আই নিউজ প্রতিবেদক
বাংলাদেশের বন
চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি এলাকার বনাঞ্চল। ছবি- লিংকন রায়
বন, প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় এবং আমাদের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেনের জোগান দেয় বনাঞ্চল। বাংলাদেশের বন টিকিয়ে রাখা তাই আমাদের জন্য একটি দায়িত্ব এবং একান্ত কর্তব্যও। বনাঞ্চল না থাকার কারণে বিশ্বের অনেক দেশ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। তাই বাংলাদেশের বন রক্ষায় সরকার থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
পাঠকদের জন্য আন্তর্জাতিক বন দিবসে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের বন নিয়ে। বাংলাদেশেও রয়েছে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলের মতো এই বাংলাদেশ বন-ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। এতে করে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা।
বাংলাদেশ বন নিয়ে জানার আগে ছোট করে আমাদেরকে জানতে হবে বন কী? বন কাকে বলে? সাধারণ ভাষায় বৈশিষ্ট্যসূচক বাহ্যিক চেহারা ও গঠনসহ গাছপালার একককে বনের ধরন বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পরিবেশগতভাবে বাংলাদেশের বনগুলোকে নানানভাবে ভাগ করা হয়েছে। এর মাঝে রয়েছে ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরহরিৎ বন, ক্রান্তীয় প্রায়-চিরহরিৎ বন, ক্রান্তীয় আর্দ্র পর্ণমোচী বন, মিঠাপানির জলাভূমি বন, প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ বন, ও সৃজিত বন।
বাংলাদেশের চিরহরিৎ বন
আমাদের সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় যেসব বন দেখি এগুলোকেই বলা হয় ক্রান্তীয় আদ্র চিরহিৎ বন। আমাদের মৌলভীবাজার জেলায়ও আছে চিরহরিৎ বন। লাউয়াছড়া, রাজকান্দি ফরেন্ট বিট এ বনের অন্তর্ভুক্ত। এসব বনে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য নিয়ে চিরহরিৎ উদ্ভিদের অবস্থান। এসব বৃক্ষ ছাড়াও প্রায়-পর্ণমোচী ও পর্ণমোচী প্রজাতিরও দেখা মিললেও বনের চিরহরিৎ বৈশিষ্ট্য অটুট থাকে।
বাংলাদেশের বনে রয়েছেচ নানা ধরণের প্রাণী
আর্দ্রতার কারণে ছায়াযুক্ত আর্দ্র স্থানে পরাশ্রয়ী অর্কিড, ফার্ণ ও ফার্ণসহযোগী, আরোহী লতা, স্থলজ ফার্ণ, মস, অ্যারোয়েড, এবং বেত পাওয়া যায়। গুল্ম, বিরুৎ আর ঘাসের পরিমাণ অপ্রতুল। এধরনের বনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সবচাইতে উপরের চাঁদোয়া প্রধানত কালিগর্জন, ঢালিগর্জন, সিভিট, ধূপ, কামদেব, রক্তন, বুদ্ধনারকেল, টালি, চুন্দুল, ঢাকিজাম দখল করে রাখে।
প্রায়-পর্ণমোচী ও পর্ণমোচী বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে চম্পা, বনশিমুল, চাপালিশ, মান্দার। এছাড়া চাঁদোয়ার দ্বিতীয় স্তরে অন্যান্যের মধ্যে পাওয়া যায় পিতরাজ, চালমুগরা, ডেফল, নাগেশ্বর, কাও, জাম, গদা, ডুমুর, কড়ই, ধারমারা, তেজভাল, গামার, মদনমাস্তা, আসার, মুজ, ছাতিম, টুন, বুরা, অশোক, বরমালা, ডাকরুম।
ক্রান্তীয় প্রায়-চিরহরিৎ বন
বাংলাদেশে ক্রান্তীয় প্রায়-চিরহরিৎ বন ধরনের বন দেখতে পাওয়া যায় সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিনাজপুরেও এ ধরনের কিছু বন এলাকা রয়েছে। সাধারণত চিরহরিৎ হলেও পর্ণমোচী বৃক্ষরাও এখানে রাজত্ব করে। বেশিরভাগ বনেই জুমচাষ প্রচলিত।
