আলমগীর শাহরিয়ার
প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২৫ মে ২০২০
আপডেট: ১৪:০৯, ২৯ মে ২০২০
আপডেট: ১৪:০৯, ২৯ মে ২০২০
বিদ্রোহী, প্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক নজরুল
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম চুরুলিয়া। সে গ্রামের দরিদ্র এক পরিবারে জন্মেছিলেন আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ভারতবর্ষে তখন স্বরাজ আন্দোলন চলছে। বাংলা সাহিত্যে তখন রবীন্দ্রযুগ। অনতিক্রম্য রবীন্দ্র বলয়। সে বলয়ের বাইরে বেরিয়ে যে কজন কবিতা লিখছেন তাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ও নজরুল ইসলাম প্রধান। বরিশালের নিভৃতচারী জীবনানন্দ দাশ স্বভাবসুলভ কারণেই তখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃতপ্রায়। অন্য দিকে, নজরুল তাঁর কবিতার রণঢঙ্কা বাজিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রবল উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন। স্বরাজের জন্য তিনি নিজেও কারা নির্যাতিত। দেশমাতার মুক্তি রণ দামামায় তাঁর রচিত কবিতা, গান তখন বিপুল প্রেরণার।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী'র মতোই যাকে আমরা আমৃত্যু দেখি বাউণ্ডুলে। যুগপৎ তুমুল আনন্দ ও বেদনায়, সেনাবাহিনীতে বছর তিনেক শৃঙ্খলার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিয়েও সহজাত অনিয়মে, বেহিসেবী, বিশৃঙ্খলায়, বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে, চেনা সময় ও সমাজকে চুরমার করে, উজানস্রোতে এক মহাজীবন সাতরে যেতে। তিনি আমাদের দুখু মিয়া। নুরু নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। জন্মের পর মায়ের রাখা দুখু মিয়া নামের সার্থকতা রক্ষার জন্যই যেন জনমভর দুঃখ আর দারিদ্র্য তাঁর পিছু ছাড়ল না। শৈশবেই ছিলেন দুরন্ত, ডানপিটে। অস্থির, চপল, চঞ্চল। গোলাম মোস্তাফা মাত্র ক লাইনে তাঁর এক অনবদ্য জীবনী লিখে গেছেন, "কাজী নজরুল ইসলাম/ বাসায় একদিন গিসলাম/ ভায়া লাফ দেয় তিন হাত/ হেসে গানগায় দিনরাত/।"
মাত্র বারো বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন। আর ঘরে ফেরা হয় নি। আরব না হলেও ছিল বেদুঈন-স্বভাব তাঁর। ঘর ছাড়ার। চেনা গণ্ডি থেকে বেরিয়ে পড়ার। নজরুলের শৈশব কৈশোরের দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প 'অতিথি'র চরিত্র তারাপদের কথাও কারও কারও মনে মনে পড়তে পারে। হরিণশিশুর মতো যে বন্ধনভীরু, আবার হরিণেরই মতো সংগীতমুগ্ধ। যাকে কেউ বেঁধে রাখতে পারে না। যৌবনে শর্তযুক্ত নার্গিসও না। যে আসক্তিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলে যেতে ব্যাকুল থাকে।
তবুও অল্প বয়সে ঘর ছাড়ার পর সংসারের মায়া হয়তো অবচেতন মনে একসময় টেনেছে তাঁকে। বেঁধেছেন প্রমীলার বন্ধনে নিজেকে। সংসারেও যে খুব মনযোগী ছিলেন তা-ও না। ছিলেন স্বভাবসুলভ উদাসীন। অকালে প্রিয় সন্তান হারিয়েছেন। গভীর বেদনায় দগ্ধ হয়েছেন। শোকে স্তব্ধ হয়েছেন। যে শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি আমৃত্যু। যদিও অসুস্থতার আগ পর্যন্ত দমে যান নি কখনো। দুঃখ ও দারিদ্র্যকে পাশ ঠেলে মুখর হয়েছেন সৃজনে সৃষ্টিশীলতায়। প্রাচুর্যের হাতছানি এসেছে জীবনে। কিন্তু দু হাত উপচে উড়িয়ে দিয়েছেন হেসেখেলে।
প্রেমিক নজরুল
