মুজাহিদ আহমদ
প্রকাশিত: ২০:২০, ১১ মে ২০২০
আপডেট: ২০:২৪, ১১ মে ২০২০
আপডেট: ২০:২৪, ১১ মে ২০২০
ভাড়ালে তুলছেন যেনো ধানের বদলে জহরত
খলা। খলা হলো—ধান কেটে মাড়াই বা সংগ্রহের প্রথম পর্যায়ের প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে তৈরি অস্থায়ী উঠোন। হাওরপাড়ের কৃষকেরা হাওরগর্ভে এরকম উঠোন তৈরি করেন। আউস—আমনের সময় গ্রামেও খলার ব্যবহার চোখে পড়ে। যদিও এই প্রচলন আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। হাওরে খলা তৈরি করতে হয়—মূলত: বাড়ি-ঘর দূরে থাকায় প্রতিদিনের কাটা ধান-খড় নিয়ে তো পাড়ে ভেড়া যায় না। কৃষকেরা হাওরেই রাত কাটান। দিনে ধান কাটেন। বিকেল থেকে মাড়াই কাজ করেন। আগে গরু-মহিষ দিয়ে মাড়াই কাজ করা হতো। এখন আর গরু, মহিষ দিয়ে মাড়াইকর্ম নাই বললেই চলে। মাড়াই মেশিন এসেছে। এখন মাড়াই মেশিনের যুগ। মেশিন দিয়েই মাড়াই দেওয়া হয়। রাতে মানুষ থাকেন উরা’য়। উরা মানে-ধানগাছ, ছাটাই, বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঝুপড়ি ঘর। বোরো মৌসুমেই এই উরা’র দেখা মেলে বেশি হাওরে। মানুষ প্রযুক্তির সাথে সমান তালে পা ফেলে সামনে অগ্রসর হচ্ছে—মহিষ, গরু দিয়ে ঘুরে ঘুরে ধান মাড়াই, ধান শুকানোর খলা, খলার এক পাশে অস্থায়ী বসতি উরাঘর এসব আস্তে আস্তে নাই হয়ে যাচ্ছে। এসবের যে একটা শিকড়মুখি আবেদন কিংবা এই সব কেন্দ্রিক উদযাপন আগামি প্রজন্মের জন্য আর থাকছে না। না থাকুক।—আমরা তো অগ্রসর হচ্ছি! এটাই আপাতত বড় কথা।
আগাম বন্যার ভয়ে ছৈইদ আলী [ছদ্মনাম] পুরো অর্ধমাস ধরে হাওরে ছিলেন।—পাড়ে ভিড়ছেন স্বপ্ন নিয়ে। কয়দিনের টানা খাটুনি, কম ঘুমের চোখ নিয়ে টলমল ঈষৎ পা টেনে টেনে বাড়ির দিকে আসছেন। এলোমেলো চুলদাড়ির মানুষটার হাতে এবছরের কাটা ধানের প্রথম গোছাটি। [আগের দিনের মানুষেরা বিশ্বাস করেন-বছরের প্রথম ধান গোছাটি যত্ন ও মমতার সাথে সংরক্ষণ করলে পরের বছর ভালো ফলন হয়।] মনে হচ্ছিল এখুনি পড়ে যাবেন বুঝি। হাড়জিরজিরে শরীর নিয়ে হাঁটছেন—তারপরও চোখ মুখে বেজায় তৃপ্তি। এবার ঝড়-বাদল ছুঁতে পারেনি ধান। বৃষ্টিতে না ভিজায়েই সব ধান নিয়ে বাড়ি ফেরা গেলো। মানুষটার ভেতরে এতো খুশিখুশি ভাব যে, বুকের ছাতিখানা ফুলে আছে। দূর থেকে খেয়াল করলে মনে হবে আস্ত একটা মানুষ উড়ে উড়ে পাড়ের দিকে আসছে। তার পেছনে—ছকিয়াবিল, কালাপানি, উগাখাটু, নাগুয়া’র বিল পেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল হাওর—হাকালুকি। এরকম আরো অনেক ছৈইদ আলী ছেঁড়া ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু ভিতর থেকে বারবার উগলে বেরুচ্ছে—তৃপ্তির ঢেঁকুর। প্রাপ্তির হাসি। যদিও বিশ-পনেরো দিন হাওরে হাড় ভেঙেছেন ধানের পেছনে। তাদের কাছে দৌড়ে গিয়ে হাত বাড়াতে পারলে দেখবেন,—পরম নির্ভরতায় দু‘হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরবেন। বড় বড় শ্বাস নিতে দেখবেন। নিচ্ছিল ক্লান্তি আর ভাঙচুরা শরীরটা অর্ধেকে টেকেছে দু’মুঠো ধানের জন্যে। এই মৌসুমে পেয়েছেনও বটে। খুশি, মনে হচ্ছে—হাওরপাড়ের জহুরিদের হাসি আর থামছে না, যেনো ভাড়ালে তুলছেন ধানের বদলে জহরত।