এখন পর্যন্ত এসব বনে প্রায় ৮০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদের উপস্থিতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। চিরহরিৎ বনের তুলনায় এসব বনে লতাগুল্মের ঝোপঝাড়ের পরিমাণ বেশি। সবচাইতে উপরে চাঁদোয়ার উচ্চতা ২৫ থেকে ৫৭ মিটার। উপত্যকা ও আর্দ্র ঢালের সবচেয়ে উপরের স্তরের উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে চাপালিশ, তেলসুর, চুন্দুল, এবং বুদ্ধনারকেল। মধ্যম স্তরের উদ্ভদদের মধ্যে গুটগুটিয়া, গুটগুইট্টা টুন, পিতরাজ, নাগেশ্বর, উরিআম, নালিজাম, গদাজাম, পিতজাম, ঢাকিজাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সবচাইতে নিচের স্তরটিতে দেখা যায় ডেফল ও কেচুয়ান।
অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত গরম ও শুষ্ক ঢাল এবং শৈলশিরার উপরের স্তরের উদ্ভিদগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় গর্জন, বনশিমুল, শিমুল, শিল কড়ই, চুন্দুল, গুজা বাটনা, কামদেব, বুরা গামারি, বহেড়া, এবং মুজ। মধ্যম স্তরের রয়েছে গাব, উদাল, এবং শিভাদি আর নিম্নস্তরে দেখা যায় আদালিয়া, বরমালা, গোদা, অশোক, জলপাই এবং ডারুম। সচরাচর যেসব পর্ণমোচী উদ্ভিদ দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে আছে গর্জন, শিমুল, বনশিমুল, বাটনা, চাপালিশ, টুন, কড়ই, এবং জলপাই।
প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ বন
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ ধরনের বন পরিলক্ষিত হয়। প্রায় ৫২০,০০০ হেক্টর জুড়ে এসব বনের বিস্তৃতি। জোয়ারের পানিতে এই বন নির্দিষ্ট সময় পর পর বিধৌত হয়। এ অঞ্চলের উদ্ভিদদের মাঝে বিশেষ ধরনের অভিযোজন হিসেবে রয়েছে শ্বাসমূল, ঠেসমূল, এবং জরায়ূজ অঙ্কুরোদগম দেখা যায়। এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী। সুন্দরী ছাড়াও এখানে রয়েছে পশুর, গেওয়া, কেওরা, কাঁকড়া, বাইন, ধুন্দুল, আমুর, ডাকুর, ইত্যাদি।
জোয়ারের পানিতে এই বন নির্দিষ্ট সময় পর পর বিধৌত হয়।
সৃজিত বন
যে ধরনের বন সাধারণত কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয় এই বনগুলোকে বলা হয় সৃজিত বন। সৃজিত বন দুই পক্ষের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে। একটি সরকার পক্ষ এবং অন্যটি বেসরকারি পক্ষ। অর্থাৎ, সাধারণত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সৃজিত বন গড়ে তোলা হয়।
যেমন ১৮৭১ সালে মায়ানমার থেকে সেগুনের বীজ এনে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় বন সৃজনের উদ্যোগ শুরু হয়। পরবর্তীতে সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগেও এই অনুশীলনের প্রসার ঘটে। সেগুন ছাড়াও অন্য যেসব বৃক্ষ সৃজনের উদ্যোগ নেয়া হয় সেগুলো হল গামার, চাপালিশ, গর্জন, মেহগনি, জারুল, টুন, পিংকাডো, এবং জাম। এছাড়াও পরে দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদ হিসেবে গামার, কদম, আকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস এবং পাইনের চাষ শুরু হয়।
তবে বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে সামাজিক উদ্যোগেও বনাঞ্চল তৈরির আগ্রহ বেড়েছে।
বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন দিবস
প্রতিবছর ২১ মার্চ, বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য—বন এবং নতুন উদ্ভাবন।
