আবু মকসুদ
লিল্লাহ এবং গণ্ড উপস্থাপক
আমি বিলেতের বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল দেখি না, আগ্রহ পাই না। ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬১ দিন চ্যানেলগুলো লিল্লায় ব্যস্ত থাকে। ধর্ম বিক্রির এমন বাজার আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ছেলেবেলায় অফিস পাড়ায় মামুলি ম্যাজিক দেখিয়ে যে ফুটপাত কবিরাজ বেহেস্তের টিকেট বিক্রি করতো কালের বিবর্তনে সেই কবিরাজ মৌলানা, আল্লামা হয়ে টিভির স্ক্রিন দখল করে নিয়েছে।
এখানেও কথার ফুলঝুরি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়, এখানেও ধর্মের ম্যাজিক দেখিয়ে মানুষের সর্বস্ব লুটে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। অফিস পাড়ার দরিদ্র ম্যাজিশিয়ান পেটের দায়ে হয়তো স্বপ্নদোষ কিংবা দাঁতের মাজনের ঔষধ বিক্রি করত, বেহেশতের টিকেটের মিথ্যা লোভ দেখিয়ে নিজের পরিবারের অন্নসংস্থান করত। তার এসব ভন্ডামি হয়তো মাফ করে দেয়া যায়, দরিদ্রতা মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু করায়। বিলেতের টিভি স্ক্রিনের জোচ্চোর ধর্মব্যবসায়ীরা দরিদ্র নয়, বরং অর্থে বিত্তে সাধারণ মানুষের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে, তবু ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা লোভ তাদের পরিপূর্ণ মানুষ হতে বাধা দিচ্ছে।
নিজেদের লোভ-লালসা চরিতার্থ করতে লিল্লার আশ্রয় নিচ্ছে, দরিদ্র মানুষদের ধর্মবিশ্বাস, অসহায়ত্ব পুঁজি করে, ধর্ম বিক্রি করে তারা নিজেদের প্রবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। মানুষ সাধারণত ধর্মপরায়ণ হয়, ধর্ম আঁকড়ে ধরে মানুষ শেষ পথ পাড়ি দিতে চায়। ধর্মপালন অত্যন্ত সহজ এবং সাধারন, মানুষের চলমান জীবনে ধর্ম কোনো সংঘাত সৃষ্টি করে না বরং জীবনকে সহজ স্বাভাবিক ভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। কিন্তু জোচ্চোর সব ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের সহজ স্বাভাবিক জীবনকে ধর্মের ভয়ে রূপান্তরিত করে ফায়দা লুটে। মানুষের জীবনকে অহেতুক জটিলতায় পরিপূর্ণ করে।
মানুষের সহজ সাধারণ জীবনকে ধর্মের বিভ্রান্ত মোড়কে উপস্থাপন করে, মানুষকে বিভ্রান্ততায় জর্জরিত করে। জোচ্চোরদের কুটিলতা পূর্ণ কথাবার্তায় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক সাধারণ, সহজ মানুষ পারিবারিক কিংবা সামাজিক বিভিন্ন জটিলতায় পতিত হয়। ধর্মকে পুঁজি করে এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা জেনে শুনে মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়।
এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা দান দক্ষিণাকে ধর্মের প্রতিরূপ হিসেবে হাজির করে, ধর্মের প্রধান অনুষঙ্গ যেমন নামাজ-রোজা এদের কাছে গুরুত্ব পায় না শুধু মসজিদ নির্মাণ, এতিমখানা নির্মাণ, কুরআনে হাফেজ, আর পানির কল বসানো এদের কাছে ধর্ম। আপনি নামাজ রোজা না করেও বেহেশতের অধিকারী হবেন যদি সোমালিয়ায় কোন কল বসাতে পারেন। আপনার জন্য বেহেশত নিশ্চিত, নামাজ কালাম এর প্রয়োজন নাই শুধু একজন হাফেজের এক বৎসরের দায়িত্ব নিলেই দৌড়ে বেহেস্তে চলে যেতে পারবেন। দান দক্ষিণা ঘর থেকে শুরু করতে হয়, ছেলেবেলা থেকেই এই শিক্ষা আমরা পেয়ে এসেছি কিন্তু এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা টিভি স্ক্রিনে বিপরীত শিক্ষা নিয়ে হাজির হয়েছে।
