আহমদ সরিাজ
প্রকাশিত: ০১:১৩, ১২ জুন ২০২০
ড. আনিসুজ্জামান স্যার : তাকে যেভাবে বুঝে ওঠা
নক্ষত্র সংকেতবিদ জ্যোতিষীর মতো যিনি ভূমিকা পালন করেছেন। মোটাদাগে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের একজন প্রাজ্ঞ অভিভাবকের মতো জাতির দুঃসময়ে ইস্পাত দড় থেকেছেন- তিনি ড. আনিসুজ্জামান স্যার। যাকে জাতীয় অধ্যাপকসহ বহু বহু পদপদবিতে অভিহিত করা হলেও তাকে অতিক্রম করে তিনি ছিলেন সাধারণের মাঝে অসাধারণ এবং অসাধারণের মাঝেও সাধারণ হয়ে বাঙালির লোকতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রগতিশীল উপাদানের প্রাজ্ঞ আলোক স্তম্ভ- যাকে ঠিক মতো বুঝে নিলে জাতিসত্তা ঠিকমত স্পষ্ট হয়ে উঠার অমলিন দর্পণ পাওয়া যেত।
তিনি আজীবন জ্ঞান-সাধনা-অধ্যাপনার ভিতর অতিবাহিত করেছেন, কিন্তু তা তপোবনী পণ্ডিতের মতো নয়, জগত জীবন স্বদেশের চলমান বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করে নয়- এসবের ভিতর দিয়ে, ভবিষ্যতের যুগপুরুষ অনাগত ভবিষ্যতে স্বদেশ ও পৃথিবী তাঁকে মর্মে মর্মে অনুভব করবে।
তিনি এই করোনা বিশ্বে করোনা রাজত্বকালে অশিতিপর বৃদ্ধের রোগ-ব্যাধি নিয়ে ভোগছিলেন- আরোগ্যের জন্য হাসপাতালের আশ্রয় নিয়েছিলেন- তিনি বার্ধক্যজনিত অসুখ থেকে এ যাত্রা রেহাই পাবেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের দৃঢ় বিশ্বাস হয়তো ছিল, তেমন প্রত্যাশাও শুভানুধ্যায়ীদের, কিন্তু সব প্রত্যাশাই ভঙ্গ হয়ে ১৪ মে ২০২০ তারিখে জানা গেল তার শরীরের অবনতির খবর, তেমন খবরে স্বজন প্রিয়জনের সঙ্গে শুভানুধ্যায়ীরাও উৎকণ্ঠিত। তাঁর মৃত্যুর খবর জানার পর এমন ব্যক্তির মরদেহ সন্দর্শনে শ্রদ্ধা নিবেদনে মানুষের মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হয়ে উঠছিল তখনই মধ্যরাতের আগে খবর এলো ড. আনিসুজ্জামান করোনায় আক্রান্ত, তাই তাঁর শেষকৃত্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না হয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট লোকজন নিয়ে সম্পাদিত হবে- খবর ভয়াবহ ঝড়ের মতো। তখন কোনো দুর্মুখ যদি প্রশ্ন তোলে- এই প্রবীণের হাসপাতালে নীত না হয়ে নিজ বাসভূমে নিখোঁজ থেকে পরিচর্যায় গৃহীত হলে এমন বিপর্যয়কর মৃত্যু বা এভাবে চলে যাওয়া ঘটত না কিংবা তার চলে যাওয়া অনিবার্য হয়ে উঠলেও তিনি করোনা আক্রান্তে পরিগণিত হতেন না। জাতির এমন মানস সন্তান হারানোর বেদনা এভাবে বহন করতে হতো না।
ব্রিটিশ ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আলোড়ন-বিলোড়নের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বা যোগ্য প্রতিনিধি হিসাবেও আনিসুজ্জামান ছিলেন আগাগোড়াই একজন আলোকোজ্জ¦ল ব্যক্তিপুরুষ- তাঁর বেড়ে উঠায়, চ্যুতি-বিচ্যুতি, ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি আক্রান্ত করতে পারেনি।
তিনি আজীবন জ্ঞান-সাধনা-অধ্যাপনার ভিতর অতিবাহিত করেছেন, কিন্তু তা তপোবনী পণ্ডিতের মতো নয়, জগত জীবন স্বদেশের চলমান বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করে নয়- এসবের ভিতর দিয়ে, ভবিষ্যতের যুগপুরুষ অনাগত ভবিষ্যতে স্বদেশ ও পৃথিবী তাঁকে মর্মে মর্মে অনুভব করবে।
