আবু মকসুদ
প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৭ মে ২০২০
আপডেট: ১৭:১৩, ৭ মে ২০২০
আপডেট: ১৭:১৩, ৭ মে ২০২০
জগনান্দের বুরহান
ফাইল ছবি
জগদীশ বসু বিজ্ঞানী, জগানন্দ দাস আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক। জগা আর বিজ্ঞান ছাড়া জগদীশ বসুর সাথে কোন মিল নেই। জগদীশ বসু ঠাণ্ডা কোমল মনের মানুষ ছিলেন। জগানন্দ বিজ্ঞান পড়ান, কিন্তু বিজ্ঞানে কোন রস পাওয়া যায় না, তার কাঠের ভাষার বিজ্ঞান আমাদের আকর্ষণ করে না। তিনি খুব কঠোর, এমন কঠোর শিক্ষক আমাদের স্কুলে আর দুটি নেই, তিনি চোখের দিকে তাকালে আমাদের অনেকের প্যান্ট নষ্ট হয়ে যায়। তার কঠোরতার জন্য বিজ্ঞান আমাদের কাছে বিভীষিকা হয়ে দেখা দিয়েছে। তার দর্শন হচ্ছে কাজ আদায় করা, মায়া মহব্বত দেখানো নয়। এমন ভয়ংকর শিক্ষক ব্যক্তি জীবনে বিরাট ফাজিল কেমন ফাজিল তার কাজকর্ম না দেখলে বুঝা যাবে না।
বিজ্ঞান স্যার ক্রমাগত চিৎকার করছেন বুরহান কি হয়েছে এমন করছিস কেন। বুরহান বল কি হয়েছে, তোকে হাসপাতাল নিয়ে যাব, এই কেউ একটা রিক্সা নিয়ে আয়। ইতিমধ্যে স্কুলের প্রায় সবাই এসে মসজিদে ভিড় করেছে। রিক্সা আসার পূর্বেই ধর্ম স্যার মারা গেলেন বিজ্ঞান স্যারের কোলেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। একজন মোল্লা মালুর কোলে মারা গেলেন। আমরা দেখলাম এমন যে কঠোর বিজ্ঞান স্যার যার ভয়ে আমাদের প্যান্ট নষ্ট হয়ে যেত হাউমাউ করে কাঁদছেন, বিলাপ করছেন বুরহান চলে গেছে, আমার বুড়া চলে গেছে। তার নামাজটা কাজা রয়ে গেল।
সৈয়দ বুরহান উদ্দিন বুরহান শহরের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি মৌলভী ছিলেন, ধর্মের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। অনেকদিন পূর্বে তিনি একটা বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালক্রমে সেটি আজ বুরহান শহরে রূপ নিয়েছে। আমাদের ছোট মাওলানার নাম সৈয়দ বুরহান উদ্দিন, তিনি নিজেকে সৈয়দ বুরহানের উত্তরসূরি বলেন কিন্তু তার কাজকর্মে বুরহানের কোন চিহ্নই দেখা যায় না। ছোট মাওলানা কিছুটা ঢিলা টাইপ তিনি ধর্ম পড়ান কিন্তু আমরা ধর্ম শিখি না, তার ক্লাসকে আমরা নাটকের ক্লাস বানিয়ে ছাড়ি। তিনিও উপভোগ করেন, জীবন তার কাছে হাসিঠাট্টার মত। তিনি প্রায়ই বলেন যে জীবনে রস নাই সে জীবন কোন জীবনই না। আমাদের রসসিক্ত ছোট মওলানা ব্যক্তি জীবনে বিরাট ফাজিল তার ফাইজলামি না দেখলে বুঝা যাবে না।
আমাদের স্কুল স্কুলের মত, আর আমরা ছাত্রের মত। কখনো সুবোধ, কখনো ইবলিশের আব্বা। জগানন্দের ক্লাসে আমাদের চেয়ে সুবোধ পাওয়া যাবে না, বুরহানের ক্লাসে আমাদের দুষ্টামি ইবলিশ কে হার মানাবে।