তিনি শুধুই বিদ্রোহী কবি নন, একই সঙ্গে ছিল তাঁর দুর্দান্ত এক প্রেমিক সত্তাও। তিনি আমাদের প্রেমেরও কবি। যৌবনের কবি। জোয়ার ভাটার মতই তাঁর জীবনেও অনেকবার প্রেম এসেছে। তুমুল তীব্র প্রেমে মজেছেন। কাকতালীয় হলেও তাঁর জীবন ও সৃষ্টিশীলতায় প্রভাব বিস্তার করা বেশ কজন নারীর মধ্যে অন্তত চারজনের নাম জানা যায় যারা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের। অথচ বিশেষ কোন সূত্রে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁর খুব নিবিড় যোগাযোগ ছিল এমন নয়। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় কেটেছে জীবনের সিংহভাগ সময়। উল্লেখযোগ্য চার জনের একজন কুমিল্লার দৌলতপুরের সৈয়দা খাতুন যাকে কবির দেওয়া কাব্যিক নাম 'নার্গিস' নামেই সবাই চেনে। যাকে বিয়ের আসরেই ত্যাগ করে আসেন। এইটুকু নজরুল অনুরাগী অনেকেই জানেন। কিন্তু কেন বিয়ের আসরে এভাবে ত্যাগ করে এসেছিলেন সেটুকু অনেকের কাছেই রহস্যাবৃত।
জানা যায়, বিয়ের চুক্তিনামায় নজরুলকে নার্গিসের অভিভাবকেরা ঘরজামাই করে রাখার একটি শর্ত জুড়ে দেন। স্বাধীনচেতা ও প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী নজরুল এ শর্তপাঠ বিয়ের আসর ত্যাগ করেন। কুমিল্লা ত্যাগ করলেও কুমিল্লা তাঁকে ত্যাগ করেনি। ডেকেছে বারংবার। নজরুলের ডাকা 'মা' বিরজাসুন্দরী দেবীর পরিবারেরই এক কিশোরীর প্রেমে মজেন নজরুল। আশালতা ওরফে দোলন বা দুলিকে(যিনি কবির দেয়া নাম প্রমীলা হিসেবেই সমধিক পরিচিত হন)। বিরুদ্ধ সমাজ, সংস্কার ও ধর্মের কঠিন দেয়াল ভেঙ্গেই বিয়ে করেন।
ঢাকায় বেড়াতে এসে একবার পরিচয় হয় পুরান ঢাকার রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসুর সঙ্গে। যাকে নজরুল গান শিখাতেন। আন্দাজ করা যায় প্রতিভা বসুর সঙ্গে নজরুলের অনুরাগ বেশ গভীর ছিল। রানু সোমকে তাদের বাসায় নিয়মিত গান শেখাতে যেতেন। গান অনুশীলনে রাত হয়ে যেত। রাত করেই আবাসস্থলে ফিরতেন। এ দৃশ্য সতর্ক চোখ রাখা পাড়ার গুণ্ডাদের নজর এড়ায় নি এবং এক রাতে কবি তাঁর সাময়িক বাসস্থান বর্ধমান হাউজে ফেরার পথে ঠাটারি বাজার মোড়ে গুণ্ডাদের আক্রমণেরও শিকার হন। তবে প্রবল সাহসী ও শক্তিমান সৈনিক কবি নায়কোচিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। নিশ্চয়ই অপ্রীতিকর এ স্মৃতি কবির জীবনে সুখকর ছিল না। কিন্তু বিছিন্ন ঘটনা হিসেবেই জীবনের খেরোখাতায় বিস্মৃত হওয়ার কথা।
এ ছাড়াও, সেকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করা অসামান্য বিদুষী নারী ফজিলতুন্নেসার সঙ্গেও নজরুলের অন্তরঙ্গ ভাব বিনিময় হয়েছিল বলে জানা যায়। দেখা সাক্ষাৎ ও পত্রালাপ ছিল। এমনকি নজরুল তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও তাঁকে উৎসর্গ করতে চান। এ মর্মে কলিকাতা থেকে ঢাকায় চিঠি পাঠালেও ফজিলতুনন্নেসা অনাপত্তি পত্র দেন নি। সেসময়ের বাস্তবতা ও লোকলজ্জায় এতে আপত্তি করাও অসঙ্গত মনে হয় না। তবে সঙ্গত কারণেই এ অনুরাগের কালও দীর্ঘ হয় নি। জাহানারা নামে তাঁর আরেক প্রিয়ার নাম জানা যায়। যার জন্য লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা আর গান। এদের কার কার খোঁপায় কবি কল্পনায় গুজে দিয়েছিলেন তারার ফুল মানব মনের কৌতূহলে থাকুক অমিমাংসিত অধ্যায় হয়ে। তবে এ কথা সত্য তাঁর প্রেমিক সত্তা তাঁর বিপ্লবী সত্তার সমান।
বিদ্রোহী ও অসাম্প্রদায়িক নজরুল
নজরুল চিন্তায় ও মননে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। হিন্দু মুসলিম মিলনে ও সম্প্রীতিতে ছিলেন বিশ্বাসী। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুকূল এক পরিবেশে বেড়েও উঠেছিলেন। তখন পর্যন্ত ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান বলা কবি তাই বিরজাসুন্দরী দেবীকে অকৃত্রিম মমতা নিয়েই 'মা' ডাকতেন। অসঙ্কোচ এ বোধ ও প্রকাশ। শৈলজানন্দ ছিলেন তাঁর খুব কাছের বন্ধুদের একজন। আশালতার প্রেমে পড়ার কালে ধর্ম পরিচয় নিয়ে আলাদা করে ভাবেন নি। সেজন্য আশালতা ওরফে দোলনকে বিয়ে করার সময় ধর্মান্তরিত করার কথাও মাথায় আসে নি। শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবীও অনায়াসে নিজ ধর্ম বিশ্বাসে অটল থেকে পূজা অর্চনা করতেন নজরুলের বাসায়।
