তিলোত্তমা শিকদার
প্রকাশিত: ১৫:২৪, ১০ মে ২০২০
আপডেট: ১৬:৩৯, ১০ মে ২০২০
আপডেট: ১৬:৩৯, ১০ মে ২০২০
মা দিবসের ভাবনা
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতাটি আমরা পড়েছি। মাকে নিয়ে এমন বীরোচিত স্বপ্ন কে না দেখেছে। জম্মের পরে যার সাথে আমাদের সবচেয়ে বেশি মিতালি, সবচেয়ে বেশি আপন মনে হয় তিনি আমাদের মা। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর "ম্যারিজ এন্ড মোরালস" বইয়ে বলেছেন, মাতৃত্ব সহজাত প্রবৃত্তি, পিতৃত্ব সহজাত নয়। সেজন্য প্রকৃতির কিছু ব্যতিক্রম বাদে সর্বত্র দেখা যায় সন্তানের জন্য মায়েরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না।
সীমা সরকার, বিবিসির জরিপে পৃথিবীর একশো অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর একজন যিনি তাঁর আঠারো বছর বয়সী প্রতিবন্ধী সন্তানকে কোলে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। সন্তানের জন্য সম্ভব এমন কিছু নেই যা তিনি করেননি। দুঃখ, কষ্ট, দুর্দশা, লাঞ্ছনা সহ্য করে সন্তানকে লালন-পালন করে চলেছেন। পৃথিবীতে মায়ের জাতটাই এরকম। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মেয়েরা দুই জাতের। এক জাতের যারা "মা" তাদেরকে তিনি তুলনা করেছেন বর্ষাঋতুর সাথে কারণ মায়েরা বর্ষাঋতুর মতো জলদান করেন, ফলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, ঊর্ধলোক থেকে আপনাকে দেনবিগলিত করে, দূর করেন শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব।
সংস্কৃত মাতা> মাআ> মা – ছোট্ট একটা শব্দ কিন্তু কি বিশাল তার পরিধি! বিবিসির জরিপে সারা পৃথিবীতে বহুল ব্যবহৃত শব্দের শীর্ষ শব্দটিই ‘মা’। মার অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়৷ আজকের আমি আপনি যাই আছি সেটা মায়ের কারণে। পৃথিবীতে ভালবাসার জন্য মানুষ অনেক কিছু করতে পারে, মানুষের সব চেয়ে প্রিয় জিনিস তার জীবন কিন্তু একজন মানুষ ‘’মা” যে সন্তানের ভালর জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিয়ে দিতে পারে।
প্রতিটি মা তার সন্তানের কাছে জগতের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়― সেরা মানুষ। পৃথিবীতে কুসন্তান থাকলেও কু-মাতা একজনও নেই। শুধু এই সমাজ নয় প্রতিটি ধর্মও মাকে দিয়েছে অনন্য সম্মান।
উপনিষদে পড়েছিলাম, ‘‘মাতৃ দেব ভব'' অর্থাৎ মা জীবন্ত ঈশ্বরী৷ ইসলাম ধর্মে মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে বলা হয়েছে ‘মায়ের পায়ের নীচে বেহেস্ত'। খ্রিষ্টধর্মেও মাকে সম্মান দিয়ে বলা হয়েছে ‘মাদার মেরির' ৷ মা তার সন্তানের জীবনে এত প্রভাব ফেলেন যে একজন আদর্শ মায়ের অভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতি বিপন্ন হতে বাধ্য। সন্তানের জীবনের চরম সংকটকালে পরম সান্ত্বনা ও ভরসার স্থল হিসেবে যার কথা প্রথম মনে পড়ে তিনি মমতাময়ী মা। মা কোন দিন হিসেব করেনা যে সন্তান থাকে ভালবাসে কিনা, শুধু ভালবাসা দিয়েই যায়। এই ব্যপারটা আমি দেখেছি আমার মায়ের মাঝে। বিশ্বাস করি এমনই হয় সব মা। অন্যের মাকে আলাদা করে জানার কিছু নেই। নিজের মাকে জানলেই জগতের সকল মাকে জানা হয় । মা কোন প্রাপ্তির আশায় বসে থাকেননা। সৃষ্টির সব চেয়ে সুন্দর উপহার আমাদের মা কিন্তু নারী ।
মাতৃত্ব নারীর অহংকার। কিন্তু মায়েরা নারী হওয়ার কারণে আজ নিগৃহীত বঞ্চিত লাঞ্ছিত। সেজন্যে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শ্রেষ্ঠ শহিদের নাম মা। বাংলার মায়েদের অবস্থান উঠে এসেছে তাঁর "আমাদের মা" কবিতায়।
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
.............................
..............................
..............................
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।
শামসুর রাহমান তাঁর "কখনো আমার মাকে" কবিতায় তুলে এনেছেন বাংলার মায়েদের নিভৃতে দুঃখ-কষ্টের জীবন।
"যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক'রে আজীবন, কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে"!
অথচ এই মায়ের কত যে ক্ষমতা তা সহজে বুঝিয়ে নেপোলিয়ন বলেছিলেন ‘’তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো’’।
মা দিবসে স্বাভাবিক ভাবে মনে প্রশ্ন আসে এত ত্যাগ যে করতে পারে, এত ক্ষমতা যার তার জন্য কিনা বছরে একটা মাত্র দিন মাত্র! তবে শুধু একটা দিন বলে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়৷ অন্তত একটা দিন তো মায়ের কথা, তাঁর সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবেন বিশ্ববাসী৷ হয়তো এই কারণেই মা দিবস প্রতিষ্টা করেছিলেন আন্তর্জাতিক "মা" দিবসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আন্না জেবরিস । আন্না জেবরিস অবিবাহিতা এবং নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি তাঁর মায়েদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য একটা দিন উদযাপনের চেষ্টা করেন। প্রথম "মা" দিবস উদযাপন করা হয় ১৯০৮ সালে এন্ড্রুজ মেথডিস্ট চার্চে। তার দুই বছর পরে ১৯১০ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়া দিনটিকে ছুটি ঘোষণা করে আইন পাশ করে। ১৯১৪ সালে কংগ্রেস মে'র দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
নারীর ক্ষমতায়ন যত বৃদ্ধি পাবে তত মায়েরও ক্ষমতা , মর্যদা বৃদ্ধি পাবে। একজন মমতাময়ী মা কিভাবে একটা দেশকে বদলে দিতে পারেন তার প্রমাণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মা দের ক্ষমতায়ন এবং তাদের সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য বর্তমান সরকার যা করেছে তার বাংলাদেশের ইতিহাসে কেউ করেনি বা কল্পনাও করতে পারেনি। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ তাই বিশ্বে রোল মডেল। আর এই নারীর ক্ষমতায়ন মানেই মায়ের ক্ষমতায়ন ।
সবাইকে মা দিবসের শুভেচ্ছা। সবার মা ভাল থাকুক। আমার মায়ের জন্য আশীর্বাদ করবেন ।
তিলোত্তমা শিকদার: সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্য ডাকসু, উপ-সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়