সাত, আট ক্লাসের কিছু ছাত্র বিচ্ছু, ফাজিল হিসাবে কম ছিলাম না। জগানন্দকে আমরা ভয় পাই কিন্তু আড়ালে তাকে ঘাইয়াড়ি বলে ডাকি, বুরহানের নাম দিয়েছি লতা। প্রত্যেক শিক্ষকেরই নাম আছে যেমন প্রধান শিক্ষকের নাম মশা, সহ প্রধান শিক্ষক সন্দেশ, অর্থনীতি যিনি পড়ান তিনি সাধের লাও। আরেকজন শিক্ষক কে ডাকতাম অন্ড্রু কিশোর, তিনি দেখতে খুব সুদর্শন ছিলেন। আমাদের অফিস ক্লার্কের নাম দিয়েছিলাম অমাইগো (ও আম্মা)। আমাদের ম্যাডাম দুজনের মধ্যে একজনকে ডাকতাম মায়ালতা, অন্যজন চণ্ডী। চণ্ডী ম্যাডামের অসম্ভব রাগ ছিল তিনি বিজ্ঞান স্যারের মহিলা সংস্করণ ছিলেন।
আমাদের ফাইজলামী প্রবাদ পর্যায়ের ছিল একদিন কয়েক বিচ্ছু মিলে একটা চ্যালেঞ্জ নিলাম যদি প্রধান শিক্ষককে সামনা সামনি যদি মশা বলতে পারি তবে আমাদের ধনবান এক বন্ধু সিনেমা দেখাবে, লাভ ইন সিংগাপুর হলে চলছিল, ববিতা স্বপ্নের রানী, রানীকে একবার না দেখতে পারলে জন্মই বৃথা। চ্যালেঞ্জ নিলাম।
প্রধান স্যার মশার মতই ছিলেন কখন কোনদিন থেকে এসে হুল ফুটিয়ে যান টের পেতাম না। তাকে মাছি নামে ডাকলেও ভুল হত না, চারিদিকে চোখ সামনে তো প্রশ্নই নেই অগোচরে দুষ্টামি করেও পার পাওয়া যেত না।
দুতিন বন্ধু মিলে হেড স্যারের রূমে হাজির, অভিযোগ মশার অত্যাচারে ক্লাসে টিকা যাচ্ছে না। বিহিত করা হউক। আমি এক কাঠি সরেস ছিলাম এক ফাঁকে বললাম স্যার আপনার বাসায়ও নাকে ভয়ংকর এক মশা, আব্বাস ভাই বললো ম্যাডাম নাকি মশা তাড়াতে ধুন জ্বালিয়েছেন। স্কুলেও সেই ব্যবস্থা করেন স্যার মশার জন্য জীবন অতিষ্ঠ।
আমরা চলে এলাম পনেরো মিনিট পরেই তলব, গিয়ে দেখি আমাদের পিয়ন আব্বাসও আছে। হারামজাদা আমাদের জারিজুরি সব ফাঁস করে দিয়েছে, ক্লাসে কোন মশা নেই। আমরা যে স্যারকেই মশা ডাকি, বলে দিয়েছে। আজ স্কুলের পরে হারামজাদাকে দেখে নিবো। আব্বাসের সাথে আমাদের বেশ খাতির সে টিফিন চুরি করে, আমাদের ভাগ দেয়। বিভিন্ন স্যারদের ঘরের খবর আমাদের পৌঁছায়, সামান্য কোন ঘটনা রংচঙ লাগিয়ে বলে আমরা সেই ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমাদের মত গল্পে রূপ দেই আর হেসে মরি। হারামজাদা আব্বাস আমাদের সাথে গাদ্দারী করেছে তাকে দেখতেই হবে। হারামজাদাকে আমরা বন্ধু ভাবি আর আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।
হেড স্যার মশার সমাধান দেন, মশা ফুল পছন্দ করে না। ফুলের বাগান করলে মশা দূরে থাকবে, তাই আগামী পাঁচদিন আব্বাসের সাথে অফিস বিল্ডিং এর সামনে ফুলের বাগান করতে হবে। বেশ মশার সমাধান হয়ে গেল। মশা ফুল পছন্দ করে না কথাটা আমাদের কাছে অদ্ভুত ঠেকলো, বিশ্বাস হলো না। বুঝতে পারলাম স্যার শাস্তি দিচ্ছেন, যেহেতু সরাসরি দেয়া যাবে না তাই ঘুরিয়ে মশা ডাকার প্রতিশোধ নিলেন। হারামজাদা আব্বাস। আমাদের ধনবান বন্ধু সিনেমা দেখাতে অস্বীকার করলো, শাস্তি তার পছন্দ হয় নি। লাভ ইন সিঙ্গাপুর গেল, ববিতাও গেল, আম এবং ছালাও।
বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে আমরা ছোট মওলানার স্মরণাপন্ন হই, হেড স্যারের আদেশ উপেক্ষা মওলানার পক্ষে সম্ভব না তবে আমাদের আনন্দ দিতে তিনিও বাগান করবেন। ঘাইয়াড়ি স্যার এসময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ছোট মওলানা ডাক দিলেন 'এই জগা তুই কি আসবি ছেলেদের সাথে বাগান করতে?' জগানন্দ এমন চোখ রাঙালেন আমাদের মেরুদণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে গেল, ছোট মৌলানা কে বললেন 'ল্যাঠা এদেরকে বেশি লাই দিস না, বিচ্ছুদের মশা ভাজি করে খাওয়ানো উচিৎ। কতবড় পাজী এক একটা, স্যারকে মশা বলে ডাকে'। ছোট মৌলানা বললেন 'আচ্ছা মালু তুই যা তোর দরকার নেই আমরাই বাগান করে দেখিয়ে দেব'।
ল্যাঠা এবং মালুর ছোট একটা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। বিজ্ঞান স্যার মওলানাকে ল্যাঠা ডাকেন শব্দটায় কিছুটা ব্যঙ্গ থাকলেই এটা আন্তরিকতার ডাক। ল্যাটা সৈয়দের সংক্ষিপ্ত হচ্ছে ল্যাটা, অর্থ প্রকৃত সৈয়দ নয় ধারকৃত সৈয়দ। মওলানা স্যার বুরহান উদ্দিনের উত্তরসূরি হিসাবে নিজেকে হাজির করেন, আর বিজ্ঞান স্যার বলেন 'তোরা বোগদাদী সৈয়দ না তোমার ল্যাটা মুচি, চামার থেকে মুসলমান হয়ে সৈয়দ লাগিয়েছিস, প্রকৃত সৈয়দের ধারেকাছেও তোরা নাই।' প্রতিউত্তরে মওলানা বলেন 'আমি যেভাবেই হই সৈয়দ, মুসলমান, বেহেস্তী। তুই মালাউন, মালু দোযখী। নরক ছাড়া তোর কোন গতি নেই।'
এমন উত্তর প্রতিউত্তরে একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড হয়ে যাওয়ার কথা, রক্তারক্তি হয়ে যাওয়ার কথা, ধর্ম যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। নিজের ধর্মের অবমাননায় শহীদ হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু এর কিচ্ছুই হয় না। কারণ দুজনেই জানেন এসব মনের কথা না, কেউ কাউকে আঘাত করার জন্য বলছেন না, হেয় করার জন্য বলছেন না। কোন ধর্মকে ছোট করার জন্য বলছেন না। বিজ্ঞান এবং ধর্ম স্যার জিগরি দোস্ত, তাদের মধ্যে হাতাহাতি হতেও দেখেছি। পর ক্ষণেই এক স্যান্ডুইচ দুজনে ভাগ বাটোয়ারা করে খেয়েছেন। স্বাভাবিক সময়ে তারা একজনকে জগা, আরেকজনকে বুরা বলে ডাকেন। শুধু ঠাট্টার সময় তাদের তাদের ডাক বদলে ল্যাটা আর মালুতে পৌঁছায়। তাদের বন্ধুত্ব বর্ণনা করা অসম্ভব চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
তাদের বন্ধুত্ব বর্ণনা করা অসম্ভব। ক্লাস এইটের ফাইনালের সময় বিজ্ঞান স্যার আমাদের বললেন স্কুল ছুটির পরে এক্সট্রা ক্লাস করাবেন। বিজ্ঞান বিভীষিকা, বিজ্ঞান স্যার বিভীষিকাময়। তবু আমরা বিজ্ঞানে মন্দ না, কমবেশি সবাই পাশ মার্ক পেয়ে যাই, স্যারের ভয়ে বাধ্য হয়ে শিখতে হয়। অন্য ক্লাসে ফাঁকি দিলেও বিজ্ঞান স্যারের ক্লাসে ফাঁকিজুঁখি চলে না। স্কুলের পরে ক্লাস মানেই আমাদের খেলা খতম, খেলার জন্য সময় কম। তবু স্যারকে না করার সাহস আমাদের নেই। স্কুল ছুটির পরে জগানন্দ ক্লাস নিতে এলেন, দেখলেন ছোট মওলানা আমাদের সাথে বসে আছেন 'বুরা তুই এখানে', 'তুই একা যেতে ভয় পাবি বলে থেকে গেলাম' মওলানা স্যার বললেন। 