এমনকি তাঁর প্রথম সন্তানের নামকরণ দেখলেও নজরুল ধর্মচেতনা ও সম্প্রীতিবোধের আশ্চর্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ভগবান কৃষ্ণ ও নবী হজরত মুহম্মদ(সাঃ) নামের সঙ্গে মিল রেখে ছেলের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ। সেকালের কেন এখনকার সমাজ বাস্তবতায়ও এ বড়ো আশ্চর্য ঠেকে। কবি কত প্রাগ্রসর ছিলেন মননে ও চিন্তায়। কলকাতায় নিজে ধর্ম বিদ্বেষের শিকার হলেও কখনো নিজের জীবনাচরণে প্রশ্রয় দেন নি ধর্ম ও জাতপাতমূলক বিদ্বেষপ্রসূত আচরণের। বরং বিভেদের বিরুদ্ধে অবিরত বলেছেন। জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাঁর ক্ষুরধার কলম।
মাত্র বারো বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেছিলেন নজরুল। তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর ভেসে চলা এক জীবন। চিরকালের বাউণ্ডুলে। বেদুঈন। লেটোর দলে গানের রচয়িতা, রুটির দোকানে সহযোগী, রেলওয়ের এক গার্ডের বাড়িতে ভৃত্যের কাজ, দারোগা কাজী রফিজুল্লাহর বাড়িতেও গৃহভৃত্যের কাজ করেন। রুটির দোকানে কাজ করার সময়ই নজরুল দারোগার চোখে পড়েন এবং তাঁর বদান্যতায় পড়াশোনার সুযোগটুকু পান। স্কুলে ফেরার এই সুযোগ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক জীবন শেষ করে কলকাতায় ফিরে হাবিলদার নজরুল ইসলাম(এ নামেই প্রথম দিকে কবিতা লিখতেন) লেখালেখি ও কাব্যজগতে মনোনিবেশ করেন। ১৯২০ সালে নবযুগে সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তাঁর শিল্প সাহিত্যের জীবনেও এক নবযুগ শুরু হয়।
তাঁর আলোড়ন তোলা 'বিদ্রোহী' কবিতা অবিনাশ ভট্টাচার্য সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'বিজলী' পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারী সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কালোত্তীর্ণ কবিতা উঠতি কবি থেকে বয়সে তরুণ হলেও তাঁকে রাতারাতি বিদ্রোহী ও প্রতিষ্ঠিত কবির খ্যাতি এনে দেয়। নজরুলের নাম যশ তখন লোকেমুখেও ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর আগে কেউ এমন করে কবিতায় খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া উঠার কথা কিংবা ভগবান-বুকে পদ-চিহ্ন এঁকে দেওয়ার মতো দুঃসাহসী কথা বলার স্পর্ধা দেখান নি! পরেও না। রেনেসাঁ প্রভাবিত বিংশ শতাব্দীর প্রথামার্ধে শুধু বাংলা ভাষায় নয় বিশ্বসাহিত্যে কোন কবির বলা সবচেয়ে সাহসী উচ্চারণ। ১৮৮২ সালে অর্থাৎ মাত্র চল্লিশ বছর আগে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নীৎসে তাঁর এক রচনায় 'গড ইজ ডেড' বলে তুমুল আলোচিত সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু প্রকাশভঙ্গী ও ক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন উপস্থাপনা ও নান্দনিক চেতনাও। কবিতায় উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোলের জন্যও কবির আহাজারি ও অঙ্গীকার উৎকর্ণ পাঠক ও নিপীড়িতের চৈতন্যলোকে স্পন্দন জাগায়।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে এমন পরাক্রমশালী কথা কবিতায় বড়ো দুর্লভ। এর মাশুলও দিতে হয়েছে তাঁকে। রক্ষণশীলরা ক্ষেপেছিলেন নজরুলের বিরুদ্ধে। কেউ বলেছেন কাফের, কেউ বলেছেন শয়তান, কেউ কবির মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন পাগলের প্রলাপ। ইসলাম-দর্শন পত্রিকায় জনৈক মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন 'লোকটা মুসলমান না শয়তান' নামে একটি তীব্র সমালোচনা লিখেন। সমালোচনা না বলে গালাগালি বলা ভালো। যেখানে কবিকে নরাধম, খোদাদ্রোহী, নাস্তিক, ফেরাউন, নমরুদ বলেও আখ্যা দেন। একই পত্রিকার সম্পাদক নজরুলের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। কিন্তু নজরুল এসব সমালোচনা, ভ্রুকুটি, গালাগালি দলে গেছেন। "আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,/আমি দলে যাই যত বন্ধন,/যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!/আমি মানি নাকো কোনো আইন"— যিনি লিখেন তাঁর এসব তৃণতুচ্ছের তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করারই কথা।