ধর্মব্যবসায়ীরা শিক্ষা দিচ্ছে প্রতিবেশী কেউ অভুক্ত থাকলেও তার দিকে নজর না দিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার মাইল দূরের কোন দেশের অচেনা কাউকে সাহায্য করার মধ্যে সওয়াব বেশি। নিজের বোন ভাই চাচা মামা অন্যান্য নিকট আত্মীয় স্বজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করলেও আপনার দান দক্ষিণা তাদের প্রাপ্য নয়, বেহেশতের টিকেট পেতে হলে আপনার গ্রাম থেকে একশ মাইল দূরের গ্রামে মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। আপনার জেলায় নয় অন্য জেলায় পানির কল বসাতে হবে, আপনার রক্তের সম্পর্কের মাঝে কেউ এতিম থাকলেও তার দায় দায়িত্ব আপনার নয় আপনি বিখ্যাত হুজুরের এতিমখানায় যদি দান না করেন বেহেশত আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। সহজলভ্য বেহেশতের জন্য আপনাকে অবশ্যই হুজুরের মসজিদ মাদ্রাসা এতিমখানায় দান করতে হবে।
বিলেতের বাংলা টিভি চ্যানেল গুলোতে দেখার মত কিছু থাকেনা, শিখার মত কিছু থাকেনা। এসব চ্যানেলের অনুষ্ঠান বা খবর এর মান ভালো থাকে না। এসব চ্যানেল গুলোর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের সরলতা কিংবা ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে তাদের বিভ্রান্ত করা। টিভি চ্যানেলের মালিকানার সুযোগে কোন কোন গণ্ডমূর্খ সমাজে নেতা বনে গেছে, জেল ফেরত প্রতারকও টিভি স্ক্রিনে বসে ভালো ভালো কথা বলে। মানুষকে সৎ উপদেশ দেয়, এসব মালিক কিংবা উপস্থাপকদের সংস্কৃতির মান এত নিম্ন থাকে যে টিভির সামনে বসে থাকা দর্শক নিজেই লজ্জিত হয়।
টিভির স্ক্রিনে কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয় ন্যূনতম এই জ্ঞান যার নাই সেও বিলেতে জনপ্রিয় উপস্থাপক।
সম্প্রতি একটা চ্যানেলের মালিক কাম উপস্থাপক যার অনুষ্ঠান দুমিনিট দেখা দোযখের যন্ত্রণার মতো, এমন এক বেফাঁস কথা বলেছে যা শুনে তাজ্জব হয়ে গেছি। এই উপস্থাপকের কথাবার্তা শুনে মনে হয় সে মানসিক ভাবে অসুস্থ, তার মুখ থেকে যা বেরোয় পাগলের প্রলাপের মত। আঞ্চলিক ভাষার চরম দুরবস্থা, এর আগে পরিলক্ষিত হয় নি। ভাষা যে এত নীচ এত অশ্লীল হতে পারে এই উপস্থাপকের কথা না শুনলে বুঝা যেত না। এই মূর্খের যদি সামান্যতম লজ্জা থাকে মাথা মুন্ডন করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইত। জীবনেও আর টিভি স্ক্রিনে আসবে না বলে মুকলেচা দিত।
আফসোস এই গণ্ড জানবে না যে টিভি স্ক্রিন তার জন্য নয়, আফসোস এই গণ্ড তার টিভিকে লিল্লার জন্য উন্মুক্ত করে দিবে, আফসোস এই গণ্ড এরপরেও ভিক্ষুক সেজে টিভি স্ক্রিনে লিল্লা চাইবে। একটা সম্প্রদায় কে অপমান করে কথা বলার জন্য এই গণ্ড উপস্থাপকের শাস্তি হওয়া উচিত, তাকে সমাজ থেকে প্রত্যাহার করা উচিত। তার টিভি চ্যানেলকে আজীবনের জন্য বর্জন করা উচিত। কিন্তু এসবের কিছুই হবে না কারণ বিলেতের বাঙালি সমাজে যেসব তথাকথিত নেতা আছে, সমাজের কর্ণধার আছে তারা সবাই টিভির স্ক্রীনের জন্য পাগল, তাদের এই পাগলামির সুযোগ গণ্ড উপস্থাপক নেয়।
এই গণ্ড তাদের জন্য মুলা ঝুলিয়ে রাখে, কথায় বার্তায় এই গণ্ড তাদেরকে অপমানিত করলেও তার পায়ের কাছে তথাকথিত নেতারা কুকুরের মত বসে থাকে। হয়তো একদিন বাঙ্গালীর আত্মসম্মান বোধ জাগ্রত হবে, হয়তো একদিন এই সব গণ্ড উপস্থাপক কিংবা টিভি মালিক বর্জিত হবে। আমাদেরকে ততদিন আশায় বসে থাকতে হবে...।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