'আচ্ছা চুপচাপ বসে থাক, একেবারে কথা বলবিনা' বলে বিজ্ঞান স্যার ক্লাস শুরু করলেন। দশ পনেরো মিনিট চুপচাপ বসে থেকে মওলানা স্যার বললেন 'গজা তুই মরা মানুষের মত পড়াচ্ছিস কেন, ফুলের পরাগায়ন পড়াচ্ছিস একটু রসকষ লাগিয়ে পড়া, তোর কথায় মনে হচ্ছে পাথর ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে যাওয়ারকথা বলছিস'। বিজ্ঞান স্যার ক্ষেপে গেলেন বললেন 'তোকে কথা বলতে না করলাম, কথা বলছিস কেন। তুই বিজ্ঞানের কি বুঝিস তুই তো মোল্লা, বিজ্ঞানে মূর্খ ছিলিস বলেই মোল্লা হয়েছিস'। মওলানা স্যার দ্বিগুণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন 'ধর্ম নিয়ে কথা বলবি না, ধর্ম নিয়ে কথা বলবি না, ব্যাটা মালাউন নাস্তিক'। আমাদের সামনেই ঝগড়া সমানতালে চলতে থাকলো।
ঝগড়ার ফাঁকেফাঁকে যা শিখলাম তা না মন্দ না, তবে আনন্দ পেলাম অনেক গুণ। তাদের ঝগড়া খেলার চেয়েও মজাদার মনে হল। ৪৫ মিনিট কেটে গেল। আমরা গেলাম বাসার পথে লতা, ঘাইয়াড়ি গেলেন তাদের পথে।
ক্লাস নাইনে প্রমোশন পেয়ে আমরা আরো সাব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমাদের দুরন্তপনা বহুগুণ বেড়ে গেল, ক্লাসের চেয়ে সামনের মাঠ বেশি ডাকতে লাগল। লেখাপড়া ধুলায় পড়ে রইল। তবে বিজ্ঞানের ভীতি মন থেকে গেল না, বিজ্ঞান স্যার বিভীষিকা হয়ে থেকে গেলেন। পক্ষান্তরে মওলানা স্যারের কাছে ধর্মের চেয়ে ছড়া, কবিতা, নাটক বেশি করে শিখতে লাগলাম।
স্কুলের বার্ষিক বনভোজনে এবার শ্যামলী নির্ধারণ হল, আমরা খুব খুশি। শুনেছি শ্যামলীতে বনজঙ্গল ছাড়াও ক্ষুদ্র একটা ঝর্ণা আছে, পানিতে ঝাপাঝাপি করা যাবে ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।
বনভোজনে আমরা হইহুল্লোড় করে বেরাচ্ছি, একদিনের স্বাধীনতা যেভাবে উপভোগ করা যায়। বিজ্ঞান স্যারকেও খুব একটা তোয়াজ করছি না, ধর্ম স্যার আমাদের মত মৌজে আছেন। এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ি করছেন যেন আমাদের সমবয়সী। আমরা সবাই ঝর্ণার পাড়ে নামবো নামবো না ভেবে উশখুশ করছি। হঠাৎ বিজ্ঞান স্যার এলেন, ধর্ম স্যারকে ডেকে বললেন 'বুরা এদিকে আয়', পাঞ্জাবি পাজামা পরিহিত ধর্ম স্যার যেই এসে পাশে দাঁড়ালেন বিজ্ঞান স্যার ধাক্কা দিয়ে ঝর্ণায় ফেলে দিলেন, আমাদের সামনেই। আমরা অবাক, ধর্ম স্যারের পাজামা পাঞ্জাবি বালি কাদা পানিতে একাকার। হতভম্ব মওলানা একটু সামলে নিয়ে, 'তবেরে মালু' বলে ঝর্ণা থেকে উঠে এসে ঘাইয়াড়ি কে জড়িয়ে ধরলেন তারপর লতা-ঘাইয়াড়ি মিলে জল কাদায় হস্তী যুদ্ধ হয়ে গেল। আমরাও নেমে পড়লাম যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে সবাই জয়ের আনন্দে মেতে উঠলাম।
ঝর্ণার জলকেলি শেষ হলে দেখা গেল মওলানা স্যারের পড়ার কোন কাপড় অবশিষ্ট নেই, তিনি অতিরিক্ত কাপড় আনেন নি। ভিজা পাজামা পাঞ্জাবি পড়ে থাকা অসম্ভব, শুকাতে হবে, কিন্তু কিভাবে! বিজ্ঞান স্যার পুনরায় এগিয়ে এলেন ধর্ম স্যার কে উদ্দেশ্য করে বললেন 'তুই বেওকুফ যে অতিরিক্ত কাপড় আনবি না আমি জানতাম, এই নে' বলে একখানা ধুতি এবং সার্ট ছুড়ে দিলেন। ধর্ম স্যারের কাপড় শুকানোর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বন্ধু দেওয়া কাপড় পরিধান করে রইলেন।