তবু থেমে থাকে না স্বজাতি-বেশী শত্রুর সংক্ষুব্ধ সন্তাপ। মোহাম্মদী পত্রিকায় 'এছলাম ও নজরুল ইসলাম' শিরোনামের এক প্রবন্ধে নাজীর আহমদ চৌধুরী নজরুলকে সন্দেহাতীতভাবে 'এছলামের সর্বপ্রধান শত্রু' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নজরুলকে যখন সওগাতের আয়োজনে জাতির পক্ষ থেকে এক সংবর্ধনার আয়োজন হয় সে আয়োজন প্রক্রিয়ায়ও মোহাম্মদী পত্রিকার অনুসারীরা বাগড়া দেন। এখানেও সেই মাওলানা নাজীর আহমদকে দেখতে পাই। মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে প্রস্তুতি সভার স্থান দখল করে নজরুল বিরোধী উত্তেজনাকর ভাষণ দেন। সওগাতের তরুণেরা তাদের হটিয়ে প্রস্তুতি সভার কাজ আরম্ভ করেন এবং কবিকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে অ্যালবার্ট হলে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সংবর্ধনা কমিটিতে শরৎচন্দ্র, এ কে ফজলুল হক, দিলীপকুমার রায় এবং ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মতো প্রখ্যাত লোকদের নাম দেখা যায়। উল্লেখ্য, সংবর্ধনায় সভাপতির ভাষণে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রবীন্দ্রনাথের চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বলতার মধ্যেই নজরুলের নিজের আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠার কথা, নজরুল শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি এবং কবিরা সাধারণত কোমল ভীরু হলেও নজরুল তা নন, কারাগারের শিকল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অন্যদিকে, সুভাষ বসু তাঁর বক্তৃতায় একাংশে বলেন, "ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় বহু সুন্দর গান আছে। কিন্তু 'কাণ্ডারি হুশিয়ার' গানটির কোনো তুলনা মেলে না। তিনি যথার্থই বিদ্রোহী। 'আমরা যখন যুদ্ধেক্ষেত্রে যাব— তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব।" সত্যি আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ফের নজরুলের গান গাইলাম। যদিও পাকিস্তান পর্বে রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে নজরুলের গান ও কবিতাকে ইসলামীকরণের অপচেষ্টা হয়। সেই ভূতের আছর আজও অনেকের মানসলোক থেকে অপসৃত হয় নি। কবি হিন্দু হন না, কবি মুসলমান হন না, কবি খ্রিস্টান হন না; প্রকৃত কবি হন সকল কালের সকল মানুষের।
যাই হোক, নজরুল রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের মনোভাব জানতেন। মোহাম্মদী ও ইসলাম-দর্শন এরকম কতিপয় পত্রিকাকে ঘিরে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের কতিপয় লেখক নজরুলের বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদগার করেছেন। অথচ নজরুল সে সময় মুসলিম জাগরণের কবিতাও লিখেছেন। তাঁর গজল ছাড়া ঈদ উৎসবের কথা আজ ভাবাই যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ হলে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে আনোয়ারুল কাদিরের বাঙালী-মুসলমানের সামাজিক গলদ' নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং রক্ষণশীলতার সমালোচনা করেন। শুনে উচ্ছ্বসিত নজরুল বলেছিলেন, "আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নূতন অভিযান শুরু হয়েছে।... এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আশ্বস্ত হলাম যে, মৌলবী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতকগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।"