১৯৭১ সালে ইউরোপীয় কনফেডারেশন অব অ্যাগ্রিকালচারের ২৩তম সাধারণ পরিষদে বিশ্ব বনায়ন দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বন দিবস প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দুটি আন্তর্জাতিক স্মারক বিশ্ব বন দিবস এবং আন্তর্জাতিক বন দিবসকে একত্রিত করে প্রতি বছর ২১ মার্চ দিবসটিকে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
মূলত গাছের গুরুত্ব বোঝাতেই দিবসটি পালিত হয়। এর মধ্যে বৃক্ষরোপণও অন্তর্ভুক্ত। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের মতে, পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি। একটি বনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ গাছ থাকে। একজন মানুষের শ্বাস নিতে বছরে ৭৪০ কেজি অক্সিজেন প্রয়োজন। গড়ে একটি গাছ বছরে ১০০ কেজি পর্যন্ত অক্সিজেন দেয়। ফলে মানুষের বেঁচে থাকা আর পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা একা হাতেই সামলায় বনাঞ্চলগুলো।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার সুন্দরবনসহ বিভিন্ন বন সংরক্ষণে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ফলে সুন্দরবনের বৃক্ষ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় বন জরিপের তথ্যমতে সুন্দরবনে মোট কার্বন মজুদের পরিমাণ ১৩৯ মিলিয়ন টন, যেখানে ২০০৯ সালে পরিচালিত জরিপ অনুসারে এর পরিমাণ ছিল ১০৭ মিলিয়ন টন।
বন রক্ষায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব উদ্যোগ স্মরণীয় করে রাখতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনগণের মাঝে বিনামূল্যে ১ কোটি চারা বিতরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বন: ভবিষ্যৎ এবং করণীয়
বিশ্বের প্রায় সব ধরণের সরকারই বনাঞ্চল রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। যেকারণে, কপের মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষয়ক জোটের কথা শোনা যাচ্ছে। জোটবদ্ধ দেশগুলো প্রকৃতি, পরিবেশ ও বনাঞ্চল রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছে। কপ সদস্যবিশিষ্ট দেশ হিসেবে বাংলাদেশও বন ও পরিবেশ রক্ষায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে বিস্তৃত বনাঞ্চল। এসব বনাঞ্চলে রয়েছে দেশের জীব বৈচিত্র্য, লতা, গুল্ম, উদ্ভিদ। কিন্তু, বর্তমানে এসে ভূমিখেকো মানুষদের লোভের শিকার হচ্ছে এসব বনাঞ্চল। বনের গাছ চুরি করে কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাতের আঁধারে। ফলে পরিবেশের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। আমরা নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যাপারে যতোটা উদ্বীগ্ন, ততোটাই উদাস পরিবেশের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। অথচ সুন্দর পৃথিবীতে সুস্থভাবে বসবাসের প্রথম শর্ত পরিবেশের স্বাস্থ্য সুরক্ষা।
আই নিউজ/এইচএ
- ফুল | Flower | Eye News
- বিলুপ্ত প্রজাতির গন্ধগোকুল উদ্ধার; লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত
- সুন্দরবন সুরক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার: পরিবেশমন্ত্রী
- জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উদ্ভিদ প্রজাতির জরিপ করছে সরকার : পরিবেশমন্ত্রী
- টর্নেডো: কি, কেন কীভাবে?
- জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় ছড়াচ্ছে রোগবালাই
- শুশুক বাঁচলে বেঁচে যায় গোটা জলজ জীবন চক্র
- ফ্রি ডাউনলোড-গোলাপ ফুলের ছবি
- ফুল ছবি | Flower Photo | Download | Eye News
- পটকা মাছ বিষাক্ত কিনা বুঝবেন যেভাবে