আমরা খেতে বসলাম বিজ্ঞান স্যার, ধর্ম স্যার পাশাপাশি দেখলাম একে অন্যের প্লেট অনায়াসে শেয়ার করছেন। ফেরার পূর্বে দুজনের আবার ঝগড়া, ধর্ম স্যার বিজ্ঞান স্যারের কাপড় ফেরত দিচ্ছেন না, বলছেন ধুয়ে পরে ফেরত দিবেন বিজ্ঞান স্যার বলছেন ধুতে হবে না এমনি দিয়ে দে। তাদের ঝগড়া গাড়ি পর্যন্ত গড়াল।
আমাদের স্কুল জীবনে বেড়াল ইঁদুরের এই ঝগড়া খুব আনন্দ দিয়েছে, অবশ্য কে বেড়াল কে ইঁদুর কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোনদিন নিতে পারি নি। ঝগড়ায় দুজনই সমানে সমান ছিলেন।
ক্লাস নাইন শেষ করে আমরা এস এস সি পরীক্ষার্থী, পড়ালেখা চাপ অসম্ভব বেড়ে গেছে দুরন্তপনা কিছুমাত্রায় কমে এসেছে। ধর্ম স্যার, বিজ্ঞান স্যার অবশ্য আগের মত, এখন ঝগড়া একটু পরে গলাগলি। সামনে টেস্ট পরীক্ষা ভালভাবে পাশ করতে হবে ভেবে একটু ধর্মকর্ম শুরু করেছি। যোহরের নামাজ স্কুলের মসজিদে আদায়ের চেষ্টায় গেছি, স্কুলের চাপকলে অযু করে বারান্দায় উঠবো দেখি ধর্ম স্যার আসছেন। তিনিও অযু শেষ করে বারান্দায় উঠে এলেন, যোহরের সুন্নত শেষ করে ফরযের অপেক্ষায় আছি আকামতের পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ দেখি ধর্ম স্যার দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেছেন। দৌড়ে তাকে ধরতে গেলে দেখি হাত পা খিচুনি দিচ্ছে, মুখ দিয়ে গোঙ্গানির শব্দের সাথে ফেনা বেরুচ্ছে। ভয় পেয়ে গেলাম দৌড়ে টিচার্স কমনরুমে গিয়ে বিজ্ঞান স্যারকে ডাক দিলাম তিনি দৌড়ে এলেন কোন ইতস্ততা না করেই মসজিদে ঢুকে বিজ্ঞান স্যারের মাথা কোলে নিয়ে আমাকে বললেন পানি নিয়ে আসতে। আমি বদনা দিয়ে চাপকল থেকে পানি নিয়ে এসে দেখলাম ধর্ম স্যারের মুখ ফেনায় ভরে গেছে তিনি শক্ত করে বিজ্ঞান স্যারের হাত ধরে আছেন। বিজ্ঞান স্যার ক্রমাগত চিৎকার করছেন বুরহান কি হয়েছে এমন করছিস কেন। বুরহান বল কি হয়েছে, তোকে হাসপাতাল নিয়ে যাব, এই কেউ একটা রিক্সা নিয়ে আয়। ইতিমধ্যে স্কুলের প্রায় সবাই এসে মসজিদে ভিড় করেছে। রিক্সা আসার পূর্বেই ধর্ম স্যার মারা গেলেন বিজ্ঞান স্যারের কোলেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। একজন মোল্লা মালুর কোলে মারা গেলেন। আমরা দেখলাম এমন যে কঠোর বিজ্ঞান স্যার যার ভয়ে আমাদের প্যান্ট নষ্ট হয়ে যেত হাউমাউ করে কাঁদছেন, বিলাপ করছেন বুরহান চলে গেছে, আমার বুড়া চলে গেছে। তার নামাজটা কাজা রয়ে গেল।
আমাদের স্কুলের দিন শেষ হয়ে এল, শেষ কিছুদিন স্কুল নিরস ছিল। বিজ্ঞান, ধর্মের রসের অভাবে মনমরা দিন কেটেছে। আমাদের মত বিজ্ঞান স্যারের জীবনও নিরস হয়ে গেল তিনি আরলি রিটায়ারমেন্টে চলে গেলেন।
(ঘাইয়াড়ি- পিঠা ভাপের জন্য তৈরীকৃত বিশেষ বাসন। লতা- কচুর লতি।)
আবু মকসুদ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি ও সাংবাদিক
খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়