সড়ক ও রেলপথে নিহত হওয়া ২৮টি প্রাণীর মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন।
বেসরকারি পর্যায়ে লাউয়াছড়ার ভেতর সড়কপথে দুর্ঘটনায় বন্য প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে টানা ১৪ মাস গবেষণা করে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। ১৪ মাসের গবেষণায় তারা লাউয়াছড়ার ৫০৩টি সাপের মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন। যেগুলো সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষক শাহারিয়ার সিজার জানান, ১৪ মাসে ২৯৪ দিন আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেছি। মৃত প্রাণীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশের দেহ পাওয়া যায় না, কারণ শিয়ালসহ কিছু প্রাণী মরদেহগুলো খেয়ে ফেলে। অনেক প্রাণী আবার সড়কে গুরুতর আহত হয়ে বনের ভেতরে গিয়ে মারা যায়। লোক চক্ষুর আড়ালেই থেকে যায় মৃত প্রাণীদের বিরাট একটি অংশ। তাই সঠিক হিসাব বলা কঠিন। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে প্রতিদিন সড়ক ও রেলপথে তিন থেকে চারটি প্রাণী মারা যায়। সাপের মৃত্যুর হার বর্ষাতে বেশি থাকলেও শীতকালে কম।
তিনি আরও বলেন, ‘‘পরিচিত অনেকেই লাউয়াছড়ায় নিয়মিত যান। তাদের থেকেও সামগ্রিক খোঁজ খবর আমরা রাখি। গবেষণা সাত বছর আগে হলেও এখনো সেই সংখ্যার পরিবর্তন হয়নি। প্রতিদিন গড়ে তিনটি প্রাণী এখনও মারা যাচ্ছে।’’
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবির) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র রাসেল মিয়া, মো. সালাহউদ্দীন, জায়েদুল ইসলাম ও জামান মিয়া মিলে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে সড়ক দুর্ঘটনায় উভচর ও সরীসৃপ প্রাণির মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করেছেন।
ওই দলের একজন মো. সালাহউদ্দীন বলেন, ‘‘বর্ষাকালে উভচর ও সরীসৃপ প্রাণীদের মৃত্যুর মিছিল কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা একটি পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝতে পারবেন। আমাদের গবেষণা শীতকালের হলেও কৌতূহলবশত বর্ষাকালে একদিন আমরা সার্ভে করেছিলাম। সেই সার্ভেতে একদিনে উভচর ও সরীসৃপ মিলে ১৬৫টি প্রাণির মরদেহ খুঁজে পেয়েছি।’’
লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির সাজু মারছিয়াং জানান, প্রায়ই তিনি সড়কে একাধিক প্রাণীর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। এগুলো সবই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো। সম্প্রতি উদ্যানের ভেতরের সড়কের সংস্কার হওয়ায় রাস্তার প্রস্থ বেড়েছে। ফলে ওই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী গাড়িগুলো আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে চলে।
লাউয়াছড়ার পার্শ্ববর্তী রাধানগর এলাকার বাসিন্দা ও শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শামছুল হক জানান, ‘‘সড়ক পথ, বিদ্যুতের লাইন, রেলপথ এবং লোকালয়ে এসে প্রতিদিনই প্রাণী মারা যাচ্ছে। হিসাব করলে গড়ে প্রতিদিন তিনটি প্রাণী বা তার বেশি মারা যাচ্ছে। কোনো কোনো দিন ৮/১০টি প্রাণীও মারা যায়।’’
তবে স্থানীয় বনবিভাগ বন্য প্রাণী মৃত্যুর যে সংখ্যা জানিয়েছে তার সঙ্গে অন্যান্য পরিসংখ্যানের কোনো মিল নেই। বন বিভাগের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জ কর্মকর্তা (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মোনায়েম হোসেন জানান, ২০১৯ সালে ৩২টি প্রাণী মারা গেছে। তার মধ্যে ২০টি সাপ এবং ১২টি বিভিন্ন প্রজাটির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে।
কমলগঞ্জ জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আহাদ মিয়া জানান, শুধু সড়কে নয় প্রাণীদের মৃতদেহ অনেক সময় বনের ভেতরে পরে থাকতে দেখেছি। আমার ধারণা রাস্তায় গাড়িতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তারা বনের ভেতর গিয়ে মারা গেছে। এভাবে প্রতিদিন অন্তত ৩টি প্রাণী মারা যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, শুধু সড়ক ও রেলপথে নয়, বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে বৈদ্যুতিক খোলা লাইনেও। লাউয়াছড়া ভেতরে দিয়ে টানা বিদ্যুৎ লাইনে বিরল প্রজাতির বাদুর ও বানর মারা যায়।
শ্রীমঙ্গল লাউয়াছড়া বন ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক প্রভাষক জলি পাল বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে উদ্যানের ভেতর থেকে সড়ক পথটি সরানোর ব্যাপারে আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিছুদিন আগে একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘লাউয়াছড়ার সড়ক পথ সরানো হবে। প্রয়োজনে নেট দিয়ে প্রাণীর নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’’ কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সব কিছু শুধু প্রস্তাব আর আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আমরা আর মুখের কথা শুনতে চাইনা। যত দ্রুত সম্ভব সড়ক পথ সরানো হোক, একই সঙ্গে রেলপথ নিয়ে বিকল্প চিন্তা করা উচিত।
এ দিকে বনবিভাগ জানিয়েছে, একটি বিকল্প সড়কের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তারা। কিছুদিন পূর্বে বন পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি লাউয়াছড়া পরিদর্শনে এসে বিকল্প সড়কের ব্যাপারে প্রস্তাবের আলোচনা করেন। তখন সংসদীয় কমিটিতে বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
এই বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আবদুল ওয়াদুদ জানান, রাস্তাটি সড়বে কিনা সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি এমপি সাবের হোসেন সরজমিনে দেখে গেছেন। আগামী সংসদীয় কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে তিনি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করবেন বলে তিনি জানিয়ে গেছেন। আমরা সে অপেক্ষা আছি।
আরও পড়ুন
প্রাণ-প্রকৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- ফুল | Flower | Eye News
- বিলুপ্ত প্রজাতির গন্ধগোকুল উদ্ধার; লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত
- সুন্দরবন সুরক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার: পরিবেশমন্ত্রী
- জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উদ্ভিদ প্রজাতির জরিপ করছে সরকার : পরিবেশমন্ত্রী
- টর্নেডো: কি, কেন কীভাবে?
- জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় ছড়াচ্ছে রোগবালাই
- শুশুক বাঁচলে বেঁচে যায় গোটা জলজ জীবন চক্র
- ফুল ছবি | Flower Photo | Download | Eye News
- ফ্রি ডাউনলোড-গোলাপ ফুলের ছবি
- পটকা মাছ বিষাক্ত কিনা বুঝবেন যেভাবে
সর্বশেষ
জনপ্রিয়