আগাম বন্যার ভয়ে ছৈইদ আলী [ছদ্মনাম] পুরো অর্ধমাস ধরে হাওরে ছিলেন।—পাড়ে ভিড়ছেন স্বপ্ন নিয়ে। কয়দিনের টানা খাটুনি, কম ঘুমের চোখ নিয়ে টলমল ঈষৎ পা টেনে টেনে বাড়ির দিকে আসছেন। এলোমেলো চুলদাড়ির মানুষটার হাতে এবছরের কাটা ধানের প্রথম গোছাটি। [আগের দিনের মানুষেরা বিশ্বাস করেন-বছরের প্রথম ধান গোছাটি যত্ন ও মমতার সাথে সংরক্ষণ করলে পরের বছর ভালো ফলন হয়।] মনে হচ্ছিল এখুনি পড়ে যাবেন বুঝি। হাড়জিরজিরে শরীর নিয়ে হাঁটছেন—তারপরও চোখ মুখে বেজায় তৃপ্তি। এবার ঝড়-বাদল ছুঁতে পারেনি ধান। বৃষ্টিতে না ভিজায়েই সব ধান নিয়ে বাড়ি ফেরা গেলো। মানুষটার ভেতরে এতো খুশিখুশি ভাব যে, বুকের ছাতিখানা ফুলে আছে। দূর থেকে খেয়াল করলে মনে হবে আস্ত একটা মানুষ উড়ে উড়ে পাড়ের দিকে আসছে। তার পেছনে—ছকিয়াবিল, কালাপানি, উগাখাটু, নাগুয়া’র বিল পেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল হাওর—হাকালুকি। এরকম আরো অনেক ছৈইদ আলী ছেঁড়া ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু ভিতর থেকে বারবার উগলে বেরুচ্ছে—তৃপ্তির ঢেঁকুর। প্রাপ্তির হাসি। যদিও বিশ-পনেরো দিন হাওরে হাড় ভেঙেছেন ধানের পেছনে। তাদের কাছে দৌড়ে গিয়ে হাত বাড়াতে পারলে দেখবেন,—পরম নির্ভরতায় দু‘হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরবেন। বড় বড় শ্বাস নিতে দেখবেন। নিচ্ছিল ক্লান্তি আর ভাঙচুরা শরীরটা অর্ধেকে টেকেছে দু’মুঠো ধানের জন্যে। এই মৌসুমে পেয়েছেনও বটে। খুশি, মনে হচ্ছে—হাওরপাড়ের জহুরিদের হাসি আর থামছে না, যেনো ভাড়ালে তুলছেন ধানের বদলে জহরত।
আমাদের নেতারা যেখানে পাজেরো রেখে ধানগাছের সাথে ছবি তুলতে কাঁচি হাতে নেমেছিলেন সেখান থেকে আরো দশ-বারো মাইল ভাটিতেও ধানছিলো। সেখানেও জহরত আবাদ করেছেন আমাদের জহুরিরা। অনেক নীচু সে জায়গা। অল্প বৃষ্টিতে ঐ জায়গা তলিয়ে যায়। ওখানে ক্যামেরা যায় না, নেতা যেতে পারেন না। অনেক কাঁদাপানি ঠেলে যেতে হয়। ওখান থেকেও তুলে আনেন ধান আমাদের কৃষকেরা। এ বোরো সময়ের সব চেয়ে বড় কথা হলো—ধান কাটা নিয়ে যদিও অনেক হাসাহাসি হয়েছে। মজা হয়েছে। তামাশা হয়েছে। এসবের ফাঁকে কাজের কাজ হলো—ধান ঘরে উঠে এসেছে। সবাই তো আর সাংবাদিক নিয়ে ফটো তুলতে যাননি! অনেকেই সত্যিকারভাবে মন থেকে গিয়েছিলেন মাঠে; ক্ষেতে। কৃষকদের সাথে আলে বসেছেন, পিঠ ছাপড়ে উৎসাহ দিয়েছেন। এমন মানুষেরও সংখ্যায় কমতি ছিলো না। ফলে কোনো কৃষকই এবার মুখ ভার করে, হতাশার চোখে তাকাতে হবে না। যার যেমন আয়োজন ছিলো, ঠিক তেমন অর্জন নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তবে কথা আছে কৃষকের মুখে—অন্য বছরের চেয়ে এবছর নাকি সার-গোবরে-ঔষধে টাকা বেশি লেগেছে। ধান আবাদে টাকা লেগেছে আগের অন্যান্য বছরের তুলানায় অনেক বেশি। উচ্চদামে কিনেছেন ইউরিয়া, টিএসপি ও অন্যান্য সার-ঔষধ। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় ঢুকে না—এসব সার-বিষ-ঔষধ ছাড়া কী ধান চাষ হয় না? এই ইউরিয়া-মিউরিয়া কবে এলো?—মানুষ ভাবতেই পারছে না, ইউরিয়া-টিএসপি-কীটনাশক ছাড়া ধান চাষ যে হতে পারে, কারণ গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমরা ইউরিয়া দিয়ে ধান চাষ করছি। মানুষ ভুলে গেছে, ইউরিয়া দেশে কবে এসেছিল এবং ধান পৃথিবীতে কবে এসেছিল। যদি ভুল না করি!