তিনি ড. আনিসুজ্জামান স্যার, আমাদের ঠিকমত দেখা বা চেনাজানা কেউ ছিলেন না, তবে তিনি আমাদের পাঠেরই একজন ছিলেন বলা যায়, মফস্বলীয় দূরত্ব থেকেই এই মহীরুহ ব্যক্তিত্বে শ্রদ্ধান্বিত হয়েছি। তাঁর ‘কাল নিরবধি’ ও ‘আমার একাত্তর’ গ্রন্থ দুটিতে জানতে পারি আমার এলাকা কমলগঞ্জের সেই সময়ের মেধাবী ছাত্র মোহাম্মদ ইলিয়াস- যিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক। তিনি তাঁর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে যুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গেই দেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন সংগ্রামে মোহাম্মদ ইলিয়াস অন্যতম ব্যক্তিত্বের একজন হওয়ায় আনিসুজ্জামান স্যারও পরস্পর গভীর সাহচর্যে যুক্ত হয়ে উঠেন। মোহাম্মদ ইলিয়াস যে এত বড় একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা আমাদের জানাবোঝার ছিল না- অনুপ্রাণিত হয়েই তাঁর কাছে প্রয়াত মোহাম্মদ ইলিয়াস সম্পর্কে একটা লেখা চেয়েছিলাম ফোনে। তিনি সহজেই রাজি হয়ে যান এবং পনেরো দিনের মধ্যে হাতে লেখা একটি প্রবন্ধ ড. এম এম আকাশ মহোদয়ের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদ ইলিয়াস সম্পর্কিত জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি পুস্তিকা তাঁর কাছে পাঠানো হলে, তা পেয়ে নিজে ফোন করে প্রাপ্তি সংবাদ জানান। তাঁর কাছ থেকে এভাবে সরাসরি প্রাপ্তি সংবাদ জানার আশা করিনি। ইলিয়াস সম্পর্কিত বই লেখায় তিনি খুশি হন এবং জানান, ‘আপনি এ কাজটি করে ভালোই করেছেন।’ ‘কমলগঞ্জের ভাষা বৈচিত্র্য’ নামে একটা সিরিয়াস ধরনের বই কমলগঞ্জের তৎকালীন নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হলে গ্রন্থটি তাঁকে পাঠানো হয় এবং মাহমুদুল হককেও তিনি ফোন করে প্রাপ্তি সংবাদ জানান। এমন প্রবীণ ব্যক্তির কাছ থেকে ফোন না পেয়ে তাঁর সহায়ক যে কারো কাছ থেকে ফোন পেলেও খুশি থাকা যায়। তাঁকে সরাসরি দেখা বা জানার সুযোগ না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ দপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সেলু বাসিত এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁর সম্পর্কে জানার সুযোগ ঘটত।
গ্রন্থভুবনের এমন এলিট বিদ্বান আছেন যাদের অবস্থান যেন বরাবরই গ্রহ-নক্ষত্রের মতো। কিন্তু ড. আনিসুজ্জামান স্যারকে সহজেই এ জগত থেকে আলাদাভাবে বুঝে নিয়ে বিরাট হৃদয়ের একজন মানবিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে উদাহরণ টানা যায়।
তাঁর বেড়ে উঠা ছিল- প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাকা ও কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত ভূমিকায়, নেতৃত্বে, সমন্বয়কের দায়িত্বে ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ।
আমাদের অগ্রগতি, প্রবৃদ্ধির জয়জয়কারে যখন অনেকটাই টুইটুম্বুর অবস্থা- তখনও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার জগতে খরা দুর্ভিক্ষ পীড়িত দ্বারা আক্রান্ত ছিল, সেখানে আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন ভরকেন্দ্রিক ভরসার- তাঁকে হারানোর মধ্য দিয়ে এ জায়গাটা যেন একেবারে খালি হয়ে গেল।
ড. আনিসুজ্জামানের রাষ্ট্রীয় এ মৃত্যু বহুদিন আামদের তাড়া করে যাবে। মৃত্যু চিরন্তন রীতির অনিবার্যতা হলেও সব মৃত্যু মানুষের জীবনে গৃহীত হয়ে উঠে না; তাঁর প্রচণ্ড শূন্যতা বোধ আর এই শূন্যতা বোধ এর একজন আনিসুজ্জামান স্যার বড় তাড়িত হয়ে থাকবেন।
আহমদ সিরাজ, লেখক ও গবেষক
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়