ডা. সাঈদ এনাম
প্রকাশিত: ০০:১৬, ১৪ মে ২০২০
করোনাভাইরাসে নারী-শিশু মৃত্যু কম কেনো?
করোনাভাইরাস এর আক্রমণে সারাবিশ্ব স্থবির হয়ে গেছে। মানুষ আজ নিজ গৃহে বন্ধী। করোনাভাইরাস এর সাথে যুদ্ধে নারী পুরুষ শিশু সবাই কম বেশ আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যু হচ্ছে তবে সারা বিশ্বের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নারী ও শিশুর আক্রান্ত ও মৃত্যু পুরুষদের চেয়ে অনেক অনেক কম৷ কি এর রহস্য! কেনো এমন হচ্ছে?
করোনাভাইরাস নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলমান। আক্রান্ত ও মৃত্যুর এমন ভেদাভেদ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্ত এখনো পাওয়া যায়নি তথাপি নিম্নলিখিত মতবাদের পক্ষে অনেকের যুক্তি রয়েছে।
করোনাভাইরাস শিশু মৃত্যু কম,
১) শিশুদের হরহামেশা ভাইরাল ইনফেকশন লেগেই থাকে। ধারনা করা হয় এসব ইনফেকশনের ফলে তৈরী রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডি তাদেরকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকেও খানিকটা সুরক্ষা করছে।
২) শিশুদের ইম্যুনিটি সিস্টেম নবীন পর্যায়ে , খুব একটা সুগঠিত নয়। এই অপরিপক্ক ইমিউনিটি সিস্টেম তাদের ভাইরাস ইনফেকশন প্রতিরোধে বাড়তি সুবিধা দেয়।
করোনাভাইরাস এর সংক্রমণে আমাদের দেহের ডিফেন্সিভ মেকানিজমের প্রভাবে যে ইম্যুনোলজিক্যাল ঝড় "সাইটোকাইন স্ট্রোম" তৈরী হয় শিশুদের ক্ষেত্রে সে 'সাইটোকাইন ঝড়' তেমন একটা দেখা যায়না। ফলে তাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ মারাত্মক অবনতির দিকে যাচ্ছেনা।
৩) শিশুদের ফুসফুসে ACE -2 রিসেপ্টর কম থাকে। করোনাভাইরাস মুলত ফুসফুসের এই ACE-2 রিসেপ্টর ব্যবহার করে তীব্র সংক্রমণ ঘটায়। রিসেপ্টর কম থাকাতে শিশুদের ফুসফুসে করোনা সংক্রমণ তেমন একটা তীব্র ভাবে দেখা দেয়না। সামান্য সর্দি কাশিতেই শেষ হয়ে যায়।
অনেক শিশু করোনায় মারা গিয়েছেন, কেনো?
কোন শিশুর যদি কো-মরবিড কোন কন্ডিশন থাকে অর্থাৎ তার কোন জন্মগত কোন রোগ যদি থাকে যেমন থেলাসেমিয়া, লিউকেমিয়া বা অন্যান্য জেনেটিক কিছু রোগ তাহলে তার সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই কম থাকে ফলে সেসব ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ তীব্র ভাবে দেখা দেয় এবং মৃত্যু ঘটায়।
করোনায় শিশুদের প্রতি উপদেশঃ
শিশুদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বিরত রাখতে তাদের ঘরে রাখুন। তাদের সাথে করোনা নিয়ে গঠনমূলক আলাপ করুন। তাদের হাত ধুয়া, সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনে চলা এসব সু-অভ্যাস গড়ে তুলুন। আতংক নয় তাদের সচেতন করুন।
ফ্রীজের খাবার, চিনি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। বাহিরের চকলেট, জুস পরিহার করুন।
বেশী বেশী শাক সবজি, দেশী ফল খেতে উৎসাহিত করুন। এসব খাবার এ মৌসুমে যেমন সস্তা তেমন তরতাজা।
করোনাভাইরাসে নারীদের মৃত্যু কেনো কম?