—প্রায় বারো হাজার বছর আগে ভারতীয় ভূখণ্ডে ধান চাষ শুরু হয়েছিল এমনটাই তো জানি। আর দেশে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর পর অর্থাৎ ষাটের দশক থেকে ইউরিয়া ও কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়েছে। অর্থাৎ গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের পেছনেও যে চাষ-বাসের একটা বিশাল ও সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে তা মানুষ ভুলে গেছে। ঠিক তেমনিভাবে, যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার বয়স কাটছাট করে মাত্র দুইশত বছর। অথচ তার আগে হাজার হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতার যে দীর্ঘ ইতিহাস, তা সিন্ধু সভ্যতা হোক, বা মিশরীয় বা আজটেক সভ্যতাই হোক, যা বৃহৎ যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা না হয়েও মানবপ্রজাতিকে ধারণ করেছিল এবং যথেষ্ট উন্নত ছিল, তাদের কথা আজ আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। অবচেতনে আমরা বিশ্বাস করি, দুইশত বছর আগে ইউরোপে যন্ত্রসভ্যতা আসার আগে আমরা সবাই অসভ্য বর্বর ছিলাম। আমাদের সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস ও অবদান ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র যন্ত্রসভ্যতাকেই এক ও একমাত্র আশ্রয় এবং সভ্যতার একমাত্র লক্ষণ বলে ভাবাটাই আজ আমাদের ও আমাদের বাসস্থান এই পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গতির কারণ। যাক এই বিষয় থাক, অন্য কোথাও অন্য কোনো সময় লেখা যাবে।
আনন্দের ব্যপার হলো—এ পর্যন্ত সিলেটের হাওরের ৯৮শতাংশ বোরো ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে উঁচু জমি ও হাওরে নিম্নাঞ্চলের জমিতে এই বোরো মৌসুমে চার লাখ ৭৪ হাজার ১৯৫ হেক্টর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে কেবল হাওর অঞ্চলেই দুই লাখ ৬৯ হাজার ২৮৯ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। যার মধ্যে তিন লাখ ৩১ হাজার ৬৯২ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। হাওরে দুই লাখ ৪২ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। যখন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ধান পাকা হয়ে গেছে একবারে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ স্বেচ্ছাসেবীরা কৃষকদের ধান কাটার প্রতি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। ফলে কৃষকের ঠোঁটের কোণে যে হাসির ঝিলিক ফুটেছে তা রাষ্ট্রীয় অর্জনের পাড়ে এসে ঢেউ খেলে যাবে। কৃষকরা তো ভুলে যাবার কথা না—২০১৬ সালে অকাল বন্যায়ও এ অঞ্চলের ৬০ ভাগ ফসল পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো। ধার-দেনা করে যারা ক্ষেতে নেমে ছিলেন তারা তো দীর্ঘ সময় ধরে সেই ঋণের দায় টেনে চলতে হয়েছে। বিক্রি করতে হয়েছিলো হালের মহিষ কিংবা বলদটা। এই মৌসুমের এপ্রিলের শেষ দিকে বন্যার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলো পানি উন্নয়ন বোর্ড। কৃষকের ভেতর শুকিয়ে কাট হতে শুরু করে। যাক, রক্ষা—এখন পর্যন্ত সে রকম বৃষ্টি বা উজানের ঢল লক্ষ্য করা যায়নি। যে পরিমাণের ধান হাওরে-মাঠে রয়েছে, তুলে নিয়ে আসা যাবে। এখন আর তেমন ঝুঁকি বা আশঙ্কা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
