তানজিনা হোসেন
প্রকাশিত: ১৩:৫১, ৯ মে ২০২০
আপডেট: ১৪:১৪, ৯ মে ২০২০
আপডেট: ১৪:১৪, ৯ মে ২০২০
সাংবাদিকরা ভালো থাকুন
পর পর কয়েকজন সাংবাদিকের আকস্মিক করোনাজনিত মৃত্যু মিডিয়া জগতকে শোকাহত করে তুলেছে। স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশ এর পর সাংবাদিকদের মধ্যে আক্রান্তের হার বাড়ছে। এমনকি অপেক্ষাকৃত কমবয়সী দুজন মৃত্যুবরণও করেছেন। শুরু থেকেই আমাদের সাংবাদিকদের খুবই অরক্ষিত আর অসচেতন মনে হয়েছে আমার। কয়েকবার লিখেছিও এ নিয়ে। করোনা প্যানডেমিক এর কভার করা এযাবত আর সব অভিজ্ঞতার চাইতে আলাদা। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য যেমন, তেমনি সাংবাদিকদের জন্যও সিডিসি ( সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রল) ও সিপিজে র ( কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট) সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে এ নিয়ে। এখানে কেবল কিছু বিষয়ে সতর্কতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি।
১. মাস্ক আর গ্লাভস পরলেই ভাববেন না যে নিরাপদ থাকছেন। আপনি যদি একজন করোনা আক্রান্ত বা করোনা বাহকের কাছাকাছি থাকেন বা তার সাথে কথা বলেন এই মাস্ক আপনাকে বিন্দুমাত্র প্রতিরক্ষা দেবে না। তাহলে? যে কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলার সময় অন্তত ৬ ফুট দূরে থাকুন। মুখোমুখি না বসে বা দাড়িয়েঁ একটু কোনাকুণি করে দাঁড়ান। বক্তাকে মাস্ক পরতে বলুন আর আপনিও পরুন। চিকিৎসকরা ক্লোজ কনটাক্ট এ যান ও প্রসিডিউর করেন বলে তাদের এন৯৫ মাস্ক লাগে। কিন্তু সাংবাদিকের তা লাগবে না। সিডিসি বরং কাপড়ের তৈরি মাস্ক পরতে বলেছে যা আবার ধুয়ে ব্যবহার করা যায়। সার্জিকাল মাস্কও পরতে পারেন কিন্তু এই মাস্ক ২ ঘন্টার বেশি টানা ব্যবহার করা যাবে না। রিইউজ করা যাবে না। একজনের ইন্টারভিউ করা হয়ে গেলে আরেকটা নতুন পরতে হবে। ঘেমে ভিজে গেলেও পালটাতে হবে। সেজন্য আপনার এক দিনে অনেকগুলো মাস্ক লাগতে পারে।
মাস্ক পরা আর খোলার সঠিক নিয়ম মানুন। পরা আর খোলার আগে পরে হাত সাবান পানি দিয়ে ধুতে হবে। মাস্কে হাত দেয়া যাবে না। মাস্ক কিছুক্ষণ গলায় নামিয়ে রেখে আবার পরা যাবে না। খোলার সময় পেছনে স্ট্রিপে হাত দিয়ে খুলতে হবে, মাস্কে হাত দিবেন না। গ্লাভস খোলার সময় সবচে বেশি সংক্রমণের ঝুকিঁ। গ্লাভস খোলার সঠিক নিয়ম শিখে নিন যা ইউটিউবে আছে। গ্লাভস পরা হাত নাকে মুখে কিছুতেই লাগানো যাবে না। ভাল হয় যদি মাস্কের ওপর ফেস শিল্ড পরতে পারেন। চোখ আর চুল ঢেকে রাখা ভাল। জুতো এমন হলে ভাল যা কাজ শেষে ধুয়ে ফেলা যায়। অথবা শু কভার পরুন ও পরে ফেলে দিন। পিপিই পরে মাঠে কাজ করা কষ্টকর আর পিপিই খোলা ও পরার নিয়ম জটিল যা এত সহজে রপ্ত হবে না। সামান্য ভুলে সংক্রমণের ঝুকিঁ আরও বাড়বে। এত কিছুর পরও বার বার সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে ভুলবেন না।
২. ব্যক্তিগত বাইক ব্যবহার করা ভাল। চড়ার আগে আর ফেরার পর বাইক অ্যালকোহল স্প্রে দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। গণপরিবহন, রিকশা, সিএনজি যাতে আরো মানুষ উঠেছে তা থেকে সাবধান। যদি অফিসের নিজস্ব গাড়ি থাকে যা শেয়ার করতে হয় সেটাও জীবাণুনাশক দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। দুরত্ব বজায় রেখে বসবেন। জানালা খুলে দেবেন। কারো সাথে কথা বলতে বা ইন্টারভিউ করতে হলে বদ্ধ ঘরের ভেতর না করে বাইরে আউটডোরে এসে করুন। অবশ্যই দুরত্ব বজায় রেখে।
৩. ক্লিপ মাইক নয়, ফিশপোল মাইক ব্যবহার করুন। প্রতি এসাইনমেন্টের পর এটা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। সাথে সব সময় ৭০% অ্যালকোহল তরল বা এন্টিমাইক্রোবিয়াল ওয়াইপ রাখবেন। আউটডোর কাজের সময় ইকুইপমেন্ট আশে পাশে ফেলে রাখবেন না। কাজ শেষে সরাসরি একটি কেসে বা পলিথিন ব্যাগে ভরে ফেলুন পরিস্কার করে। টিমে দুজনের বেশি মানুষ দরকার নেই। একা হলে আরো ভাল। প্রায়ই দেখি সাক্ষাৎকার দাতার মুখের সামনে ধরা মাইক আবার নিজের মুখের সামনে এনে কথা বলছেন। এতে সাক্ষাৎকার দাতার শ্বাসের সাথে নির্গত ড্রপলেট আপনার নাক মুখের সংস্পর্শে চলে আসতে পারে। তাই দুটো মাইক ব্যবহার করা ভাল। ইয়ারপিস বা ইয়ার প্লাগ কখনোই শেয়ার করা যাবে না।