"জনৈক আনওয়ার হোসেনের অনুযোগে লেখা এক চিঠির উত্তরে নজরুল তাঁর অন্তরের কথা খুলে বলেন, "মুসলমান সমাজ আঘাতের পর আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে। তবু আমি দুঃখ করিনি বা নিরাশ হইনি। তার কারণ বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা ইর্ষাপরায়ণ।... মুসলমান সমাজ কেবলই ভুল করেছে— আমার কবিত্বের সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে অর্থাৎ নজরুল ইসলামকে জড়িয়ে। আমি মুসলমান— কিন্তু আমার কবিতা সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল জাতির। কবিকে হিন্দু-কবি, মুসলমান-কবি ইত্যাদি বলে বিচার করতে গিয়েই এত ভুলের সৃষ্টি!" সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত 'শনিবারের চিঠি'-তেও নজরুলকে কম ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা হয় নি। এরা সকলেই কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছেন। রয়ে গেছেন নজরুল। কালোত্তীর্ণ তাঁর সৃষ্টি।
নজরুল গড়পড়তা মানুষ ছিলেন না। ছিলেন চিন্তা ও স্বভাবে বিচিত্র ও অনন্য। শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন। কীর্তনে মশগুল হয়েছেন। দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য বরদাচরণ নামে বিশিষ্ট এক যোগীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীর্ঘদিন যোগাসনও করেছেন। এই নজরুল আবার হামদ নাত লিখেছেন, 'লা শরীক আল্লায়'-ও গভীর বিশ্বাসী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। বলেছেন মসজিদেরই পাশে যেন তাঁকে কবর দেয়া হয়। যাতে সকাল-সন্ধ্যা মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পান। নজরুলের ধর্মচেতনা, বিশ্বাস নানাসময় বিবর্তিত হয়েছে। রোগ শোকে কাতর বয়েসী নজরুল অপরিণত বয়সের অর্থাৎ শৈশবে পারিবারিক বলয়ে বেড়ে উঠা ধর্মবিশ্বাসেই ফের নিজেকে সমর্পণ করেছেন।
জীবন উপসংহারে নজরুল
৭৩তম জন্মজয়ন্তীর আগে ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সরকারকে অনুরোধ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন কবিকে। সরকারি একটি বাড়িও বরাদ্দ দেন। সেই বাড়িতে রাষ্ট্রপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে স্বাগত জানান। এটাই ছিল কোনো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কবিকে দেখানো সর্বোচ্চ সম্মান। যেখানে একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান উপস্থিত ছিলেন। যা হোক, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক এক দায়িত্ব পালন করলেন। যদিও নজরুল তখন সম্বিৎ হারা। স্বাভাবিক চিন্তা ও কার্যক্ষমতাহীন এবং এসব আনুষ্ঠানিকতা উদযাপনের উর্ধ্বে।
মৃত্যুর অনেক পরে কবির রোগের লক্ষ্মণ দেখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ধারণা করেন তিনি ডিমেনশিয়া অব লিউয়ী বডিজ(DLB) বা পিকস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। উন্নত চিকিৎসার চেষ্টা করা হলেও প্রাথমিক অবস্থায় রোগ চিহ্নিত না করতে পারায় তাঁর মস্তিষ্ক কর্মক্ষমতা হারায়, স্মৃতিশক্তি লোপ পায় এবং কবি প্রায় তিন যুগ সৃজনহীন দেহসর্বস্ব জীবনযাপন করে মারা যান। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের দুরন্ত কিশোর ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জীবন কাটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে চিরশয্যায় শায়িত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁর কবিতায় লেখা আকুতির মতোই।
— আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক
২৫.০৫.২০২০
-
খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়