সারা বিশ্বেই করোনাভাইরাস আক্রমণে যে সংখ্যায় পুরুষ মারা যাচ্ছেন তার চেয়ে অনেক অনেক কম মারা যাচ্ছেন নারীরা। সাধারণ মানুষের মনে এখন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, কেনো এমন হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে রাত দিন গবেষণা করছেন। তবে যেহেতু এটি সম্পুর্ন নতুন ভাইরাস তাই এ ব্যাপারটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না। তবে কিছু কিছু থিওরী আছে যার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি প্রমাণ আছে। যেমন,
১) সেক্স ক্রোমোজমের প্রভাবঃ
পুরুষদের সেক্স ক্রমোজোম একটা X একটা Y ক্রোমোজম নিয়ে গঠিত। কিন্তু নারীদের দুটোই এক্স ক্রোমোজম (XX)। ধারণা করা হয় দেহের 'X ক্রোমোজম' রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
যেহেতু নারীদের সেক্স ক্রোমোজমের দুটিই X তাই তারা অতিরিক্ত রোগ প্রতিরোধী। পুরুষদের সেক্স ক্রোমোজম একটি X কম থাকায় (XY) তারা নারীদের তুলনায় কিছুটা কম রোগ প্রতিরোধী।
২) হরমোনের প্রভাবঃ
নারীদের ইস্ট্রোজেন (Oestrogen) হরমোন বেশী। এর প্রভাবেই তারা নারী। এই ইস্ট্রোজেন হরমোন রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। চিকিৎসা গবেষকদের মতে এই অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী রোগ প্রতিরোধী।
৩) দৈনন্দিন অভ্যাসঃ
ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে নারীদের মধ্যে ধুমপান, মদপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের প্রবণতা কম। এ অভ্যাস গুলো রোগ প্রতিরোধে শরীরকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
নারীদের মধ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভ্যাস সাধারণত পুরুষদের তুলনায় খানিকটা বেশী। তাছাড়া নারীরা বেশী রোগ সচেতন এবং যেকোন রোগ প্রতিরোধে চিকিৎসকদের পরামর্শ পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী মেনে চলেন। ফলে তারা যেমন রোগে সংক্রমিত হন কম তেমন তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশী।
৪) কো- মরবিডি নারীদের তুলনামূলক কমঃ
জেনেটিক্স এবং হরমোনের প্রভাবে নারীদের কো-মরবিড ডিজিজ যেমন হাইপার টেনশন, ক্যান্সার, ডায়বেটিস, এজমা এসব রোগ কম থাকে যার জন্যে তাদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস বিপদজনক হয়ে উঠে কম। ফলে তাদের মৃত্যুও কম হচ্ছে।
ইমিউনোলজিক্যাল এক গবেষণায় দেখা গেছে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের আক্রমণের সময়ও একই ভাবে নারীদের মৃত্যুর হার পুরুষদের তুলনায় ছিলো অনেক কম।
কেনো বয়স্ক পুরুষদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান বেশী?
করোনাভাইরাসে কেনো সারা বিশ্বের সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক পুরুষরাই বেশী মারা যাচ্ছেন। এ প্রশ্ন সবার মুখে মুখে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে পড়ে। নানান কো-মরবিড রোগ ব্যাধিও শরীরে বাসা বাঁধে। এসব কারনে করোনাভাইরাস (SARS COV -2) সংক্রমণে বয়স্কদের মৃত্যু হচ্ছে বেশী। অতীতের করোনাভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুর পরিসংখ্যান ও এমন বহন করে।
তবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান যাই হোক আমাদের সচেতন হয়ে চলতেই হবে।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামী আমাদের সবাইকে এ মহামারী থেকে রক্ষা করুন। করোনা যুদ্ধে আমাদের জয়ী করুন, আমরা যেনো আমাদের আগের জীবনে ফিরে যেতে পারি।
ডা. সাঈদ এনাম, সহকারী অধ্যাপক, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়