সিলেট অঞ্চলে এই মৌসুমে কৃষক ও পেয়িং সহযোগী মিলে কমবেশি প্রায় এক লাখ বাষট্টি হাজার শ্রমিক ধান কাটায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রশাসনের সরাসরি তদারকি ও সহযোগিতার পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ বিভিন্নস্তরের মানুষের বড় ধরণের একটা সহযোগিতা ছিলো। আগাম বন্যার পূর্বাভাস পেয়েই কৃষকেরা সকল প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে পড়েন। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ লক্ষমাত্রার চেয়েও বেশি ধান গোলায় উঠেছে। বোরোর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সিলেট অঞ্চলে—চার লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন। আবাদ হয়েছে চার লাখ ৭৪ হাজার ১৯২ হেক্টর জমিতে। যদি আমরা জেলা পর্যায়টি আলাদা করে দেখি তাহলে দেখবো—সুনামগঞ্জে দুই লাখ ১৯ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। হবিগঞ্জ জেলায় আবাদ হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৮শ’ হেক্টর জমিতে। সিলেট জেলায় আবাদ হয়েছে ৮০ হাজার ৫৬৫ হেক্টর এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৫৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। এবার চাল উৎপাদেনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ১০৫ মেট্রিক টন। এরমধ্যে সিলেটে ৩ লাখ ১ হাজার ৮৮৯, মৌলভীবাজারে ২ লাখ ৯ হাজার ১৯৯, হবিগঞ্জে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন এবং সুনামগঞ্জে ৮ লাখ ৭০ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন। গেলো বছর সিলেট বিভাগে ছিলো—৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫১৪ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বোরো আবাদ হয়েছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫২১ হেক্টর জমিতে।
কষ্টের।—খুব কষ্টের একটা গল্প প্রতি বছরই কৃষকদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। হতাশা আর আফসোস নিয়ে বলতে শোনা যায়—‘এ বছর কষ্ট করে ধান ফলাইয়া ফায়দা হলো না। ধান যেই বিক্রি করমু, তখনই ধানের বাজারে পানি ঢেউ খেলে। দাম নাই।’ তারা ন্যায্যমূল্য পান না। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পোড়ে, ধারদেনা করে আবাদ করার পর উল্টো লোকসান গুনতে হয়। আর সে কারণে দিনে দিনে কৃষকেরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ধান চাষ থেকে। চলতি মৌসুমেও তো অনেক কৃষি জমি অনাবাদী থেকেছে।—এই কথাগুলো কৃষকদের। তারা খুব শক্ত করে বলছেন—সামনের দিনে অনাবাদি জমির পরিমাণ আরো বাড়বে, যদি এ বছরও ধানের উচিৎ মূল্য না পান। হাকালুকি ও কাউয়াদিঘী হাওরপাড়ে বেশ কিছু সংখ্যক কৃষকের সাথে কথা হলো—তারা বলছিলেন, যতটুকুই আবাদ হয়েছে—আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মাঠে ধান ভালো ফলেছে। লকডাউনের কারণে শ্রমিক সংকটসহ বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছে, বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে এবারের ফলন ও ঘরে ধান তোলা বিগত দিনের চাইতে ভালো হয়েছে। ব্রি-২৮, ব্রি-১৪, ব্রি-৪৮ প্রজাতির ধানই আবাদ করেছেন কৃষকেরা। এই প্রজাতির ধানগাছ অতিখরা, অতিবাদল সহ্য করতে পারে। ভাতেও স্বাদ বেশি তাই কৃষকের আগ্রহ এই ধান চাষে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী—হাওর অধ্যুষিত অঞ্চল : কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই সাতটি জেলার শুধু হাওরেই ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে৷ এ বছর বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন৷ এ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২০ শতাংশ আসবে হাওর অঞ্চল থেকে৷ সরকার এবছর বোরো ধান সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে৷ ঘোষণার সময় বলা হয়েছে—৩৬ টাকা কেজি দরে মিল থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা কেজিতে দেড় লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজিতে ছয় লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান কেনা হবে৷ ২৬ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বোরো ধান এবং ৭ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বোরো চাল সংগ্রহ করা হবে৷ সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার সময় জনসমাগম এড়াতে ২২টি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে অ্যাপ ব্যবহার করবে৷ ‘ডিজিটাল খাদ্যশস্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা ও কৃষকের অ্যাপ’-এর মাধ্যমে ঢাকার সাভার উপজেলা এবং গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, ভোলা, নওগাঁ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা [সদর দক্ষিণ] এবং বরিশাল সদর উপজেলা থেকে বোরো ধান সংগ্রহ করা হবে৷ অভিযান চলাকালে কৃষকরা সরাসরি গুদামে গিয়েও বিক্রি করতে পারবেন। চাল সংগ্রহের জন্য মিলাররা খাদ্য বিভাগের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। গুদামে ধান দেবার সময় কৃষককে যাতে কোনো প্রকার হয়রানির শিকার হতে না হয় সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। ২৬ এপ্রিল থেকে হাওর এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে।
বাজারে বীজের দাম অনেক বেশি ছিলো। অনেক বেশি দামে বীজ কিনতে হয়েছে কৃষকদের। লকডাউনের কারণে শ্রমিকের সঙ্কট তৈরি হয়েছিলো। বেশি মুজুরিতে শ্রমিক নিতে হয়েছে। তাছাড়া—সেচ, হালচাষ, সার-গোবর, ঔষধের ব্যয়ও ছিলো দুই-তিন গুণ বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় কী ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে? যাই হোক, সরকারের তরফ থেকে ধান-চালের একটা মূল্য নির্ধারিত হয়েছে, আমাদের কৃষকেরা কী পাবেন সেই মূল্য? প্রকৃত কৃষকরা সরকারের হাতে তুলে দিতে পারবে তো তাদের হাড় মজানো কষ্টে চাষ করা ধানগুলো? সরকারি ধান সংগ্রহের গল্পে তো অনেক রকমেরই অনিয়মের দাগ লেপ্টানো থাকে। আসল কৃষকেরা ধান নিয়ে ভিড়তে পারেন না সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে। সেখানেও নাকি অনেক বাঁধ থাকে, বিধি থাকে, বাহানা থাকে! আমরা আশা করবো—প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনবেন। আপনারা যারা দায়িত্ব প্রাপ্ত, ধান কেনায় কোনো অনিয়ম করার আগে একবার হলেও কৃষকের ঘামঝরা চেহারাখানা আপনাদের চোখে ভাসাবেন। ভাববেন, ছৈইদ আলীদের মতো আপনাদেরও কেউ না কেউ কৃষক। এই ভাবে ধানের বস্তা পিঠে নিয়ে, আপনার মতো অন্য কারো দরজায় ঠিক এই মুহূর্তে; ধানগুলো বিক্রির আশায়।
মুজাহিদ আহমদ, কবি ও সাংবাদিক
[email protected]
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়