৪. যতটা সম্ভব ফেস টু ফেস এড়িয়ে চলতে হবে। টেলিফোন, ইন্টারনেট, জুম, মেসেনজার ব্যবহার করে যদি পারা যায় সে চেষ্টাই করুন। পত্রিকা বা মিডিয়া অফিসের যত কম সংখ্যক কর্মীকে এক্সপোজ করা যায় তত ভাল। ব্যাক আপ রাখুন। একজন অসুস্থ হলে আরেকজন হাল ধরবে। সবাই একসাথে অসুস্থ হলে চলবে না। দু একটি পত্রিকার কর্মীরা প্রায় শতভাগ বাড়িতে থেকে কাজ করছেন। এটা প্রশংসার দাবিদার। কারণ এটাই স্মার্টনেস। তবে ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় তা সব সময় সম্ভব নয়। অতি উৎসাহে ঝুকিঁপূর্ণ স্থানে প্রবেশ করবেন না বা একটি ভাল স্ন্যাপের জন্য ঝুকিঁ নেবেন না। যুদ্ধের ময়দানে গোলাগুলির সময় খোলা মাঠে দৌড়ালে সেই সৈনিককে কেউ হিরো বলে না, স্টুপিড বলে। তাই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ান। স্মার্ট কভারেজ এ যান।
৫. সিপিজির নির্দেশনা অনুযায়ী প্যানডেমিকের সময় যে জায়গাগুলোতে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া যাবে না: হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটি, বৃদ্ধাশ্রম, রিফিউজি ক্যাম্প, ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি, কোন অসুস্থ ব্যক্তির কাছে, অন্তস্বত্তা নারীর কাছে, মর্গ বা মরদেহ সৎকারের স্থান ইত্যাদি। আপনি অন্য আরেকজনের জন্য ঝুকিঁপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন এমনকি অন্য আরেকজনের মৃত্যুর কারণ হতে পারেন। কেননা সারাদিন আপনাকে অনেক জায়গায় যেতে হয় বলে আপনার করোনা বাহক হবার সম্ভাবনা বেশি। তাই নাজুক স্বাস্থ্যের মানুষদের কাছে যাবেন না।
৬. অফিসে প্রবেশের আগে অবশ্যই বাইরের মাস্ক গ্লাভস, মাইক কভারিং ডিসপোজ করতে হবে। ব্যবহৃত সব বর্জ্য একটা পলিথিনে ভরে মুখ ঢেকে যথাস্থানে ফেলতে হবে। অফিসের ল্যাপটপ বা কম্পিউটার, মাউস ইত্যাদি কাজ শুরুর আগে জীবাণুমুক্ত করে নেবেন। কাজ শেষে ওঠার আগে আবার জীবাণুমুক্ত করে নিন। লাইভে বা রেকর্ডিং এ যাবার আগে অন্যের হাতে মেক আপ নেবেন না। অফিসে পারস্পরিক দুরত্ব বজায় রেখে বসতে হবে। লিফট ব্যবহারের সময়ও তাই। অফিসের আইডি কার্ড পাঞ্চ করার পর জীবাণুমুক্ত করুন।
৭. সংবাদমাধ্যমগুলোর উচিত প্যানডেমিক কভার করা সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় সব্বোর্চ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। প্রতিদিনকার ব্যবহারের পর্যাপ্ত মাস্ক, গ্লাভস, জীবাণুনাশক, ইকুইপমেন্ট কভারিং ইত্যাদি অফিস থেকেই সরবরাহ করতে হবে। ঝুকিঁ ভাতার বিষয় বিবেচনা করা দরকার। একজন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেলে সাথে সাথে তাকে ছুটি দিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা অফিসের কর্তব্য।
৮. ফিল্ড রিপোর্টাররা বাড়িতে অন্যদের থেকে আলাদা থাকুন। বাড়ি ফিরে সব কাপড় চোপড় গরম পানি সাবান দিয়ে নিজেই ধুয়ে ফেলবেন। চশমা পরিস্কার করুন। বাইরে যাবার সময় হাতঘড়ি, অর্নামেন্ট নেবেন না। মানিব্যাগ ও জরুরি কাগজপত্র একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে নেবেন আর সেই ব্যাগ ফেলে দেবেন। সময়মতো খাবার খেতে ও বিশ্রাম নিতে ভুলবেন না। বাইরে খাবার অভ্যেস বাদ দিন। চিকিৎসকরাও যখন সুরক্ষা সামগ্রী পরে ডিউটি করেন তখন খাওয়া দাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এতে সংক্রমিত হবার ঝুকিঁ থাকে। প্রচুর পানি পান করুন। সাংবাদিকেরা একটু ইনডিসিপ্লিনড জীবনে অভ্যস্ত। আর তাদের অনেকেই ধূমপায়ী। অনেকেই নিজের রক্তচাপ, সুগার জীবনে কখনো মাপেন নি। নিজের সম্পর্কে মোটেই যত্নবান নন। কিন্তু কোভিড-১৯ আমাদের শিখিয়েছে যে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট।
তাই সতর্ক থাকুন ও ভালো থাকুন। মনে রাখবেন, জীবনের চাইতে জীবিকা কিছুতেই মূল্যবান নয়।
লেখক: চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক
আরডি/আইনিউজ
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়